ক্ষতি

৩ দশকে রাজবাড়ীর ৯ হাজার ৯৬০ হেক্টর জমি নদীগর্ভে

‘ওই যে ধু ধু বালি দেখছেন, ওইখানে ছিল আমাদের বাড়ি’, বলছিলেন আহাদ ব্যাপারী। তার মতো হাজারো মানুষের ঘর-সংসার বিলীন হয়েছে পদ্মায়।
হাজারো মানুষের ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে পদ্মায়। ছবি: সংগৃহীত

'ওই যে ধু ধু বালি দেখছেন, ওইখানে ছিল আমাদের বাড়ি', বলছিলেন আহাদ ব্যাপারী। তার মতো হাজারো মানুষের ঘর-সংসার বিলীন হয়েছে পদ্মায়।

আহাদ এখন থাকেন রাজবাড়ী সদরে। পদ্মার পাড়ে এসেছিলেন ভাঙন পরিস্থিতি দেখতে।

ভাঙন রোধে সম্প্রতি ৩৭৬ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ শুরু করা হলেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। গত ৩ মাসে অনন্ত ১৫টি জায়গায় ভাঙন দেখা দিয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৫ সাল থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ৯ হাজার ৯৬০ হেক্টর জমি। ছবি: সংগৃহীত

পদ্মার এই ভাঙনের জন্য অবৈধ বালু উত্তোলনকে দায়ী করছেন এলাকাবাসী।

আজ মঙ্গলবার সকাল থেকেই আবার শুরু হয়েছে ভয়াবহ ভাঙন। রাজবাড়ীর মিজানপুর ইউনিয়নে চোখের পলকেই তলিয়ে গেছে ২০০ মিটার এলাকা। ঘর হারানো মানুষের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে এলাকাটি।

মিজানপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুধু আমি না, ইউনিয়নের সবাই বলে আসছি অপরিকল্পিত ও অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণেই নদী ভাঙন ত্বরান্বিত হচ্ছে।'

জেলার ৫টি উপজেলার মধ্যে ৪টি পদ্মার পাড় ঘেঁষে। এর মধ্যে রয়েছে পাংশা, কালুখালী, গোয়ালন্দ ও সদর উপজেলা।

গত ৩ দশকের বেশি সময় ধরে পদ্মার তীব্র ভাঙনের মুখে এই জেলা। এরই মধ্যে নদীগর্ভে চলে গেছে কয়েক হাজার হেক্টর জমি, ঘড়-বাড়ি, গাছপালা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মন্দির, মসজিদ, কবরস্থানসহ বিভিন্ন স্থাপনা।

গত ২ মাসে পদ্মার ভাঙনে ১ হাজার মিটারের বেশি এলাকাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সদর উপজেলায় পদ্মা নদী এখন পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে চলে এসেছে। এলাকা ভেদে শহর রক্ষা বাঁধ থেকে নদীর দূরত্ব ৫ থেকে ১০ ফিটের মধ্যে।

যেকোনো মুহূর্তে শহর রক্ষা বেড়িবাঁধটিও নদীগর্ভে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের শফিক মোহাম্মদ আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার জমি ছিল প্রায় ৮০ বিঘা। যে পরিমাণ আবাদ হতো তাতে আমার সংসারে কোনো অভাব ছিল না। গত এক দশকে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি।'

একই গ্রামের মো. কেসমত আলী মণ্ডল বলেন, 'আমার ১০০ বিঘা জমিতে প্রতিদিন অন্তত ১৫-২০ জন শ্রমিক কাজ করতো। আমার সব জমি এখন পদ্মার পেটে। সংসার চালাতে এখন অন্যের বাড়িতে কাজ করি। অর্থের অভাবে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াটাও ঠিক মতো করাতে পারি না।'

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৫ সাল থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ৯ হাজার ৯৬০ হেক্টর জমি। এর মধ্যে সদর থেকে গোয়ালন্দ উপজেলা পর্যন্ত ৮ হাজার হেক্টর, সদর থেকে কালুখালী উপজেলা পর্যন্ত ২৬০ হেক্টর, কালুখালী থেকে পাংশা উপজেলা পর্যন্ত ১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমি রয়েছে।

২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী নদী ভাঙন রোধে ৩টি প্রকল্পে ৫৫০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল আহাদ দ্য ডেইলি স্টারকে  বলেন, 'নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। নদীর পাড় যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তার জন্য জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলে ভাঙন রোধ করা হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'রাজবাড়ী জেলায় ৮৫ কিলোমিটার এলাকায় রয়েছে পদ্মা নদী। সব জায়গা তো নদীর তীর সংরক্ষণ করা সম্ভব না বা প্রয়োজনও নেই। যেসব জায়গা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ সেসব জায়গা চিহ্নিত করে বড় একটি প্রকল্পের প্রস্তাব করেছি। সেই প্রকল্পে পাংশা ও কালুখালী উপজেলায় ১১ কিলোমিটার, সদর উপজেলার চরসিলিমপুর থেকে মহাদেবপুর ৪ কিলোমিটার, গোয়ালন্দ উপজেলার অন্তর মোড় থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার নদী তীর সংরক্ষণ কাজ ধরা আছে।'

আব্দুল আহাদ জানান, তারা ইতোমধ্যেই বোর্ডে একটি নোট পাঠিয়েছেন। সব মিলিয়ে ২০ কিলোমিটার এলাকার কাজ স্থায়ীভাবে সিসি ব্লক দিয়ে করার প্রয়োজন আছে কি না, ড্রেজিং কম্পোনেন্ট করার প্রয়োজন আছে কি না এবং ড্রেজিং কম্পোনেন্ট অন্তর্ভুক্ত করলে ঠিক কতটুকু দরকার তার জন্য।

তিনি আরও জানান, বোর্ড থেকে সার্ভের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে কোন এলাকায় স্থায়ী সিসি ব্লক দিয়ে কাজ হবে এবং কোন এলাকায় জিও ব্যাগ ও জিওটিউবের কাজ হবে।

'আপাতত এখন রিপেয়ারিংয়ের কাজ চলছে,' যোগ করেন এই প্রকৌশলী।

জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, গত ২ বছরে রাজবাড়ী জেলায় নদী ভাঙনের কারণে ৮৬০টি পরিবার বসতভিটা হারিয়েছে। তাদের মাঝে ঘর তৈরির জন্য টিন এবং নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাজবাড়ী জেলায় প্রতি বছরই নদী ভাঙে। এ বছর গোদার বাজার এলাকায় ৩টি পয়েন্টে ভাঙনের কারণে শহর রক্ষা বাঁধের কাছে চলে এসেছে নদী। বিশেষজ্ঞ দিয়ে সার্ভে করে সেখানে যেন উপযুক্ত কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় তার জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি।'

ভাঙন রোধে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

US Visa Policy: Some officials in admin, police ill at ease

A section of officials in the administration and police have a feeling of unease over the US visa curbs, but they would not publicly admit it.

4h ago