‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব চলছে’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক চর্চার পরিবেশ দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং সংস্কৃতি কর্মীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি)। ছবি: স্টার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক চর্চার পরিবেশ দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং সংস্কৃতি কর্মীরা।

গত জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে আয়োজিত কাওয়ালি গানের আসরে হামলার ঘটনায় এটি আবারো সামনে আসে। গত ১২ জানুয়ারি অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগেই ছাত্রলীগের কর্মীরা মঞ্চে হামলা, ভাঙচুর ও কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধর করে বলে অভিযোগ করেন আয়োজক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা। কাওয়ালির অনুষ্ঠান পণ্ড হওয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে শুরু হয় সমালোচনা।

কেমন ছিল ঢাবির সংস্কৃতি চর্চা এবং এখন কেমন চলছে, কেনইবা দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে এর পরিধি, এ নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং প্রশাসনের সঙ্গে।

নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক চর্চার বর্তমান অবস্থার বিষয়ে বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে যে ধরনের সাংস্কৃতিক চর্চা ছিল, সে তুলনায় এখন খুবই কম চর্চা হচ্ছে বলে মনে করি। এর প্রধান কারণ ছাত্র সংসদগুলোর কার্যক্রম নেই। ডাকসুর কোনো কার্যক্রম নেই। এগুলোর বাইরেও আগে অনেকগুলো সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল, এখন সেগুলোর অস্তিত্ব নেই। সব মিলিয়ে এখন সাংস্কৃতিক চর্চার বন্ধ্যাত্ব চলছে বলা যায়। আমাদের সময় প্রত্যেকটা হলে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ হতো, সাহিত্য প্রতিযোগিতা হতো। এখন তো এসবের কিছুই নেই।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ও নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

টিএসসি ছেড়েছে অনেক সংগঠন

করোনা পরিস্থিতির কারণে ২ বছর ধরে টিএসসিতে সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধের মতো উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক আইটি সোসাইটি, টুরিস্ট সোসাইটির মতো বিভিন্ন ধরনের সংগঠন গড়ে ‍উঠেছে। এসব সংগঠনগুলোর জন্য যে স্পেস দরকার সেগুলো বরাদ্দ দেওয়ার পর অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মহড়া করবার জায়গা আর খুব বেশি নেই। যার কারণে আগের অনেকগুলো সাংস্কৃতিক সংগঠনকে টিএসসি ছেড়ে দিয়ে বিকল্প জায়গা খুঁজে নিতে হয়েছে। যারা খুঁজে নিতে পারেনি, এ রকম অনেকে মহড়ার জায়গার সংকটে আছে। তারা বিকল্প ব্যবস্থা করতে না পারলে হয়তো সে দলগুলোর অস্তিত্বও নষ্ট হবে।'

তিনি বলেন, 'সংগঠনগুলোর সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রে যেন কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি না হয় এবং প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত পুরনো সংগঠনগুলো সেখানে মহড়া করছিল, তারাও যেন মহড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, সে ব্যাপারে ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা নিলে সবচেয়ে ভালো হয়।'

টিএসসি কেন্দ্রীক সংগঠনগুলো তাদের সাংস্কৃতিক চর্চা একেবারে বাদ না দিলেও বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে উল্লেখ করে আবৃত্তি শিল্পী মাহিদুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার, শিমুল মুস্তফাসহ আরও অনেকগুলো দল টিএসসিতে ভালো পরিবেশ না পাওয়ায় এখন শিল্পকলায় গিয়ে চর্চা শুরু করেছে।'

তিনি বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় এখন আইন-কানুন তৈরি করেছে যে, বহিরাগত যেতে পারবে না। তারা সাবেক শিক্ষার্থীদের বহিরাগত বলে। সাবেক শিক্ষার্থীরা না গেলে আবৃত্তি-নাটক শেখাবে কারা, তারা না গেলে ক্ষতি কার হবে? সেই ক্ষতিটুকু নীরবে হয়ে গেছে।'

সাবেক শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন আমাদের কাজের পরিধি অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের সংখ্যাও কয়েকগুণ বেড়েছে। যার ফলে অনেক কিছুতেই ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের সংখ্যাও বেড়েছে। সেই অনুপাতে সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি। আমাদের জায়গার সংকট আছে। সে কারণে প্রধানমন্ত্রী টিএসসিকে যুগোপযোগী করে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাগুলোর সম্প্রসারণ ঘটানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। এ কারণে আমাদের একটি আধুনিক টিএসসি নির্মাণের প্রয়াস রয়েছে।'

সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব রয়েছে ছাত্রসংগঠনগুলোর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (জিএস) জুলিয়াস সিজার তালুকদার ছাত্রসংগঠনগুলোর সাংস্কৃতিক চর্চার বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমানে বেশিরভাগ ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সাংস্কৃতিক চর্চা খুব একটা দেখা যায় না। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট কিছুটা চর্চা করে। সেটাও খুব সীমিত পরিসরে।'

তবে কোনো সংগঠনের কর্মীদের মধ্যেই নিয়মিত প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা নেই বলেও জানান তিনি।

সিজার আরও বলেন, 'এখনকার সাংস্কৃতিক চর্চাটা অনেকটা করপোরেট স্টাইলে চলে গেছে। প্রোগ্রামের আয়োজন যেই করুক, বিভিন্ন দলকে ভাড়া করে আনা হয়। তারা এসে পারফর্ম করে যায়, নিজেদের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না।

প্রায় ৩ দশক ধরে নিষ্ক্রিয় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এককভাবে আধিপত্য করেছে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনগুলো। বিশেষ করে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একচেটিয়াভাবে আধিপত্য বিস্তার করে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের সংস্কৃতি বিষয়ক একটি শাখা থাকলেও তাদের কোনো সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চোখে পড়ে না সাধারণ শিক্ষার্থীদের। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্র নেই বলেও জানিয়েছেন অনেকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মেহেদী হাসান সানি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রত্যেকটা হলে আমাদের একটা করে টিম আছে। তারা বিক্ষিপ্তভাবে প্রাকটিস করে। সত্যি করে বলতে গেলে এতদিন নির্দিষ্ট প্লাটফর্ম না থাকায় গোছানোভাবে কিছু করা হয়নি।'

ছাত্রলীগ কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে না এই অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, 'আমি সাংস্কৃতিক সম্পাদক হওয়ার পর শাহবাগে ১৫ দিনব্যাপী 'মুজিব মানেই স্বাধীনতা' শীর্ষক একটি কালচারাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। এর বাইরে করোনার কারণে খুব একটা কিছু করা হয়নি। এ ছাড়া আমাদের দেশব্যাপী ট্যালেন্ট হান্ট করার একটা পরিকল্পনা আছে।'

ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক চর্চা অনেকটা কনসার্ট আয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক চর্চার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি আর সাদ্দাম ভাই মিলে ক্যাম্পাসে সবচেয়ে বেশি কনসার্টের আয়োজন করেছি। টিএসসিভিত্তিক যে সংগঠনগুলো আছে তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনার সময় আমাদের কাছে যে সহায়তা চেয়েছে আমরা দিয়েছি।'

সাংস্কৃতিক চর্চা শুধু কি কনসার্ট আয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ, জানতে চাইলে সঞ্জিত বলেন, 'এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট হয়, ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় সবই তো ছাত্রলীগ করে। প্রত্যেক হলে ডিবেটিং ক্লাব আছে, ক্লাবগুলোতে ছাত্রলীগের কর্মীরা জড়িত।'

ছাত্রলীগ কী ধরনের সাংস্কৃতিক চর্চা করে থাকে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাহিত্য সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক আসিফ তালুকদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা যাতে থাকে সে চেষ্টা করে থাকি। ছোট-বড় বিভিন্ন প্রোগ্রাম আয়োজনের চেষ্টা করি। মাতৃভূমি সাংস্কৃতিক সংসদ নামে আমাদের একটি সাংস্কৃতিক শাখা রয়েছে। সংগঠনটির উদ্যোগে আমরা গত মার্চে মাসব্যাপী অনুষ্ঠান করেছি। আবৃত্তি, গান, নৃত্য, একক সংগীত, দলীয় সংগীত নানা ধরনের আয়োজন ছিল।'

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস ও আবৃত্তি শিল্পী মাহিদুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অনার্স শেষ বর্ষের এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের কোনো ধরনের কার্যক্রম নেই। ছাত্রলীগ বা অন্যান্য যে বাম সংগঠনগুলো আছে, তাদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চোখে পড়েনি। এ ছাড়া ছাত্র ইউনিয়নের বেশির ভাগ অনুষ্ঠান খুব সীমিত পরিসরে হয়ে থাকে।

বর্তমানে টিএসসির অধীনে ২৮টি সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে। এগুলো মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি, ফিল্ম সোসাইটি, আইটি সোসাইটি, টুরিস্ট সোসাইটি, ফটোগ্রাফি সংগঠন, সাংবাদিক সমিতি, বাঁধন, রোভার স্কাউট ও জয়ধ্বনি সাংস্কৃতিক সংগঠন অন্যতম। তবে সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর সেখানে কোনো অফিস নেই।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রর (টিএসসি) পরিচালক সৈয়দ আলী আকবর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টিএসসিতে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর নিজস্ব কোনো অফিস নেই। তারা এখানকার বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে থাকে। তাদের পার্টির অফিসগুলোই তাদের সাংস্কৃতিক সংগঠনের অফিস। তাদের কর্মকাণ্ড টিএসসি কেন্দ্রীক হলে তারা সব দখল করবে। তখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোনো সুযোগ পাবে না।'

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের সাংস্কৃতিক চর্চার বিষয়ে জানতে সংগঠনটির সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামলকে ফোন করা হলে তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

সংগঠনের সাংস্কৃতিক চর্চার বিষয়ে ছাত্র ফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টিএসসি কেন্দ্রীক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন দখল করে নিয়েছে। এক ধরনের দখলদারিত্ব, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, আগ্রাসনের মধ্যে পড়ে সাংস্কৃতিক চর্চা অনেকটা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি আমাদের মতো বামপন্থী সংগঠনগুলোর প্রস্তুতি ও উদ্যোগের মধ্যে ঘাটতি আছে বলেও আমি মনে করি।'

তিনি আরও বলেন, 'বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনে প্রশাসনের অনুমোদন না দেওয়া, আমাদের প্র্যাকটিসের জায়গাগুলো দখল করে নেওয়া, বন্ধ করে দেওয়া বা অন্যান্য আয়োজন দিয়ে সেই জায়গাগুলো ভরিয়ে ফেলা হচ্ছে। সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন যতটুকু যা করছে লোক দেখানো এবং সেখান থেকে বাণিজ্যিক সুবিধা লাভ করছে। কিন্তু ছাত্রদের সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য তারা কিছু করে না।'

ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ তার সংগঠনের সাংস্কৃতিক চর্চার বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি মনে করি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যেভাবে সবার কার্যক্রম থাকার কথা ছিল সেইভাবে কার্যক্রম নেই। আমি শুধু ছাত্র ইউনিয়নের দায়ভারটা নিচ্ছি। ওইভাবে আমরা করতে পারছি না, এটা সত্য। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যারা করে থাকে, যেমন সাংস্কৃতিক জোট। যাদের সংস্কৃতির ধারক-বাহক বলা হয়ে থাকে তারা তো সরকারি লেজুড়বৃত্তির বাইরে কিছু করছে না। এর ফলে সাংস্কৃতিক অঙ্গন পিছিয়ে যাচ্ছে। ফলে মৌলবাদী শক্তি এই জায়গাটা নিচ্ছে।'

'ভয়-ভীতি ও নীপিড়নমূলক পরিবেশে সাংস্কৃতিক চর্চা বন্ধ্যাত্বের মধ্যে পড়ে যায়'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংস্কৃতিক চর্চার অতীত ও বর্তমান অবস্থার বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, যখন শিক্ষকতা করেছি তখন দেখেছি যে, সব চাইতে নিরাপদ জায়গা হলো বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে কোনো রকম সংঘাত হতো না। সেখানে পারস্পরিক সহমর্মিতা থাকতো এবং সর্বোপরি একটা কালচারাল লাইফ থাকতো। সেখানে মানুষ ডিবেট করতো, নাটক করতো, সেখানে গান-বাজনা করতো, ম্যাগাজিন বের হতো। এগুলো এখন খুব একটা নাই।'

সাংস্কৃতিক চর্চা হ্রাস পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, 'যখন সামরিক শাসন ছিল তখন ও ছাত্রদের ইউনিয়ন ছিল। এরপর ১৯৯১ সাল থেকে গণতান্ত্রিক সরকার আসার পর কোনো সরকার চায় না ছাত্রদের অ্যাক্টিভিটিস থাকুক। তারা মনে করে এতে শিক্ষার্থীদের ভয়েসটা সরকারের বিপক্ষে যাবে। ছাত্র প্রতিনিধিরা সরকারের পক্ষের হবে না। ওই ভয়ে কোনো সরকার চায় না তাদের ভয়েস থাকুক। তাদের দমন করে রাখে। এরপর সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনগুলো সেখানে কর্তৃত্ব করে।'

রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর সাংস্কৃতিক চর্চার বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারি সংগঠনগুলো সাংস্কৃতিক চর্চার কোনো গুরুত্ব অনুভব করে না। তারা সরকারের পেটোয়া বাহিনী, লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে টেন্ডারবাজি করে কিংবা তাদের যে বড় ভাই, বস, মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অর্থবিত্ত কামায় করে। সাংস্কৃতিক চর্চার কোনো আগ্রহ বা প্রয়োজন তারা বোধ করো না। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলো, যেমন- বাম সংগঠনগুলো চেষ্টা করে কিন্তু সব সময় তাদের একটা ভয়-ভীতি, আক্রমণ, বিভিন্ন ধরনের বাধা-বিঘ্ন এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও নানা রকম বাধা-বিঘ্নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।'

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের সময় স্বাধীনভাবে অনেক গানের সংগঠন, নাটকের সংগঠন, পাঠচক্র বা লাইব্রেরি আন্দোলন ছিল। এখন যারা হলে থাকে, তাদের পক্ষে সরকারি সংগঠনের এজেন্ডার বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে কিছু চিন্তা করার সুযোগ দেওয়া হয় না। প্রথম বর্ষ থেকে তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ শুরু হয়। প্রথম থেকে এমন একটি ভয়-ভীতির পরিবেশ তৈরি করা হয়, যাতে তারা নিজেরা কোনো উদ্যোগ নিতেই দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। এই ধরনের ভয়-ভীতি ও নিপীড়নমূলক পরিবেশে সাংস্কৃতিক চর্চা বন্ধ্যাত্বের মধ্যে পড়ে যায়। একটি জাতি সৃজনশীলতার চর্চা না করলে কীভাবে বিকশিত হবে?'

Comments

The Daily Star  | English

Create right conditions for Rohingya repatriation: G7

Foreign ministers from the Group of Seven (G7) countries have stressed the need to create conditions for the voluntary, safe, dignified, and sustainable return of all Rohingya refugees and displaced persons to Myanmar

7h ago