‘ভুলবশত’ তুরাগ নদী ভরাট করা হয়েছে
প্রায় ১২ বছর আগে হাইকোর্ট বিভাগ রাজধানীর তুরাগ ও অন্য ৩টি নদী এলাকাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশনা বাস্তবায়িত হওয়ার এখনো অনেক দেরি রয়েছে।
আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, একটি সরকারি সংস্থা আশুলিয়ায় তুরাগের একটি অংশ ভরাট করেছে। তারা দাবি করছে, একটি উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নের সময় 'ভুলবশত' এটি করা হয়েছে।
বন্দর এলাকায় নদীর তত্ত্বাবধানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) মাত্র কয়েক মাস আগে উল্লেখিত ৪ নদীর সীমানা নির্ধারণের কাজ শেষ করেছে।
গত সপ্তাহে তুরাগের তীরে সরেজমিনে পরিদর্শন করে এই সংবাদদাতা দেখতে পান, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ নদী বন্দরের উত্তর পাশ এবং ঢাকা-আশুলিয়া সড়কের সংযোগস্থলে অবস্থিত নদী এলাকা ভরাট করছে।
ঢাকা-আশুলিয়া সড়কের প্রায় ১০০ গজ এলাকা সেতু কর্তৃপক্ষ ভরাট করে দিয়েছে। স্থানীয়রা জানান, প্রায় ১ মাস ধরে সরকারি সংস্থাটি এ কাজ করছে।
বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) কাজী ওয়াকিল নেওয়াজ বলেন, ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ নদী এলাকা ভরাট করার আগে তাদের কাছ থেকে অনুমতি নেয়নি।
'সম্ভবত তারা (সেতু কর্তৃপক্ষ) তাদের প্রকল্পের জন্য এলাকা ব্যবহার করার জন্য আমাদের কাছে আবেদন করবে', বলেন তিনি।
ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক শাহাবুদ্দিন খান বলেন, 'ঠিকাদার আমাদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই নদীর জমি ভরাট করেছে। আমি গতকাল (রোববার) সরেজমিনে এলাকা পরিদর্শন করে ঠিকাদারকে কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছি। জমি প্রয়োজন হলে (প্রকল্পের জন্য) আমরা আবারও কাজ শুরু করার আগে বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে কথা বলবো।'
তিনি জানান, একটি চীনা প্রতিষ্ঠান ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে। 'তারা (ঠিকাদার) সম্ভবত ভুল করে এই এলাকা ভরাট করেছে', যোগ করেন তিনি।
প্রকল্প পরিচালক জানান, তারা এই নদীর জমি ব্যবহার করতে চাননি।
বিআইডব্লিউটিএর আরেক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৮ সালে এই নদী এলাকা দখল করা হয়েছে। কিন্তু তারা সে বছরই তা পুনরুদ্ধার করেন, খনন করেন এবং সীমানা পিলার স্থাপন করেন।
আদালতের রায়
২০০৯ সালের ২৪ জুনের রায়ে হাইকোর্ট বিভাগ সুস্পষ্টভাবে সরকারকে ঢাকার ৪টি নদী—বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু এবং শীতলক্ষ্যার মূল ভূ-খণ্ড চিহ্নিত করার নির্দেশ দেন। এ ছাড়া, নদী অঞ্চলগুলোকে তাদের আসল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এবং দূষণ ও দখল থেকে সুরক্ষিত করারও নির্দেশ দেন আদালত।
তারপরও, সংবিধান অনুযায়ী দেশের নদীগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সরকারের হলেও, এ বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
৪টি নদীর ধারে শুধু সীমানা স্তম্ভ স্থাপন করতেই কর্তৃপক্ষের ১২ বছর সময় লেগেছে। বিআইডব্লিউটিএ এ পর্যন্ত ৪টি নদীর তীরে প্রায় ৩ হাজার ২০০ পিলার স্থাপন করেছে।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আজাজ বলেন, 'কিন্তু তাদের মধ্যে ১ হাজার ৪০০টির বেশি পিলার ভুল জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে, যার অর্থ (এই উদ্যোগে) নদীগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে আরও সংকীর্ণ হয়ে গেছে।'
উল্লেখ্য, আরডিআরসি স্থাপিত পিলারগুলোর ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছে।
২০১৮ সালে আরডিআরসি 'বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর ওপর বসানো সীমানা স্তম্ভের ওপর মাঠ পর্যায়ের সমীক্ষা প্রতিবেদন' প্রকাশ করে।
পিলার স্থাপন ছাড়াও বিআইডব্লিউটিএ এখন তুরাগ বরাবর ওয়াকওয়ে (পায়ে চলার রাস্তা) নির্মাণের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
এর আগে সরকারি সংস্থাটি পর্যায়ক্রমে কাঁচপুর, শ্যামপুর, ধর্মগঞ্জ, রামচন্দ্রপুর ও টঙ্গীতে বুড়িগঙ্গা নদী ও টঙ্গী খালের ধারে ২২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে।
তুরাগ এলাকার সীমানা নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট বিআইডব্লিউটিএর একজন কর্মকর্তা বলেন, 'নদীর ধারে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো নির্মিত হলে কেউ নদীর জমি দখল করতে পারবে না।'
হাইকোর্ট বিভাগ তার আদেশে নদী ভরাট করতে ব্যবহৃত মাটি অপসারণ এবং দখলকারীদের কাছ থেকে উপযুক্ত মূল্য আদায় করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন।
আদালতের আদেশ ও নির্দেশনা বাস্তবায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, রায়ের পর সরকার ৪টি নদী বাঁচাতে কাজ শুরু করেছে।
'১২ বছর বেশ দীর্ঘ সময় কিন্তু সরকার এখনো এ রকম একটি নজিরও স্থাপন করতে পারেনি যে অন্তত একটি নদীকে পুরোপুরি দখলমুক্ত করা হয়েছে', যোগ করেন তিনি।
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments