ধুকছে বুড়িগঙ্গা, আরও করুণ অবস্থায় ধলেশ্বরী

রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকা থেকে ট্যানারি সরিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করার পর ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও বুড়িগঙ্গা নদীর পানির গুণগত মান ধারাবাহিকভাবে কমছে।
রাজধানীর শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গায় দূষণের কারণে সৃষ্ট ফেনার ওপরে ভাসছে নৌকা। নির্বিচারে কারখানা ও গৃহস্থালির বর্জ্য ফেলার কারণে নদীটি কয়েক দশক ধরে দূষণের শিকার। নদী রক্ষায় পাঁচ বছর আগে হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তর করা হয়। তবে সংকট মেটেনি, নদীর স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়েছে। ছবিটি সম্প্রতি তোলা। ছবি: আনিসুর রহমান/ স্টার

রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকা থেকে ট্যানারি সরিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করার পর ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো বুড়িগঙ্গা নদীর পানির গুণগত মান ধারাবাহিকভাবে কমছে।

অপরদিকে, হেমায়েতপুরে ট্যানারি স্থানান্তর হওয়াতে ধলেশ্বরী নদীর পরিস্থিতি আরও অনেক বেশি খারাপ হচ্ছে, কারণ কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত উপকরণের বেশিরভাগ অংশ এই নদীতে ফেলা হচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের একটি যৌথ নিরীক্ষায় এই দুটি নদীর করুণ চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার এই নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

হাইকোর্টের নির্দেশের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের এপ্রিলে ট্যানারিগুলোকে হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হয়।

সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, ট্যানারিগুলো এখন আর বুড়িগঙ্গার কাছে না থাকা সত্ত্বেও কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ও অন্যান্য প্রভাবকের কারণে এর পানির গুণগত মান কমছে।

হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্প নগরী থেকে বর্জ্য উপাদান ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা হয় এবং সেই দূষিত পানির স্রোত পরবর্তীতে বুড়িগঙ্গার সঙ্গে মিশে যায়। ফলে দুটি নদীর পানিই দূষণের শিকার হচ্ছে।

সমীক্ষা প্রতিবেদনের অন্যতম গবেষক এবং জাবির ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক নুরুল ইসলাম জানান, এখনো কয়েক ডজন অতি-ক্ষুদ্র পর্যায়ের কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান হাজারীবাগে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা অব্যাহত রেখেছে।

তিনি জানান, হাজারো যানবাহনের চলাচল, শ্যামপুরে ডাইং কারখানার উপস্থিতি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বুড়িগঙ্গার পানির গুণগত মানের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ট্যানারির বর্জ্যের কারণে ধলেশ্বরীর পরিস্থিতি আরও অনেক বেশি ভয়াবহ, যোগ করেন নুরুল।

বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য এবিএম মাসুদ জানান, ২০১৭ সালে হাজারীবাগে ২১০টি কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ইউনিট ছিল, যার মধ্যে ১৭০টি হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১০টির কার্যক্রম বর্তমানে চালু আছে, যোগ করেন তিনি।

প্রাক-বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী মৌসুমে নিরীক্ষা দল নদী দুটির ৪টি ভিন্ন অবস্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ৬টি নিয়ামকের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণ করে। এই নিয়ামকগুলো হল বায়োলজিকাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি), টোটাল সাসপেন্ডেড সলিড (টিএসএস), কেমিকাল অক্সিজেন ডিমান্ড (সিওডি), অ্যামোনিয়া, তেল ও গ্রিজ, পিএইচ এর মাত্রা এবং ফেনল।

এই নিরীক্ষায় উত্তর আমেরিকায় বহুল প্রচলিত কানাডিয়ান কাউন্সিল অব মিনিস্ট্রিজ অব দ্য এনভায়রনমেন্ট ওয়াটার কোয়ালিটি ইনডেক্স (সিসিএমই) প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে।

সিসিএমই মডেলে পানির গুণগত মান যাচাই করার জন্য সর্বোচ্চ ১০০ পয়েন্ট দেওয়া হয়। শূন্য থেকে ৪০ পর্যন্ত পয়েন্টকে দুর্বল, ৪৫ থেকে ৬৪ কে প্রান্তিক, ৬৫ থেকে ৭৯ কে মোটামুটি ভাল এবং ৮০ থেকে ১০০ কে অসাধারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়

এই ৬টি নিয়ামকের বিবেচনায় ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গা যথাক্রমে ২৭ দশমিক শূন্য ৬ ও ৩৯ দশমিক ৩৯ পয়েন্ট পেয়েছে।

নিরীক্ষা অনুযায়ী, ধলেশ্বরীর প্রাক-বর্ষা নমুনায় বিওডির মাত্রা প্রতি লিটারে ৮০০ মিলিগ্রামে পৌঁছায়, যেটি ট্যানারি এস্টেট থেকে আসা উপকরণের উপস্থিতি নির্দেশ করে। একই সময়ে হাজারীবাগ থেকে সংগৃহীত নমুনায় বিওডির মাত্রা ছিল প্রতি লিটারে ২০০ মিলিগ্রাম, যেটি স্বাভাবিক মাত্রার মানদণ্ডের সঙ্গে মিলে যায়।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ইলিয়াসুর রহমান বাবুল জানান, হেমায়েতপুরের যথেষ্ট পরিমাণ জায়গায় নেই। তিনি আরও জানান, সেখানে ২০০ একর জমি আছে, কিন্তু বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য তাদের আরও দ্বিগুণ জায়গায় প্রয়োজন।

তিনি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্প জোন গড়ে তোলার ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা করেন এবং জানান, পরিবেশ নীতিমালা মেনে চলতে তাদের শুধুমাত্র সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা প্রয়োজন। 

২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর পরিবেশ বিষয়ক সংসদীয় কমিটি আশেপাশের এলাকার পরিবেশের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলার কারণে সাভারের চামড়া শিল্প নগরী পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল জানান, তারা চান না ট্যানারি শিল্প বন্ধ হয়ে যাক।

তিনি বলেন, 'আমাদের যদি নদীগুলোকে বাঁচানোর জন্য সমাধানের প্রয়োজন হয়, তাহলে সবাইকে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা এ বিষয়ে ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চাই।'

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments