তপ্ত বাতাসে দোলনচাঁপার সুবাস

রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়ার শামীম সরণিতে ‘শোভালয়’ নামের একটি বাড়ির সামনের অংশে ফুটে থাকা দোলনচাঁপা। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণের প্রথম দিন আজ। মাঝেমধ্যে আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখা গেলেও বৃষ্টির দেখা মিলছেই না। এমন পরিস্থিতিতে প্রখর রোদ আর ভ্যাপসা গরমে জনজীবন যখন অতিষ্ট, তখন ঢাকা নামের এই তপ্ত মহানগরে সুবাস ছড়িয়ে চলেছে বর্ষার ফুল দোলনচাঁপা।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত 'ফুলগুলি যেন কথা' গ্রন্থে নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা লিখেছিলেন, 'ঋতুচক্রের নিয়মেই একদিন গ্রীষ্মের রুদ্ররূপ মেঘের ছায়ায় ঢাকা পড়ে, ঝরে বারিধারা। ...অশ্রান্ত বর্ষণে ঝংকৃত হয় মেঘমল্লার, আর তখনই ফোটে বাদলদিনের প্রথম কদমফুল, সন্ধ্যায় রজনীগন্ধা আর দোলনচাঁপা বাতাসে ছড়ায় অনুপম সৌরভ।'

বরফের মতো সাদা দোলনচাঁপা এমনই এক ফুল, তীব্র সুগন্ধই যার অস্তিত্ব জানান দেয়। বৃষ্টির দেখা না মিললেও, এখনই দোলনচাঁপা ফোটার সময়।

ঢাকার নামী-দামি ফুলের দোকানগুলোতে বাহারি জাতের ও বহু বর্ণের ফুলের দেখা মেলে। একটি-দুটি বাদে এসব ফুলের বেশিরভাগেরই কোনো সৌরভ থাকে না। তবে যে দোকানে দোলনচাঁপা বিক্রি হয়, সেই দোকানসহ আশপাশের বাতাসেও এই ফুলের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

এমনকি ধুলা-দূষণের এই নগরে যানজটে আটকে থাকা অবস্থায় পেট্রল পোড়া গন্ধ ছাপিয়ে ভ্রাম্যমাণ ফুল বিক্রেতার হাতে থাকা দোলনচাঁপার তোড়া থেকেও মাঝেমধ্যে নাকে আসে এর মিষ্টি সুরভি।

খামারবাড়ি মোড় থেকে আগারগাঁওয়ের দিকে যেতে সড়কের ফুটপাতে চলছে দোলনচাঁপার তোড়া বাঁধার কাজ। ভ্রাম্যমাণ ফুল বিক্রেতারা এই তোড়া বিক্রি করেন যানজটে কিংবা সিগনালে আটকে থাকা যাত্রীদের কাছে। পথচলতি মানুষদের অনেকেও এটি কিনে নেন। ছবি: স্টার

ভরা মৌসুমে ঢাকায় শাহবাগের ফুলের বাজার, ধানমন্ডির ২৭ নম্বরের মোড় কিংবা বিজয় সরণি এলাকায় অনেক ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতার হাতে দোলনচাঁপার দেখা মেলে। সাধারণত প্রতি তোড়ায় ১০টি করে ফুলের ডাঁটা থাকে। নগরের অনেক বাসিন্দাই এই ফুলের অনুরক্ত। তাই অনেকে তাদের বসার কিংবা শোবার ঘরটিকে প্রাকৃতিক সুগন্ধে ভরিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়মিত এই ফুল কেনেন।

ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাদের কাছ থেকে দরাদরি করে প্রতি তোড়া ফুল ৬০-৭০ টাকায় কেনা সম্ভব। তবে এখন মৌসুমের শুরুতে দাম খানিকটা বেশি।

সম্প্রতি চন্দ্রিমা উদ্যান সংলগ্ন সড়কটিতে এক ভ্রাম্যমাণ ফুল বিক্রেতাকে প্রতি তোড়া দোলনচাঁপা বিক্রি করতে দেখা গেল দেড় শ টাকায়। ওই বিক্রেতা জানালেন, মৌসুমের শুরুর দিকে এর দাম খানিকটা বেশিই থাকে। পরে আস্তে আস্তে আস্তে দাম কমে আসে।

তবে যদি কেউ দোকান থেকে এই ফুল কিনতে চান, তাহলে এর দাম পড়বে আরও বেশি। দোকানে ও ফুটপাতের ফুল বিক্রেতার হাতে ছাড়াও রমনা উদ্যান ও মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানসহ আগারগাঁওয়ের নার্সারিগুলোতে গাছে ধরা ফুটন্ত দোলনচাঁপা দেখতে পাওয়া সম্ভব।

বিজয় সরণি এলাকার দুজন ভ্রাম্যমাণ ফুল বিক্রেতার কাছ থেকে জানা গেল, সাভারসহ ঢাকার আশপাশে অনেক ফুলচাষি এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দোলনচাঁপার চাষ করেন। ইদানীং বাড়ির ছাদে অনেকে শখ করে দোলনচাঁপার গাছ লাগান। পশ্চিম শেওড়াপাড়ার একটি বাড়ির সামনে লাগানো গাছে ফুটন্ত দোলনচাঁপা দেখে এই কথার সত্যতা মেলে।  

তোড়ায় বাঁধা দোলনচাঁপা। ছবি: স্টার

দোলনচাঁপা সাধারণত সন্ধ্যায় ফোটে। রাতের বেলায় এর সৌরভ আরও বেড়ে যায়। মূলত বর্ষার ফুল হলেও শরতেও এই ফুল ফুটতে দেখা যায়। এটি লাতির আমেরিকার দেশ কিউবার জাতীয় ফুল।

প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক মোকারম হোসেন তার একটি লেখায় জানাচ্ছেন, দোলনচাঁপার আদি আবাস ভারতবর্ষ। এখন এটি পৃথিবীর সকল উষ্ণ ও উপ-উষ্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি ক্যারিবীয় অঞ্চল থেকে শুরু করে গলফ কোস্টেও এদের দেখা মেলে। আবার ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার অল্প ঠাণ্ডা অঞ্চলেও অনায়াসেই জন্মে।

মোকারম হোসেন বলছেন, '(দোলনচাঁপা) ব্রাজিলে প্রথম নেওয়া হয় ক্রীতদাস যুগে; সেখানে ক্রীতদাসরা দোলনচাঁপা গাছের পাতাকে তোষকের মতো ব্যবহার করত। বর্তমানে ব্রাজিলে একে রাক্ষুসে আগাছা হিসেবে অভিহিত করা হয়। হাওয়াই অঞ্চলেও এই উদ্ভিদকে আগাছা গণ্য করা হয়। স্পেনীয় উপনিবেশ আমলে নারীরা এই ফুলের মধ্যে গোপন বার্তা লুকিয়ে আদান-প্রদান করত।'

দোলনচাঁপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, 'যেন দেবকুমারীর শুভ্র হাসি, ফুল হয়ে দোলে ধরায় আসি'।

১৯২৩ সালে প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় রচিত কবিতাগুলো নিয়ে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নামও তিনি রেখেছিলেন 'দোলনচাঁপা'।

আবার 'হৃদয়-আকাশে প্রেমের দোলনচাঁপায়' দোল খাওয়ার বর্ণনা পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের গানেও।

দোলনচাঁপা একটি বহুবর্ষজীবী কন্দজাতীয় উদ্ভিদ। এটি ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পাতা দিয়ে ঢাকা থাকে এর পুষ্পমঞ্জরি। ফুল ফোটার সময় হলে প্রতিটি শাখার মাথায় থোকা থোকা ফুল বের হয়, যা দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মতো। তাই কিউবাতে এই ফুল পরিচিত বাটারফ্লাই জিনজার লিলি নামে।

দোলনচাঁপার বৈজ্ঞানিক নাম Hedychium Coronarium। ইংরেজি নামের মধ্যে হোয়াইট জিনজার লিলিও উল্লেখযোগ্য।

মণিপুরি ভাষায় দোলনচাঁপা হচ্ছে 'তখেল্লৈ অঙৌভা'। 'সোনটাকা' এর মারাঠি নাম। আসামে দোলনচাঁপা পরিচিত 'সুরুলি সুগন্ধি' নামে। সমতল ও পাহাড়—দুই জায়গাতেই ভালো হয় এই ফুল।

দোলনচাঁপা গাছ দেখতে অনেকটা আদা কিংবা হলুদগাছের মতো। ফুল ফোটা শেষ হলে শীতে কন্দ শুকিয়ে যায়। গ্রীষ্মে দুয়েক পশলা বৃষ্টি হলে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে গাছ। সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে না, এমন জায়গায় ভালো জন্মে।

গাছ থেকে কেটে নেওয়ার পর দোলনচাঁপা তাজা থাকে খুব অল্প সময়। পানি ছিটিয়ে কিংবা ফুলের ডাঁটাগুলো পানিতে চুবিয়ে যত্নের সঙ্গে রাখতে হয়। তবে যতক্ষণ ফুলটি টিকে থাকে, মনমাতানো সৌরভে মাতিয়ে রাখে চারপাশ।

Comments

The Daily Star  | English

Had no discussion on ‘humanitarian corridor’ with UN or any entity: Shafiqul

Regarding the reports of involvement of a major power, he said, these are 'pure and unadulterated' propaganda.

1h ago