আয় বাড়াতে শত বছর পুরোনো পুকুর ভরাট করছে পৌরসভা

হবিগঞ্জ শহরে ঐতিহ্যবাহী চন্দ্রনাথ পুকুর ভরাট করে বহুতল মার্কেট করার উদ্যোগ নিয়েছে হবিগঞ্জ পৌরসভা। জলাশয়, পুকুর, খাল-বিল ভরাট না করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও শত বছরের পুরোনো পুকুর ভরাট করে মার্কেট তৈরির উদ্যোগ নেওয়ায় জনমনে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
শ্রমিকরা টুকরি দিয়ে পুকুরে বালু ফেলছেন। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

হবিগঞ্জ শহরে ঐতিহ্যবাহী চন্দ্রনাথ পুকুর ভরাট করে বহুতল মার্কেট করার উদ্যোগ নিয়েছে হবিগঞ্জ পৌরসভা। জলাশয়, পুকুর, খাল-বিল ভরাট না করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও শত বছরের পুরোনো পুকুর ভরাট করে মার্কেট তৈরির উদ্যোগ নেওয়ায় জনমনে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

সরেজমিন দেখা যায়, শহরের প্রাণকেন্দ্র টাউন মসজিদ রোড এলাকায়  পুকুর ভরাট শুরু হয়েছে। কয়েকজন শ্রমিক টুকরি দিয়ে বালু ফেলছেন পুকুরে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, গত কয়েকদিন ধরে এ ভরাটের কাজ চলছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার একজন কাপড় ব্যবসায়ী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত বছর ফেব্রুয়ারিতে আতাউর রহমান পৌর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ১ একর আয়তনের চন্দ্রনাথ পুকুরের পাড়ের ১৯ জন দোকান মালিককে নিয়ে বৈঠক করেন। তিনি পুকুরটি ভরাট করে বহুতল মার্কেট করার কথা জানান। পুকুর পাড়ে লিজ পাওয়া দোকান মালিকদের তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মার্কেটে দোকান বরাদ্দ দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।'

'বৈঠকে ব্যবসায়ীরা পুকুর খাল-বিল ভরাট করতে প্রধানমন্ত্রীর নিষেধের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও, মেয়র পৌরসভার উন্নয়নের কথা বলে কৌশলে এড়িয়ে যান। দোকান বরাদ্দের বিষয়ে তারা লিখিত চুক্তি করতে চাইলে মেয়র রাজি হননি,' বলেন তিনি।

ওই ব্যবসায়ী জানান, মেয়র দোকান খালি না করলে রাতে বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হবে বলেও হুমকি দেন। এরপর টাউন মসজিদের কাছে একটি বুলডোজার পাঠানো হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফজলুল হক নামে এক দোকান মালিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দোকানটি সরিয়ে সেখান থেকে পুকুরে বালু ভরাট শুরু করেছে পৌরসভা।

শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী চন্দ্রনাথ পুকুর। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার তোফাজ্জল সোহেল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক সময় এই শহরকে পুকুরের নগরী বলা হতো। শহর ও আশপাশের এলাকায় পুকুরই ছিল পানির উৎস। আবার হয়তো আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে পুকুর, জলাশয়ের পানি ব্যবহারে। যেসব পুকুর, জলাশয় শুকিয়ে গেছে, পানি নষ্ট হয়ে গেছে, দখল–ভরাট হয়ে গেছে সেগুলোকে পুনরায় খনন, সংরক্ষণ এবং কীভাবে পরিশোধন করে ব্যবহার করা যায় সেই চিন্তা করতে হবে। কিছু পুকুর-জলাশয়কে "রিজার্ভ ট্যাঙ্ক" হিসেবে রাখতে হবে এখন থেকেই।'

পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার যখন বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিচ্ছে, নলকূপ থেকে যখন পানি পাওয়া যাচ্ছে না, সেই সময়ে একটি পুকুর ভরাট করে মার্কেট বা বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়াটা এই শহরের জন্য উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।

স্থানীয় ব্যবসায়ী শংকর কুমার অধিকারী জানান, জমিদার গোষ্টবাবুর দালানের (বর্তমানে সমবায় ব্যাংক) পাশে তার পূর্বপুরুষদের নামে চন্দ্রনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েছে। এর পাশেই তাদের নামেই শত বছরের পুরোনো চন্দ্রনাথ পুকুর।

হবিগঞ্জের প্রবীণ সাংবাদিক ও হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মনসুর উদ্দিন ইকবাল ডেইলি স্টারকে জানান, এই পুকুরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছোট বোনের পরিবারের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ৬০ এর দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট বোনের স্বামী সাঈদ হোসেন পরিবার নিয়ে চন্দ্রনাথ পুকুর পাড়ে গোষ্ট বাবুর দালানে থাকতেন। তিনি সে সময় হবিগঞ্জ মহকুমার একজন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।

সে সময় পৌর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু না হওয়ায় টিউবওয়েল ও পুকুরই ছিল দৈনন্দিন ব্যবহারের পানির উৎস। সে সময় চন্দ্রনাথ পুকুরে মাস্টার কোয়ার্টার, মুসলিম কোয়ার্টার ও হাসপাতাল কোয়ার্টারের বাসিন্দারা গোসল করতেন।

এদিকে পুকুর ভরাটের খবর পেয়ে কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল সংগঠনের স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে পুকুরটি পরিদর্শন করেন।

পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'হবিগঞ্জ একসময় পুকুরের শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। গত কয়েক বছর ধরে বেশ কয়েকটি পুকুর ভরাট করে ফেলায় শহরে জলাবদ্ধতা ও ভূগর্ভস্থ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। হবিগঞ্জ পৌরসভার শত বছরের পুরনো এই চন্দ্রনাথ পুকুর ভরাটের উদ্যোগ নিন্দনীয় একই সাথে বেআইনি বটে।'

তিনি বলেন, 'দেশের সব পৌর এলাকার পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাধার পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের আইন ও নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রকল্পে দৃষ্টিনন্দন জনকল্যাণকর উদ্যোগ গ্রহণ করার সুযোগ আছে। এছাড়া এই পুকুরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিবারের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।'

এ অবস্থায় তিনি সংগঠনের পক্ষ থেকে অবিলম্বে পুকুরটির ভরাটের কাজ বন্ধ করে পুনরুদ্ধারের ও যথার্থ সংরক্ষণের দাবি জানান।

মেয়র আতাউর রহমান সেলিম বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন।

জানতে চাইলে পৌর সচিব মো. ফয়েজ আহমেদ পুকুর ভরাটের সত্যতা স্বীকার করেন।

পৌরসভার প্যানেল মেয়র গৌতম কুমার রায় ডেইলি স্টারকে জানান, গত ২-৩ মাস আগে মেয়র আতাউর রহমান সেলিমের সভাপতিত্বে পৌর পরিষদের এক সভায় চন্দ্রনাথ পুকুরটি ভরাট করে বহুতল মার্কেট করার সিদ্ধান্ত হয়।

পুকুর ভরাটে প্রধানমন্ত্রী ও আদালতের নিষেধ আছে। সেক্ষেত্রে শত বছরের পুরোনো এই পুকুর কেন ভরাট করা হবে, প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'সরকার একদিকে বলছে পৌরসভার আয় না বাড়ালে আর্থিক সহযোগিতা করবে না। তাই পৌরসভার আয় বাড়াতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Protesters stage sit-in near Bangabhaban demanding president's resignation

They want Shahabuddin to step down because of his contradictory remarks about Hasina's resignation

48m ago