নদী সুরক্ষায় গণশুনানি

‘নদী রক্ষায় আইন-আদালতের নির্দেশনা কাজে আসছে না’

নদী রক্ষায় আইন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় ও নির্দেশনা কোনো কাজে আসছে না, বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হলেও সেগুলো বাস্তবায়ন হয় না এবং অনেক স্থানে সীমানা চিহ্নিত না থাকায় দখল ও দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সাভারের বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, পরিবেশ ও মানবাধিকার কর্মীরা।
ছবি: স্টার

নদী রক্ষায় আইন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় ও নির্দেশনা কোনো কাজে আসছে না, বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হলেও সেগুলো বাস্তবায়ন হয় না এবং অনেক স্থানে সীমানা চিহ্নিত না থাকায় দখল ও দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সাভারের বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, পরিবেশ ও মানবাধিকার কর্মীরা।

আজ বুধবার সাভার গলফ ক্লাব মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত 'অস্তিত্ব সংকটে সাভারের নদ-নদী: সুরক্ষা ও সংরক্ষণে করণীয়' শীর্ষক দিনব্যাপী গণশুনানিতে বক্তারা এসব কথা বলেন। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)-এর আয়োজনে নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদ সাভার, সাভার নাগরিক কমিটি ও বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দেলনের সহযোগিতায় এ গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। 

অনুষ্ঠানে এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। 

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'পরিবেশ দূষণের কারণে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এখানকার নদীগুলো প্রায় মরে গেছে, খালগুলো চরমভাবে দূষিত, বাতাসও দূষিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই গণশুনানির আয়োজন। মানুষজন তাদের অভিযোগের কথাগুলো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরকে বলবে। তাদেরকে সেই বলার সুযোগটিই আমরা তৈরি করে দিয়েছি। তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ইতোমধ্যেই তুরাগ নদী, ধলেশ্বরী নদী, সাভারের কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের শিল্প দূষণের বিরুদ্ধে যে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি সেগুলো সম্পর্কে তাদের জানিয়েছি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, আইন, আদালত এগুলোর কোন নির্দেশ, কোন বিধান আসলে কাজে লাগছে না। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো দূষণ করেই যাচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে প্রতিপত্তিশালী যারা আছেন তারা দখল এবং দূষণ দুটোই অব্যাহত রেখেছেন। এরকম ক্ষেত্রে আজকের গণশুনানির উদ্দেশ্যে হলো ভুক্তভোগী জনগণের বক্তব্য শুনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করা। 

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, 'আমি খুব সোচ্চার ছিলাম নদী ও খাল দখলের বিরুদ্ধে। ২০১৭ সালে সাভারের নদীরক্ষা কমিটি, নাগরিক কমিটি, ঢাকা জেলার প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা প্রশাসন সবাইকে নিয়ে আমরা দফায় দফায় মিটিং করেছি, সেমিনার করেছি, ওয়ার্কশপ করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। নদীরক্ষা কমিটির দায়িত্ব ছিল টাস্কফোর্সের সঙ্গে সমন্বয় করে খালগুলো দখল এবং দূষণমুক্ত করা। কিন্তু গত চার বছরে কোনো কার্যক্রম আমি দেখিনি। এ জন্য আমি একটু হতাশও ছিলাম এবং নিজেকে একটু গুটিয়েও রেখেছি।'

তিনি আরও বলেন, 'অ্যাকশন প্লান তৈরি করে দেওয়ার পরও কাজ হয়নি। কাজেই শুধু বসে কথা বলে লাভ নেই। টাস্কফোর্স গঠনের পর আমি নৌপরিবহন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আপনার নদীরক্ষা কমিটিকে আমাকে একটু বিস্তারিতভাবে সাভারের কোন কোন নদী, কোন কোন খাল, ম্যাপ অনুযায়ী লোকেশন এবং দূরত্ব জানিয়ে আবেদন করেন। মন্ত্রী নিজে বলেছিলেন, প্রয়োজনে তিনি উপস্থিত থেকে বংশী নদী উদ্ধারের জন্য কাজ করবেন। আর খালগুলো আপনারা নিজেরা করে ফেলবেন। কিন্তু সেই ব্যাপারে আমি কোনো সাড়া পাইনি।' 

সাভারের পৌর মেয়র হাজী আব্দুল গণি বলেন, 'সাভার পৌরসভার প্রতিষ্ঠালগ্নে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোন মাস্টার প্ল্যান ছিল না। আমাদের কোন ডাম্পিং স্টেশন না থাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমরা বেশ সমস্যার মধ্যে রয়েছি। ডাম্পিং স্টেশনের জন্য জায়গা কেনার ক্ষমতাও না থাকায় বিভিন্ন মহলে আমি জমি বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করেছি, কিন্তু এখনো পাইনি। প্রায় ১০ লাখ লোকের বসবাসের সাভার পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি খুবই জটিল ব্যাপার।' 

তিনি বলেন, 'আল মুসলিম গ্রুপকে বর্জ্য যত্রতত্র ফেলায় চিঠি দেওয়া হয়েছে কিন্তু তারা তা মানছে না। এ ক্ষেত্রে সবার সম্মিলিত সহযোগিতা প্রয়োজন। যার যার অবস্থান থেকে পরিবেশকে সুন্দর করতে কাজ করতে হবে। সাভার মডেল মসজিদের পাশে যে বর্জের স্তুপ করা হয়েছে সেটি পৌরসভা করেনি। রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে ড্রেনের কাজ করছে। তারা কাজ করতে গিয়ে ড্রেনের সমস্ত ময়লা আবর্জনা ওইখানে স্তুপ করে রেখেছে। আগামী ১৬ ডিসেম্বরের আগে সেটি সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। আমি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সচেষ্ট ও সতর্ক রয়েছি। সাভারের বংশী নদীটি আজ মৃতপায়। যারা নদী দখল করে আছে তাদের তালিকা করেন। আমি নিজে থেকে তা উচ্ছেদ করে দেব।'

সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম বলেন, 'আমরা ইতিমধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রসহ সকলের সঙ্গে নিয়ে সাভারের কয়েকটি দখল হয়ে যাওয়া খালের কিছুটা হলেও উচ্ছেদ করেছি এবং পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করতে পেরেছি। তবে, খালের চওড়াটা আমরা এখন পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারিনি। আমরা কাতলাপুরের খালটি দখলমুক্ত করার জন্য সেখানে ভরাট করা বালু সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলাম কিন্তু সেটাও বাস্তবায়ন হয়নি। হঠাৎ করে পরিদর্শন করি কিন্তু ফলোআপ এবং মনিটরিং না করায় কাজে সফলতা আসছে না।' 

নদীরক্ষা কমিনের উপপরিচালক আক্তারুজ্জামান তালুকদার বলেন, 'আমাদের আইনের মাধ্যমে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, নদ-নদীর অভিবাবক করা হয়েছে। নদ-নদীগুলো, খাল-বিল ও জলাশয়-জলাধারকে দখল দূষণমুক্ত করার জন্য। তবে, সেটা আমরা একা করতে পারব না। এজন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। আজকে যারা বক্তব্য দিচ্ছেন, আমরা অত্যন্ত খুশি এবং উপকৃত হয়েছি। কারণ আমরা ঢাকায় বসে কিংবা সরেজমিনে অল্প সময়ের জন্য পরিদর্শনে গিয়ে এতকিছু জানতে পারি না।' 

পরিবেশ অধিদপ্তরে ঢাকার জেলার পরিচালক মোসাব্বের হোসেন রাজীব বলেন, 'ট্যানারি বর্জ্য নদীতে ফেলার যে মানমাত্রা সেটা তারা এখনো অর্জন করতে পারেনি। যে কারণে নবায়ন এবং পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান বন্ধ রেখেছি। এ ছাড়া ট্যানারিগুলোর জন্য প্রথমে অবস্থানগত ছাড়পত্র দেওয়া হলেও পরিবেশগত ছাড়পত্র আর দেওয়া হয়নি তাদের পরিবেশের কারণে। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জন্য ট্যানারিতে এখনো কোন কিছু গড়ে উঠেনি। এ ছাড়া আমরা সাভারের বিভিন্ন দখল হয়ে যাওয়া নদ-নদী উদ্ধারে জমজম হাউজিং এবং আল-মুসলিম গ্রুপের বিষয়টিও দেখছি। তবে, আমরা যখন সরেজমিনে নদী দখলকারীদের ধরতে যাই, তখন তারা দাবি করে খালের ভেতর তাদের জমি আছে এবং তারা কাগজপত্রও দেখায়। তাই নদী এবং খালগুলো যদি সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয় তাহলে আমরা সঠিকভাবে কাজ করতো পারব এবং দখলদারদের চিহ্নিত করতে পারব। এ ছাড়া, দূষণ রোধে শিল্প বর্জ্য যাতে নদীতে ফেলতে না পারে এজন্য আমরা অনলাইন মনিটরিং চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।' 

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, সাভার পৌরসভার মেয়র আবদুল গনি, নদী রক্ষা কমিশনের উপপরিচালক আক্তারুজ্জামান তালুকদার, সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম ও অধ্যক্ষ মো. আবু সাঈদ।

 

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago