‘গণরুম’ বন্ধে কঠোর ঢাবি কর্তৃপক্ষ, বাস্তবায়নই চ্যালেঞ্জ

করোনা পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে ‘গণরুম’ তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। গণরুমে থাকা প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য সাবেক ছাত্রদের দখলে রাখা কক্ষ বরাদ্দ রেখেছে প্রশাসন। কিন্তু হল খোলার পর সাবেক ছাত্রদের প্রবেশ ঠেকাতে না পারলে সিট পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্যসেন হলের একটি গণরুম। ফইল ছবি: সংগৃহীত

করোনা পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে 'গণরুম' তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। গণরুমে থাকা প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য সাবেক ছাত্রদের দখলে রাখা কক্ষ বরাদ্দ রেখেছে প্রশাসন। কিন্তু হল খোলার পর সাবেক ছাত্রদের প্রবেশ ঠেকাতে না পারলে সিট পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থীরা।

ঢাবির এক হলের আবাসিক শিক্ষার্থী হৃদয় (ছদ্মনাম) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুনেছি সাবেক বড় ভাইদের দখলে থাকা রুমে আমরা যারা গণরুমে থাকতাম তাদের সিট বরাদ্দ দিয়েছে হল প্রশাসন। এটা যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে আমরা হলে সিট পাব। আমাদের কষ্ট কমবে। এটি নিঃসন্দেহে খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু বড় ভাইদের হল থেকে বের করতে না পারলে আমাদের সিট পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। তখন আমাদের হল ছেড়ে বাইরে থাকতে হবে।'

গতকাল রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলো কেবল অনার্স চতুর্থ বর্ষ এবং মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হলেও, সাবেক শিক্ষার্থীদের গ্রন্থাগার দখলে নিতে দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান গ্রন্থাগারে সাবেক শিক্ষার্থীদের সামাজিক দূরত্ব না মেনে হইহুল্লোড় করে ভেতরে ঢুকতে দেখা গেছে। তাদের ঠেকাতে গিয়ে আহত হয়েছেন সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা।  

হল থেকে সাবেকদের বের করতে আগেও অনেকবার এ ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু হলগুলোতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের প্রভাব থাকায়, তা বাস্তবায়ন করা যায়নি বলে অভিযোগ আছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, এবার করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিজেদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সাবেক ছাত্র এবং বহিরাগতদের অবস্থান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিকভাবে তৈরি গণরুম সংস্কৃতি বন্ধ করার কথাও বলেছেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ৪ বেডের একেকটি গণরুমে ৩০-৩৫ জন শিক্ষার্থী একসঙ্গে প্রথম ১-২ বছর মানবেতর জীবনযাপন করেন। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে সুবিধা নেয় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতারা। গণরুমে অবস্থানকারীদের রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়, কখনও কখনও রাজনৈতিক প্রোগ্রামে না গেলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করারও অভিযোগ পাওয়া যায়।

সম্প্রতি এ প্রতিবেদক এমন ১০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন, যারা করোনা মহামারির আগে গণরুমে থাকতেন।

বিভিন্ন হলের এসব শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রাজনৈতিক বড় ভাইদের হাত ধরে তাদেরকে হলে উঠতে হয়েছে। হলে উঠার পর বড় ভাইয়েরা তাদেরকে গণরুমে তুলে দেন। সেখানে ৮ জনের রুমে একসঙ্গে ৩০-৩৫ জনকে গাদাগাদি করে থাকতে হয়।

শিক্ষার্থীরা আরও জানান, এই রুমে থাকার পূর্ব শর্ত হলো- যেকোনো সময় একসঙ্গে দল বেধে রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে যেতে হবে। না গেলে রাতে গেস্টরুমে ডেকে শাসন করা হয়, জবাবদিহি করা হয়, চলে মানসিক নির্যাতন। এ ছাড়া, সপ্তাহে ৩-৪ দিন গেস্টরুমে গিয়ে বড় ভাইদের থেকে 'ম্যানার' শিখতে হয় তাদের।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা বলেন, 'রাজনৈতিকভাবে যে যত কৃতিত্ব দেখাতে পারবে, সে সবার আগে হলে সিট পাবে, প্রায়ই বড় ভাইয়েরা এমন আশ্বাস দিতেন।'

করোনার কারণে দীর্ঘ ১৮ মাস পর আগামী ৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো খুলতে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পর্যায়ক্রমে হলে উঠতে হবে। প্রথম ধাপে অনার্স চতুর্থ বর্ষ এবং মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা হলে উঠবেন। দুই সপ্তাহ পর পরীক্ষা শেষে তারা হল ছেড়ে যাবেন। এরপর তৃতীয়, দ্বিতীয় এবং প্রথম বর্ষ পর্যায়ক্রমে হলে উঠতে পারবেন বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি আবাসিক হলের প্রভোস্টদের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। হল কর্তৃপক্ষ জানায়, ইতোমধ্যে তারা অ-ছাত্রদের কক্ষ খুঁজে বের করেছে। ওই কক্ষ শূন্য ঘোষণা করে সেখানে গণরুমের শিক্ষার্থীদের জন্য সিট বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা যখন হলে উঠবেন, তখন প্রশাসন তাদের সহযোগিতা করবে বলেও কয়েকজন হল প্রভোস্ট জানিয়েছেন।

এ ছাড়া, হলে যাতে অ-ছাত্ররা অবস্থান করতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে প্রতিনিয়ত হলের আবাসিক শিক্ষকরা পর্যবেক্ষণ করবেন। প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তারা।

প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি ও বিজয় একাত্তর হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইতোমধ্যে হলগুলোতে সাবেক শিক্ষার্থীদের কক্ষ খুঁজে সেখানে প্রথম এবং দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর তারা এলে তাদের কক্ষে তুলে দিতে প্রশাসন সহযোগিতা করবে।'

তিনি আরও বলেন, 'শিক্ষার্থীদের করোনা থেকে সুরক্ষিত রাখতে প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি গণরুম বন্ধ করার সুপারিশ করেছে। আশা করি, হল প্রশাসন কঠোর অবস্থানে থাকলে অ-ছাত্রদের প্রবেশ ঠেকানো অসম্ভব হবে না।'

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, 'সাবেক ছাত্ররা যাতে কোনোভাবে হলে থাকতে না পারে, সে বিষয়ে এবার আমাদের অবস্থান খুবই কঠোর। আশা করি, কোভিড পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা অসহযোগিতামূলক আচরণ করবে না।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, 'প্রভোস্ট কমিটি যে নিয়মনীতি নির্ধারণ করেছে, সেটি অনুসরণ করেই হলে শিক্ষার্থীরা উঠবে। আশা করি, সবাই তা মেনে চলবে।'

হলে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের যেসব নির্দেশিকা মানতে হবে

আবাসিক হলে সব শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে নিয়মিত ও সার্বক্ষণিক মাস্ক পরতে হবে, নিয়মিত হাত ধুতে হবে, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে এবং কোনো কক্ষের মেঝেতে শোয়া যাবে না বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কেবল আবাসিক ও দ্বৈতাবাসিক শিক্ষার্থীরা হলে অবস্থান করতে পারবেন। কোনো বহিরাগত বা বাইরে থেকে আসা কাউকে কক্ষে অবস্থান করতে দেওয়া যাবে না। শিক্ষার্থীদের কক্ষ এবং এর আশপাশ সবসময় নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে হল প্রশাসন সহযোগিতা করবে।

হল, ডাইনিং, ক্যান্টিন, দোকান, সেলুন, রিডিংরুম, অডিটোরিয়াম, টিভিরুম, অতিথি কক্ষ, পাঠাগার, মসজিদ ও উপাসনালয়ে ভিড় করা যাবে না। এসব জায়গায় সামাজিক দূরত্ব মেনে মাস্ক পরতে হবে।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অতিথি কক্ষে শিক্ষার্থীদের সমাবেশ বন্ধ রাখতে হবে।

দলবেঁধে বা একা ঘুরতে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সভা-সমাবেশ, রেস্তোরাঁ, পার্টি ও গণপরিবহনে চড়া এড়িয়ে চলতে হবে।

জ্বর, সর্দি-কাশি কিংবা কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কোনো উপসর্গ দেখা দিলে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করা যাবে না।

Comments

The Daily Star  | English

Transport strike in Ctg: Passengers suffer amid heatwave

Sidratul Muntaha, a student, went to the port city's Natunpara bus stand area this morning in order to catch a bus to Chawkbazar, where she was scheduled to attend class at a coaching centre

24m ago