জাবিতে গবেষণার অর্থ বরাদ্দে সমতার নামে ‘বৈষম্য’

শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও, গবেষণায় অর্থ বরাদ্দে সব শিক্ষককে সমান বিবেচনা করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) কর্তৃপক্ষ। 

শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও, গবেষণায় অর্থ বরাদ্দে সব শিক্ষককে সমান বিবেচনা করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) কর্তৃপক্ষ। 

প্রভাষক থেকে অধ্যাপক, সবাইকে একই পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এমনকি তাদের গবেষণার প্রস্তাবটি কেমন বা তারা কোন অনুষদের সেসব বিষয়ও বিবেচনা করা হয় না।

দীর্ঘ দিন ধরে জাবির শিক্ষকরা এই ব্যবস্থাকে অসামঞ্জস্য বলে অভিহিত করে তহবিলের বণ্টনে এ ধরনের নীতির প্রতি তীব্র সমালোচনা করে আসছেন। তারা জানান, বিভিন্ন বিভাগের গবেষণার ক্ষেত্র ও বিষয়বস্তু ভিন্ন। গবেষণার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানসম্পন্ন একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষকও একজন নবীন গবেষকের সমান তহবিল পান, যেটা খুবই হতাশাজনক।

একাধিক শিক্ষক দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, গবেষণার অর্থ বরাদ্দের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্যের নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে, এই কমিটি অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার আগে গবেষণা প্রস্তাবের কোনো ধরনের যাচাইবাছাই করে না বললেই চলে।

সাম্প্রতিক সময়ে কোন গবেষণা প্রস্তাব নাকচ হওয়ার উদাহরণ নেই বলেও জানান তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের একজন শিক্ষক বলেন, 'যখন একজন জ্যেষ্ঠ গবেষক ও একজন নবীন শিক্ষক পুরোপুরি ভিন্ন গবেষণা প্রকল্পের জন্য একই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ পান, তখন বিষয়টি বৈষম্যমূলক হয়ে যায়।'

ওই শিক্ষক আরও বলেন, 'এমন কী এটাও হতে পারে যে একজন প্রভাষকের খুব ভালো একটি গবেষণা প্রস্তাব আছে এবং উপযুক্ত তহবিল পেলে ভালো কাজ করতে পারবেন... এ কারণে গবেষণা প্রস্তাবনা ও বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করা উচিত।'

জাবির ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং ও জিআইএসের পরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ তৌহিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আপনি কখনোই সব শিক্ষকের জন্য গড়ে একই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিতে পারেন না। এটি গবেষণা কাজের মূল্যবোধের পরিপন্থী, কারণ সব ধরনের গবেষণা এক নয়।'

তিনি আরও বলেন, 'গবেষণার গুরুত্ব না বোঝার কারণে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। এই ধরনের অনুশীলন কোনোভাবেই গবেষণার উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে না। গবেষণার উদ্দেশ্য হলো নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি।'

জাবির তহবিল বণ্টনের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগমকে জানানো হলে তিনি বলনে, 'এভাবে গবেষণার জন্য তহবিল দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রতিযোগিতা থাকতে হবে এবং প্রস্তাবের গুরুত্ব অনুযায়ী তহবিল দেওয়া উচিৎ।'

তবে তিনি জানান, ইউজিসি জাবির অর্থ বরাদ্দের প্রক্রিয়ার ব্যাপারে অবগত নয়। তিনি বলেন, 'প্রয়োজন হলে আমরা উপাচার্যকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করব এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেব।'

এ ছাড়া, বেশ কয়েকজন শিক্ষক জানান, তাদেরকে যে পরিমাণ তহবিল দেওয়া হয়, তা অনেকক্ষেত্রেই গবেষণার জন্য যথেষ্ট নয়। তারা গবেষণার জন্য তহবিলের বণ্টন বাড়ানোর দাবি জানান।

অর্থ বরাদ্দ

জাবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এ মামুন দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী। বিশ্বের বড় বড় গবেষণা জার্নালে তার ৪১৭টি প্রকাশনা রয়েছে। বিভিন্ন লেখায় ১৫ হাজার বার তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

তিনি ২০২০-২১ অর্থবছরে গবেষণার জন্য ৭৫ হাজার ৭৮৫ টাকা পেয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নথি অনুযায়ী, ৪ জন প্রভাষকসহ তার বিভাগের বাকি ১৭ জন শিক্ষক তহবিলের আবেদন জানিয়ে একই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ পেয়েছেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিজ্ঞান ও কলা বিভাগের শিক্ষকরাও একই পরিমাণ অর্থ পেয়েছেন। যদিও তাদের গবেষণার ক্ষেত্র পুরোপুরি ভিন্ন।

গত বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট থেকে ৩৮০ জন শিক্ষক সম্মিলিতভাবে ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা তহবিল পেয়েছেন।

বর্তমান অর্থবছরে ৩৮১ জন শিক্ষক তহবিলের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন। এবার প্রত্যেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা করে পাবেন, কারণ বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট জুনে এই খাতের জন্য ৪ কোটি টাকা আলাদা করে রাখে।

নথি অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বছরের বাজেট ছিল ২৬৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। বেশিরভাগ টাকা এসেছে ইউজিসি থেকে। বাকিটা জাবির নিজস্ব তহবিল থেকে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন ছিল। একেক বিভাগের তহবিল একেক রকম ছিল।

যেমন, সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক ৮৯ হাজার ৯৮৭ টাকা পান আর জীববিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষককে ৮১ হাজার ৯২৮ টাকা দেওয়া হয়।

ব্যবসায়িক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষকদের ৮৬ হাজার ৬৯৬ টাকা করে দেওয়া হয়।

এর আগের বছরেও সব শিক্ষকদের জন্য তহবিল এক ছিল, তাদের বিভাগ বা পদ যেটিই হোক না কেনো।

১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি বিভাগ ও ৪টি ইনস্টিটিউট রয়েছে।

একাধিক শিক্ষকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো খোঁজই রাখে না, এই গবেষণাপত্রগুলো আদৌ কোনো আন্তর্জাতিক পিয়ার রিভিউড জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে কি না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলো নিজ নিজ বিভাগের জার্নালেই প্রকাশিত হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সহযোগী অধ্যাপক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যখনই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বার্ষিক বাজেট ঘোষণা করা হয়, সবার নজর গবেষণা খাতের তহবিলের বণ্টনের দিকে থাকে। শিক্ষকরা আশা করেন এই পরিমাণটি প্রতি বছর বাড়বে।'

'নামমাত্র কমিটি'

উপাচার্যের নেতৃত্বে 'গবেষণা তহবিল বণ্টন কমিটি' নামের একটি কমিটি গবেষণা প্রস্তাবের নিরীক্ষণ, প্রার্থী নির্বাচন ও অর্থ বণ্টন পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ার দায়িত্বে রয়েছে।

সব বিভাগের ডিনরা এই কমিটির সদস্য।

কমিটির অন্যতম সদস্য কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোজাম্মেল হক জানান, প্রক্রিয়ার শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি নোটিশ জারি করে, যেখানে শিক্ষকদের গবেষণা প্রস্তাব জমা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।

নোটিশ পাওয়ার পর শিক্ষকরা তাদের প্রস্তাব তৈরি করে তাদের নিজ নিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট ডিনের মাধ্যমে রেজিস্ট্রার অফিসে সেটি জমা দেন।

একবার অনুমোদন পাওয়ার পর প্রতিটি বিভাগের পক্ষ থেকে সেমিনারের আয়োজন করা হয়, যেখানে শিক্ষকরা তাদের প্রস্তাব জম দেন ও উপস্থাপনা করেন। তারপর গবেষণা জমা দেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অর্থ বরাদ্দ দেয়।

সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই কমিটির অস্তিত্ব আছে শুধু নামে। কারণ, গবেষণার প্রস্তাব জমা দিলেই কমিটি সেটা গ্রহণ করে।'

প্রক্রিয়া সম্পর্কে অধ্যাপক মোজাম্মেল বলেন, 'আমরা এখন আর প্রস্তাব পাওয়ার পর কোনো যাচাইবাছাই করি না। জমা দেওয়ার আগে প্রতিটি বিভাগে সেমিনারের আয়োজন করা হয়।'

তিনি কোনো গবেষণা প্রস্তাব নাকচ হওয়ার কোনো নথি দেখাতে পারেননি।

অধ্যাপক মোজাম্মেল বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সব প্রস্তাবকে তাদের সম্ভাব্যতা অনুসারে ৩টি ভিন্ন তালিকাভুক্ত করে সে অনুযায়ী তহবিল বণ্টন করতেন।

মোজাম্মেল জানান, এই প্রক্রিয়া চালু থাকা অবস্থায় কিছু শিক্ষক তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে নিম্নমানের গবেষণা প্রস্তাবকে 'এ' তালিকাভুক্ত করতেন, যার কারণে অন্যান্য গবেষকরা অপমানিত হতেন।

তিনি দাবি করেন, 'এখন যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সমভাবে তহবিলের বণ্টন করছে, সব শিক্ষক সন্তুষ্ট আছেন।'

তবে বিশেষজ্ঞরা এই চর্চার বিরুদ্ধাচরণ করেন।

এ বিষয়ে জাবির উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা এই বিষয়টির দিকে শিগগির নজর দেব।'

তিনি আরও বলেন, 'গবেষণার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা থাকা উচিত।' তবে তিনি এ বিষয়ে আর বিস্তারিত কিছু বলেননি।

(সংক্ষেপিত)

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Faridpur bus-pickup collision: The law violations that led to 13 deaths

Thirteen people died in Faridpur this morning in a head-on collision that would not have happened if operators of the vehicles involved had followed existing laws and rules

2h ago