দেশে গত বছর ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

মানসিক স্বাস্থ্যে গুরুত্ব বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

পারিবারিক সমস্যা, হতাশা, সম্পর্ক নিয়ে জটিলতা, আর্থিক সমস্যাসহ বেশ কয়েকটি কারণে গত বছর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।

তাদের মধ্যে ৬২ জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ৬৫ জন পুরুষ এবং ৩৬ জন নারী শিক্ষার্থী।

সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে। সংগঠনটি ২০১৯ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করছে।

দেশের প্রায় অর্ধশতাধিক জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার তথ্য যাচাই করে আঁচল ফাউন্ডেশন এ চিত্র পেয়েছে।

গত বছর সর্বোচ্চ ৯ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এ ছাড়া, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ জন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।

বয়সভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে ২২-২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে ৬০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ১৮-২১ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৭ জন, ২৬-২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ১০ জন এবং ২৯ উর্ধ্ব ৪ জন আত্মহত্যা করেছেন। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা।

আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় দেখা গেছে, সম্পর্কগত সমস্যার কারণে ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। পারিবারিক সমস্যার কারণে ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।

পড়াশোনা সংক্রান্ত কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর্থিক সমস্যার কারণে ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ, মাদকাসক্ত হয়ে ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে আত্মহত্যা করেছেন ২১ দশমিক ৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী।

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, 'অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে না পারা আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।'

তিনি বলেন, 'আত্মহত্যার কারণগুলো বাইরে থেকে যতটা দেখা যাচ্ছে, সমস্যা তার চেয়েও গভীর। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রয়োজনীয় শিক্ষার সুযোগ অপর্যাপ্ত বিধায়, তাদের জীবনে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে তারা সেটা সামলাতে পারেন না। প্রেমে বিচ্ছেদ হলে তারা যেমন ভেঙে পড়ে, তেমনি পরীক্ষায় খারাপ ফলাফলও তাদেরকে আশাহত করে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা যদি তাদেরকে শেখাতে পারি যে, ভালো-মন্দ যাই ঘটুক না কেনো, সেটা জীবনেরই অংশ এবং আত্মবিশ্বাস না হারিয়ে তাদেরকে ধৈর্য্যশীল হতে হবে। ফলপ্রসূতে এই শিক্ষার্থীরা যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারবে। পাশাপাশি সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বাস্তবমুখী কিছু জ্ঞান যেমন—আর্থিক ব্যবস্থাপনা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক দক্ষতা উন্নয়ন ইত্যাদি আত্মহত্যা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।'

দ্রুত সঠিক উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, 'শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এখনই উদ্যোগ নিতে না পারলে পরবর্তীতে আমাদের অনুশোচনা করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় দায়িত্বশীলদের অবদান রাখার সঠিক সময় এখনই।'

মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পারিবারিক জীবনের জটিলতা, চাহিদার সঙ্গে প্রাপ্তির মিল না থাকা, অস্তিরতা, বিষণ্নতা, ব্যক্তিত্বের সমস্যাসহ মানসিক নানা চাপে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। তা ছাড়া, যে কোনো মহামারিতে মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যার বেড়ে যায়।'

তিনি বলেন, 'আত্মহত্যার কয়েকটি লক্ষণ হলো সব সময় মৃত্যুর কথা নানান ছলে বলা, নিজের জিনিসি অন্যকে দান করে দেওয়া, নিজেকে গুটিয়ে রাখা, বিষণ্ন থাকা। এই বিষয়গুলো কারো মধ্যে দেখা দিলে তাকে দ্রুত মানসিক ডাক্তার দেখাতে হবে। তাহলে আত্মহত্যা কিছুটা বন্ধ করা যাবে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'করোনার শুরুতে শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে আমাদের শিক্ষকদের বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল তা নেওয়া হয়নি। করোনায় অনেকের টিউশনি চলে গেছে, আয় বন্ধ হয়ে গেছে, বাধ্য হয়ে অনেককে দীর্ঘ সময় বাড়িতে থাকতে হয়েছে। তাদের ওপর পরিবারের একধরনের প্রত্যাশা ছিল। বাড়িতে থাকার কারণে অনেকবার হয়তো বা প্রত্যাশার কথা শুনতে হয়েছে। সামাজিক জীবন বিঘ্নিত হয়েছে, অনেকের সম্পর্ক ভেঙে গেছে। চাকরির পরীক্ষা তেমনভাবে হচ্ছে না। বেকারত্ব বেড়েছে। সব মিলিয়ে তাদের মধ্যে হতাশার সঞ্চার হয়েছে, অস্থিরতা বেড়েছে। এ কারণে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে।'

তিনি বলেন, 'এ ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। বিভাগে এবং আবাসিক হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক অনীহা আছে। এই জায়গায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আক্তারুজ্জামান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। তাদের আত্মহত্যার কারণগুলো সবার আগে খুঁজে বের করতে হবে। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে এটি নিয়ে কাজ করতে হবে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জীবন রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh tops sea arrivals to Italy

The number of Bangladeshis crossing the perilous Mediterranean Sea to reach Italy has doubled in the first two months this year in comparison with the same period last year.

6h ago