‘বালুসন্ত্রাসী মুক্ত’ ইলিশের অভয়াশ্রম, সমন্বয় ‘করছে না’ বিআইডব্লিউটিএ

দুপুর সাড়ে ১২টা। চাঁদপুরের ভিআইপি ঘাট থেকে এগিয়ে চলছে জাহাজ। দুপাশে নীল জলরাশি তার মধ্যে খেলা করছে ঢেউ। সঙ্গে মৃদু বাতাস। জাহাজের সামনে উড়ছে গাঙচিল। এ যেন নদী প্রেমী যে কারো মনে সুখের বন্যা বয়ে যাওয়ার মতো মূহুর্ত। গন্তব্য রাজরাজেশ্বর।
মেঘনা নদী পরিদর্শন করছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান। ছবি: জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন

দুপুর সাড়ে ১২টা। চাঁদপুরের ভিআইপি ঘাট থেকে এগিয়ে চলছে জাহাজ। দুপাশে নীল জলরাশি তার মধ্যে খেলা করছে ঢেউ। সঙ্গে মৃদু বাতাস। জাহাজের সামনে উড়ছে গাঙচিল। এ যেন নদী প্রেমী যে কারো মনে সুখের বন্যা বয়ে যাওয়ার মতো মূহুর্ত। গন্তব্য রাজরাজেশ্বর।

রাজরাজেশ্বর চাঁদপুর সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন। তবে বর্তমান এই ইউনিয়নে অধিকাংশ এলাকার কোনো অস্তিত্ব নেই। বিলীন হয়েছে নদীগর্ভে। বাকী এলাকাও নদীতে তলিয়ে যাওয়ার হুমকির মুখে। এই ইউনিয়নের বিলীন হয়ে যাওয়া অঞ্চল ছিল 'বালু সন্ত্রাসীদের' আস্তানা। কিছুদিন আগেও এখানে ছিল কয়েকশ নৌযান যা দিয়ে প্রায় ২৪ ঘণ্টা বালু উত্তোলন করা হতো বলে জানা গেছে।

পূর্বের অবস্থা। ছবি: জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন

তবে গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, পুরো এলাকা একবারেই ফাঁকা। নেই কোনো বাল্কহেড বা ড্রেজার। চোখে পড়ে স্বচ্ছ নীল জলরাশি। আছড়ে পড়ছে ঢেউ। অন্যরকম এক শান্ত পরিবেশ।

ইলিশের অভয়াশ্রমের বর্তমান অবস্থা দেখতে গতকাল বৃহস্পতিবার চাঁদপুরে নদী পরিদর্শনে যায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে কমিশনের অন্যান্য কর্মকর্তারা। সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানে সেলিম খান নামের এক ব্যক্তি বিভিন্ন প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছিলেন। গত ২১ মার্চ এক সভায় আলোচনা করে আমরা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। সভার সিদ্ধান্ত জানার পরেই সেখান থেকে প্রায় ৩০০ নৌযান, বাল্কহেড ও ড্রেজার তাদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়ে গেছে। কেউ কেউ থাকলেও পরবর্তীতে আমাদের সিদ্ধান্তের পর জেলা প্রশাসন সেখানে অভিযান চালিয়ে পুরো এলাকা বালু সন্ত্রাসীদের হাত থেকে মুক্ত করেছে।'

সেলিম খান চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। বর্তমানে তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগেরও সভাপতি।

ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'বালু সন্ত্রাসীরা ইলিশের এই অভয়াশ্রম থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছিলেন। প্রায় ১৯ বছর পর এই অভয়াশ্রম মুক্ত হলো। এটি একটি ব্যাপক সফলতা। বাংলাদেশে নদী রক্ষার এটা বিরাট বিজয়।'

বালু সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বালু সন্ত্রাসীরা দেশ ও জাতির শত্রু। তারা আমাদের জাতীয় সম্পদ নষ্ট করছেন। যারা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করবে, যেখানেই তাদের পাওয়া যাবে, কোনো অপশন নেই সরাসরি জেলে পাঠানো হবে।'

সমন্বয় 'করছে না' বিআইডব্লিউটিএ

চাঁদপুর জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ অভিযোগ করেছেন বিআইডব্লিউটিএ এর কর্মকর্তারা তাকে তেমনভাবে সমন্বয় করছেন না। সেলিম খান নদী থেকে কী পরিমাণ বালু তুলেছে তার কোনো হিসেব দিতে পারছেন না তারা।

পূর্বের অবস্থা। ছবি: জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন

অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, 'বিআইডব্লিউটিএ হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের জন্য সেলিম খানের কাছে ১৬ লাখ টাকা নিয়েছে। হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করে আরও কী পরিমাণ মাটি ও বালু তুলতে হবে, সেই হিসাব আমাকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কী পরিমাণ বালু তোলা হয়েছে, সে তথ্য আমাকে দেওয়া হয়নি।'

গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে এই হাইড্রোগ্রাফিক জরিপকে অবৈধ ঘোষণা করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, 'যারা জনগণের সম্পদ নষ্ট করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। সরকারি কর্মকর্তারাও যদি তাদের দায়িত্বে শৈথল্য দেখান তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের জন্য সেলিম খানের কাছে ১৬ লাখ টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে বিআইডব্লিউটিএ এর পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আমরা জাহাজভাড়াসহ বিভিন্ন খরচ বাবদ তার কাছে এই টাকা নিয়েছি। আমরা তো আর নিজের টাকা দিয়ে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে পারি না। তা ছাড়া এর জন্য সরকারি কোনো বরাদ্দ নেই।'

উচ্চ আদালত টাকা নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন কি না বা কত টাকা নিতে বলেছেন এই সম্পর্কিত কোনো কাগজ চাইলে তিনি তা না দিয়ে বলেন, 'আমাদেরকে খরচ নিতে বলা হয়েছে। আমরা হিসাব করে দেখেছি ১৬ লাখ টাকা আসে।'

সেলিম খান কী পরিমাণ বালু তুলেছে তা কি এই জরিপের মাধ্যমে জানা গেছে এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'আমাদের তেমন ভালো প্রযুক্তি না থাকায় তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না। তবে আমাদের হিসাব অনুযায়ী এখনো সেখানে ২৬ কোটি ঘনফুটের সমপরিমাণ মাটি ও বালু আছে।'

মেঘনা নদীতে যেখানে বালু উত্তোলন করা হতো সেখানকার বর্তমান অবস্থা। ছবি: জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন

জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সমন্বয় না করার অভিযোগের বিষয়টি জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আমরা সব সময় সহযোগিতা করছি। সমন্বয় করে চলছি। জেলা প্রশাসকের অভিযোগ সত্য নয়।'

জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, 'জনস্বার্থে ডুবোচর খনন করা হবে এমন একটি হাইকোর্টর এক রায় দেখিয়ে সেলিম খান সেখান থেকে প্রায় ৫ বছর থেকে বালু উত্তোলন করছে। সেলিম খানের বালু উত্তোলনের অনুমতি থাকলেও বালু বিক্রি করার কোনো অনুমতি নেই। তিনি যা করেছেন তা সম্পূর্ণ অবৈধ। এই বালু উত্তোলন থেকে সরকারের রাজস্বখাতে এক টাকাও জমা হয়নি।'

এদিকে সাইফুল ইসলাম বলেন, 'সেলিম খানের যে অঞ্চল থেকে ৩০ কোটি ঘনফুট মাটি ও বালু উত্তোলন করার কথা সেখানে আসলে নাব্যতার কোনো সমস্যা নেই। সেখানে বালু বা মাটি উত্তোলন করতে হবে না। তাছাড়া সেলিম খান অবৈধ মেশিন ব্যবহার করে বালু উত্তোলন করছেন।'

বালু উত্তোলনে ইলিশ ও বাঁধের ওপর প্রভাব

যথাযথ পদ্ধতি ব্যবহার না করে বালু উত্তোলন করায় তা ইলিশের প্রজনন ও শহর রক্ষা বাঁধের ওপর প্রভাব পড়ছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তায়েফা আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বালু উত্তোলন করার ফলে নদীর পানি ঘোলা থাকে। তাই সূর্যের আলো না পৌঁছাতে পারার কারণে ইলিশের খাবার জুয়োপ্লাংকটন ও ফাইটোপ্লাংকটন উৎপন্ন হয় না। তাছাড়া বালু উত্তোলনে সেখানে উচ্চ শব্দ ও কম্পন হয় যা ইলিশের প্রজননে প্রভাব পড়ে।'

তিনি বলেন, 'সাম্প্রতিক এক গবেষণায় আমরা ইলিশের পেটে ৩৬ শতাংশ বালু ও অন্যান্য বর্জ্য পেয়েছি। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। খাবার না পেয়ে ইলিশ অন্যত্র বিশেষ করে মিয়ানমারে চলে যাচ্ছে। ফলে আমাদের এখানে ইলিশ কম ধরা পড়ছে। তাছাড়া এসব সমস্যার কারণে ইলিশের আকারও তুলনামূলকভাবে ছোটো হয়ে আসছে।'   

জেলা প্রশাসক বলেন, 'পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, যে পদ্ধতিতে বালু তোলা হচ্ছে, তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। এতে নদীর বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। দুই পাড় ভেঙে যাচ্ছে। এমনটি চলতে থাকলে চাঁদপুর শহর শিগগির ঝুঁকিতে পড়বে।'

যেভাবে বালু উত্তোলনের অনুমতি পায় সেলিম খান

সেলিম খান ২০১৫ সালে জেলা প্রশাসনের কাছে ডুবোচর কাটার অনুমতি চান। জেলা প্রশাসন সেই অনুমতি না দিলে তিনি উচ্চ আদালতে রিট করেন। জনস্বার্থে ডুবোচর কেটে নৌপথ সচল করার কথা বলে রিটটি করা হয়েছিল।

সেলিম খানের রিটের উপর ভিত্ত করে ২০১৮ সালে মেঘনার ডুবোচর থেকে ৩০ কোটি ৪৮ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলনের অনুমতি দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।

তবে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে ওই সময় আদালতে বিআইডব্লিউটিএ এর কোনো আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় রিট আবেদন সেলিম খানের পক্ষে যায়।

আদালতে বিআইডব্লিউটিএ এর কোনো আইনজীবী না থাকার কথাটি স্বীকার করেছেন পরিচালক সাইফুল ইসলাম।

জেলা প্রশাসন ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সূত্রে জানান গেছে, বিভিন্ন সময়ে বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়ার কথা জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বেশ কয়েকটি ডিও লেটার দিয়েছেন।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, 'আমরা এমন ১৪টি ডিও লেটারের তথ্য পেয়েছি। এই ডিও লেটারের কারণে তিনি (সেলিম খান) বালু তোলার সুবিধা পান।'

ডিও লেটারের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে টেলিফোনে ডা. দীপু মনির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তিনি ফোন কেটে দেন। পরবর্তীতে পরিচয় ও বিষয় উল্লেখ করে এসএমএস করা হলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।

এ বিষয়ে সেলিম খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

Comments

The Daily Star  | English

First phase of India polls: 40pc voter turnout in first six hours

An estimated voter turnout of 40 percent was recorded in the first six hours of voting today as India began a six-week polling in Lok Sabha elections covering 102 seats across 21 states and union territories, according to figures compiled from electoral offices in states

10m ago