পর্যাপ্ত বাজেট নেই, নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত সরকারি স্কুল
কোনো বেসরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীর পক্ষে এটা বোঝা মোটেই সম্ভব নয় যে, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের কুর্নী জালাল উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ঝুমা আক্তারকে ঠিক কী ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। ঝুমা ডাক্তার হতে চায়। অথচ, তার স্কুলে জীববিজ্ঞানের ল্যাবরেটরি নেই।
প্রতি বছর আমাদের শিক্ষা খাতের বাজেট কমছে। আর সেই সঙ্গে সরকারি অনুদানে চলা স্কুলগুলোতে বেড়ে চলেছে অব্যবস্থাপনা।
২০২১-২০২২ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বাজেট বরাদ্দ ছিল ৭১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেটের ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। এর মধ্য থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য যথাক্রমে ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা, ২৬ হাজার ৩১১ কোটি টাকা এবং ৯ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
শিক্ষার জন্য এবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জিডিপির মাত্র ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। অর্থাৎ আগের বছরের চেয়েও অনেক কম। অথচ, করোনা মহামারির কারণে দেশের শিক্ষা খাতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
আমরা ইউনেস্কো নির্ধারিত শিক্ষায় সরকারি ব্যয় থেকেই কেবল দূরে নই, অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশের তুলনায়ও পিছিয়ে আছি। ২০১৫ সালে ইউনেস্কো শিক্ষার জন্য গড় সরকারি ব্যয় জিডিপির ৪ থেকে ৬ শতাংশ বা মোট বাজেটের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করে। ইউনিসেফের ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষাখাতে বাংলাদেশ এই অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে কম ব্যয় করে, যেখানে ভুটান, নেপাল ও আফগানিস্তানের মতো দেশ যথাক্রমে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, ৫ দশমিক ২ শতাংশ ও ৪ দশমিক ১ শতাংশ ব্যয় করছে।
শিক্ষায় কম বাজেট বরাদ্দ দেওয়ার মূল কারণ হিসেবে প্রায়শই সম্পদের অপ্রতুলতাকে দায়ী করা হয়। এটা পুরোপুরি সত্য নয়।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের (ক্যাম্প) ভাইস চেয়ারপার্সন ও উপদেষ্টা ড. মনজুর আহমেদ বলেন, 'একটি নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের সম্পদের অভাব রয়েছে। তবে, যা আছে সেখান থেকেও আমরা বাজেটের একটি বড় অংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করতে পারি। আমাদের চেয়েও কম সম্পদ যাদের আছে তারা যদি শিক্ষায় বেশি বরাদ্দ দিতে পারে তাহলে আমরা কেন পারব না? তখন এখানে প্রশ্ন আছে অগ্রাধিকারের।'
শুধু কম বাজেটই আমাদের সরকারি স্কুলগুলোর এত চ্যালেঞ্জের একমাত্র কারণ নয়। ড. আহমেদ বলেন, 'শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি পরিকল্পনা দেওয়ার কথাঅ সেখানে তাদের তুলে ধরার কথা বাজেট কোথায় এবং কীভাবে ব্যয় করা হবে। সেই পরিকল্পনা ও প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাজেট বরাদ্দ দেওয়ার কথা ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু আমরা পরিকল্পনা পর্যায়েই ব্যর্থ হই।'
পরিকল্পনা ও যথাযথ বাস্তবায়নের অভাব বছরের ব্যয়ের হারে স্পষ্টভাবেই উঠে আসে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বরাদ্দকৃত বাজেটের প্রায় ৯০ শতাংশ প্রতি বছর ব্যবহার করা হলেও বছরজুড়ে তা পদ্ধতিগতভাবে করা হয় না। একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট ব্যয়ের অর্ধেক শেষ ত্রৈমাসিকে সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় জুন মাসে।
এই পরিস্থিতির বিষয়ে ২০১৮ সালে দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্যাম্পের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, 'আমাদের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩টি প্রধান দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত, শিক্ষকদের গুণগত মান। প্রতি বছর হাজারো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় এবং কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ক্লাস নিতে।'
প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের কম বেতনের বিষয়টিও শ্রেণীকক্ষের মান উন্নয়নে অন্তরায় তৈরি করে।
টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল করিম বলেন, 'সরকারি স্কুলে শিক্ষকরা স্কেল অনুযায়ী বেতন বেতন পান। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। যার কারণে প্রায়শই তারা বাড়তি আয়ের জন্য অন্য কোনো কাজও করেন। পদোন্নতি হতে বেশি সময় লাগার কারণে তাদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধিও হয় কম। পদোন্নতি পেলেও খুব যে বেশি বেতন বৃদ্ধি পায় তা নয়। ফলে, অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয় না।'
নেত্রকোণার আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মো. আতোয়ার রহমান বলেন, 'আমরা নিয়মিত বেতন পেলেও অপর্যাপ্ত ফান্ডের কারণে ভ্রমণ ভাতার মতো অতিরিক্ত ভাতাগুলো আর পাই না।'
অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, অপর্যাপ্ত বেতন এবং জবাবদিহিতা না থাকায় তৈরি হয় অদক্ষ শিক্ষক। ফলে এই শিক্ষকদের ভেতরে থাকে না শেখানোর প্রতি যথাযথ অনুপ্রেরণা।
রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষার্থী জোবায়ের বিন জোহা বলেন, 'আমার কিছু শিক্ষক খুবই ভালো। তবে, বেশির ভাগ শিক্ষক ক্লাসে খুব বেশি কিছু বোঝান না। ফলে প্রাইভেট পড়া বা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় থাকে না।'
আমাদের সরকারি স্কুলগুলোর সমস্যার এখানেই শেষ না। সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেই যথাযথ সুযোগ-সুবিধা। কুর্ণী জালাল উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ঝুমা যেমন বলেছে, 'আমাদের স্কুলে কোনো ল্যাব বা কম্পিউটারের সুবিধা নেই। অন্যান্য সরকারি স্কুলের মতো আমাদের স্কুলে টিফিন দেওয়া হয় না।'
২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩০ হওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এটি দেশের বেশিরভাগ সরকারি স্কুলে এখনও কার্যকর করা হয়নি। ২০১৮ সালের ইউনেস্কো ইন্সটিটিউট ফর স্ট্যাটিস্টিকসের তথ্য মতে, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এই অনুপাত ১:৩৫ এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১:৩০। তবে, মাঠ পর্যায়ের চিত্রটা একটি ভিন্ন বলেই মনে হয়, যখন জোবায়ের বা ঝুমার মতো শিক্ষার্থীরা জানান যে তাদের ক্লাসে শিক্ষার্থী ৫০-৬০ জন।
শিক্ষাখাতে সরকারের যে ব্যয়, সেখানে থেকে দেশের সব শিক্ষার্থী শিক্ষা পায় না। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিক স্তরের ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী সরকারি স্কুলে যায়। বাকিরা ব্যক্তি মালিকানাধীন বা এনজিও পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়।
মাধ্যমিক শিক্ষাখাতের অবস্থা আরও খারাপ। বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্সের (ব্যানবেইস) ২০১৮ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানের ৯৮ শতাংশই ব্যক্তি মালিকানাধীন বা পরিচালিত। এর মধ্যে ৮২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের বেতন হিসেবে মাসিক পে-অর্ডার (এমপিও) পায়। শতাংশের হিসাবে এটি বেশ বড় মনে হলেও, স্কুলের মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষকই এই খাত থেকে বেতন পান।
আমাদের সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত স্কুলগুলোর এমন অগণিত সমস্যা দেখার পর এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, যাদের সামর্থ্য আছে তারা বেসরকারি বা বিদেশি কারিকুলামের স্কুলগুলোকেই বেছে নেবে। সরকারি ও বেসরকারি স্কুলেও মধ্যকার এই পার্থক্য দেশের শিক্ষাখাতে তৈরি করছে বৈষম্য।
করোনা মহামারি আঘাত হানার পর পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে মোড় নেয়। শিক্ষার্থীরা কেবল ঝরেই পড়েনি, যারা পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল তারাও নানান সমস্যার মধ্যে পড়েছে। শিক্ষাবর্ষ এগিয়ে গেলেও অনেক শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস করতে না পারার কারণে শিখতে পারেনি।
জোবায়ের তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন, 'আমি অষ্টম শ্রেণিতে উঠে গেলাম। অথচ, অনলাইন ক্লাস করে সপ্তম শ্রেণিতে খুব বেশি কিছু শিখেতেই পারিনি। এখন আমার বুঝতেই সমস্যা হচ্ছে যে ক্লাসে শিক্ষকরা কী শেখানোর চেষ্টা করছেন।'
অপ্রস্তুত শিক্ষার্থীদের পড়াতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন শিক্ষকরাও। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষিকা লুবনা জাহান বলেন, 'আমার তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা মহামারির মাঝামাঝি সময়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। অনলাইনেই তারা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি পাস করেছে। তৃতীয় শ্রেণিতে যখন তাদের শ্রেণীকক্ষে পেলাম তখন দেখছি, তাদের বেশিরভাগই আগের দুটি একাডেমিক বছরের বিষয়গুলো পুরোপুরি বুঝেই উঠতে পারেনি।'
মহামারির কারণে শিক্ষাখাতে যে ক্ষতি হয়েছে ধীরে ধীরে তা কাটিয়ে উঠছে জানিয়ে ড. আহমেদ বলেন, 'বাজেট পরিকল্পনা করার সময় আমাদের প্রথমে একটি মূল্যায়ন এবং প্রতিকারমূলক পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রতিকারমূলক পরিকল্পনাটি করতে হবে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের ঘাটতি কমাতে। দ্বিতীয়ত, কয়েক মাস পড়ার বিষয়বস্তু বাড়াতে হবে, যাতে তারা যে বিষয়গুলো আগে বুঝতে পারেনি সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে। জুন থেকে সেপ্টেম্বরে একাডেমিক বছর স্থানান্তর করে সহজেই এটা করা যেতে পারে।'
আমাদের সরকারি স্কুলগুলোর সমস্যা সমাধান কেবলই বাজেট বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্ভব হবে না। তবে, শিক্ষাখাতে বৈষম্য দূর করতে হলে এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে এখান থেকেই পরিবর্তন শুরু করতে হবে, এখন থেকেই পরিবর্তন শুরু করতে হবে।
Comments