চবিতে নিয়োগ-বাণিজ্যের ফোনালাপ: ৯ দিনেও শুরু হয়নি তদন্ত

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগে অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর গত ৫ মার্চ উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার ঘটনাটি তদন্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ৩ কর্মদিবসে অভিযুক্তদের লিখিত জবাব পাওয়ার পর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর পর ৯ দিন পেরিয়ে গেলেও কাজ শুরুই করতে পারেনি এই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে অর্থ লেনদেন নিয়ে ৫ ফোনালাপ ফাঁস হয় গত জানুয়ারি মাসে। এসব ফোনালাপ ছিল উপাচার্য শিরীণ আখতারের ব্যক্তিগত সহকারী খালেদ মিছবাহুল রবীন ও হিসাব নিয়ামক দপ্তরের কর্মচারী আহমদ হোসেনের সঙ্গে দুজন নিয়োগ প্রার্থীর। ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার মাসখানেক পর বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম মাইনুল হক মিয়াজীকে প্রধান করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় গত ৯ জানুয়ারি হাটহাজারী থানায় সাধারণ ডা‍য়েরি করা হয়েছে। উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী রবীনকে সরিয়ে অন্য জায়গায় পদায়ন করা হয়েছে। তার সঙ্গে আহমদকে ৩ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের লিখিত বক্তব্য জানাতে বলা হয়েছে।

এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় চবিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৩ জন শিক্ষক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, মূল হোতাদের আড়াল করতে ও উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী রবীনকে বাঁচাতেই তদন্তের নামে সময় ক্ষেপণ করা হচ্ছে।

কেন কাজ শুরু করতে পারেননি জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান মাইনুল হক মিয়াজী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন 'এখনো আমাকে চিঠিই পাঠানো হয়নি, কীভাবে কাজ শুরু করব? কোন বিষয়ে তদন্ত করব? পত্রিকায় দেখলাম, আমাকে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে। চিঠি পেলে কাজ শুরু করব।'

এখনো কেন চিঠি দেওয়া হয়নি জানতে চাইলে চবির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন 'চিঠি কেন ইস্যু করা হলো না সেটা আমি জিজ্ঞেস করব। আমি নিজেও তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব। চিকিৎসার প্রয়োজনে গত পরশু উপাচার্য ভারতে গিয়েছেন। উনি এলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।'

অন্যদিকে, অভিযুক্ত দুজনের লিখিত জবাব পাবার কথা জানিয়েছেন রেজিস্ট্রার। তবে সেটিও প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া ৩ কার্যদিবস পেরিয়ে যাওয়ার পর।

'উনারা লিখিত জবাব দিয়েছেন। উপাচার্য আসলে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। রবীন ছুটিতে থাকায় লিখিত ব্যাখ্যা নির্দিষ্ট সময় পরে দিয়েছেন,' বলেন এস এম মনিরুল হাসান।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, অভিযোগ ওঠার পর উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী রবীনকে তার আগের কর্মস্থল পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে বহাল রাখা হয়েছে।

জিডির বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্ন

হাটহাজারী থানায় চবির জিডির একটি কপি দ্য ডেইলি স্টারের কাছে এসেছে। রবীন এবং আহমদের সঙ্গে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রভাষক পদে এক আবেদনকারীর ফোনালাপে অর্থ লেনদেনের ইঙ্গিত থাকলেও সেই কথা জিডিতে উল্লেখ করা হয়নি। সাধারণ ডায়েরিতে শুধুমাত্র আহমদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। রবীনের নাম উল্লেখ না করার বিষয়টিও অনেককে বিস্মিত করেছে।

সাধারণ ডায়েরিতে বলা হয়েছে, আহমদ মানহানিকর ও মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। সে অনুযায়ী জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাটহাজারী পুলিশের এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন 'এটি একটি দুর্নীতির ঘটনা। উনারা (প্রশাসন) সাধারণ ডায়েরিতে দুর্নীতির কোনো কথাই উল্লেখ করেননি, করেছেন অপমান এবং মানহানির কথা। এটি দুর্নীতির ইস্যু এটা দুদকের বিষয়। উনারাই এটি ভালো তদন্ত করতে পারবেন।'

তবে হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন 'আমরা জিডির বিষয়টি তদন্ত করছি। এখানে তদন্তের অনেকগুলো ধাপ আছে। আদালতের নির্দেশে কণ্ঠ পরীক্ষার বিষয় আছে। আমরা ধাপে ধাপে সব করব।'

দুদকের চট্টগ্রামের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর উপ পরিচালক নাজমুস সাদাত দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের যা কিছু হয় সব সদর দপ্তরের নির্দেশেই করা হয়। চবি প্রশাসন যদি কিছু চেয়ে থাকেন তবে বিষয়টি সদর দপ্তরই ভালো বলতে পারবেন।'

ফাঁস হওয়া ফোনালাপে যা ছিল

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ফোনালাপে আহমদ হোসেন ফারসি বিভাগে শিক্ষক পদে নিয়োগ পেতে আগ্রহী প্রার্থীকে বলেন, 'তৃতীয় শ্রেণির একটা চাকরির জন্য এখন ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা লাগে। চতুর্থ শ্রেণির চাকরির জন্য লাগে ৮ লাখ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলো সর্বোচ্চ সম্মানিত পদ। এখানে ১৬ লাখের কম দিলে হবে না।'

আহমদ হোসেন আরও বলেন, 'ম্যাডাম (উপাচার্য) যদি রাজি হন, তাহলে আপনি অর্ধেক পেমেন্ট করবেন এবং পেমেন্ট যে করছেন সেটার একটা চেক অথবা ডকুমেন্ট দিতে হবে। কিন্তু ম্যাডাম যদি "না" বলেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীও যদি ব্যক্তিগতভাবে সুপারিশ করেন, কোনো কাজ হবে না। এটাই শেষ কথা। কারণ, ম্যাডাম নিজেও তো আসছেন অনেক টাকা খরচ করে। এখন আপনার যদি সম্মতি থাকে এবং ম্যাডাম যদি রাজি হন, তাহলে একটা কন্ট্রাক্ট (চুক্তি) করা যায়।'

উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী রবীন নিয়োগপ্রার্থীকে উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনায় বসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, 'তুমি চট্টগ্রামের মানুষ বলেই তোমাকে আমি টান দিলাম। উপাচার্যকে তোমার কথা বলব। তিনি যেভাবে বলবেন, সেভাবে হবে।'

এই ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর উপাচার্য অধ্যাপক শিরীন আখতার বলেছেন তিনি 'বিব্রত' এবং 'ষড়যন্ত্রের শিকার'।

Comments

The Daily Star  | English

India plane crash death toll revised to 240 after 'double-counting'

It’s the first Dreamliner crash since its 2011 commercial debut, says Aviation Safety Network

14h ago