পরিবেশবান্ধব নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে গতি কমছে জুরিখের

সড়ককে নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব করতে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে যান চলাচলে নতুন নিয়ম করেছে কর্তৃপক্ষ। শব্দ দূষণ কমাতে দেশটি জুরিখের মতো আরও কিছু শহরে যানবাহনের গতিতে নিয়ে এসেছে পরিবর্তন। বাড়তি গতি কমিয়ে প্রায় অর্ধেকে নামানো হয়েছে।
শহরের ভেতরে ৫০ কিলোমিটার প্রতিঘণ্টার জোনের বদলে ৩০ কিলোমিটার প্রতিঘণ্টার জোন করা হয়েছে এবং বেশ কিছু এলাকার রাস্তায় রাত ১০টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত বাইরের যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আইন অমান্যে জরিমানার বিধান রয়েছে যথারীতি। জুরিখের সড়কে প্রচলিত এই নতুন নিয়মের নাম 'টেস্পোথার্টি'।
৩০ জোনে এর চেয়ে বেশি গতিতে গাড়ি চালালে গুনতে হবে জরিমানা, হতে পারে জেল। তেমনি এই রাস্তায় ইচ্ছে মতো রাস্তা পার হওয়াও অপরাধ। ৩০ জোনে সাধারণত জেব্রাক্রসিং থাকে না। ২০ জোনে হেঁটে চলাচলকারীদের সবসময় অগ্রাধিকার থাকে। ৩০ জোনে ইচ্ছে করলেই আপনি রাস্তা পার হতে গিয়ে চলন্ত গাড়ি থামিয়ে দিতে পারবেন না। এভাবে রাস্তা পার হওয়া অপরাধ। গাড়িচালকরা এই আইনের ব্যত্যয় ঘটালে রেজার আইনে দণ্ডিত হতে হবে।
শব্দ দূষণ কমিয়ে পরিবেশে ভারসাম্য আনতে যানবাহনের গতি কমানোর নীতি গ্রহণ করছে জুরিখ প্রশাসন। ফলে, জুরিখ সিটি কাউন্সিল শহর জুড়ে প্রতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার গতির ৩০ জোন ব্যাপকভাবে প্রসারিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এটি অনেকের কাছে সমালোচিত। কেননা বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে শহরের গতি বৃদ্ধির চেষ্টা করা হচ্ছে। সমালোচকদের দাবি, এতে জীবনমানের গতিতে ভাটা পড়তে পারে। মানুষ কাজ শেষে দ্রুত ঘরে ফিরতে চাইলেও এখন সময় লাগবে প্রায় দ্বিগুণ।
এসব সমালোচনা নিয়েই 'পরিবেশ বান্ধব' এবং 'সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি' নিয়মকে প্রাধান্য দিয়ে প্রশাসন আধুনিক সবুজায়নের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ কমানোর সঙ্গে শতভাগ নিরাপদ সড়ক তাদের অন্যতম চাওয়া।
এই শহরের রাস্তায় চলাচল করা এক-তৃতীয়াংশ গাড়ি পরিবেশ বান্ধব। এর সঙ্গে শব্দ দূষণ কমাতেই গতিতে টানা হচ্ছে লাগাম।
শব্দ দূষণ কমাতে জুরিখ লেকে চলাচল করা জাহাজগুলো তাদের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী হর্ন বাজানো বন্ধ করে দিয়েছে। জুরিখ লেকের পাশে বসবাসকারী এক নাগরিকের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ৪ বছর শুনানি শেষে আদালতের রায়ে এই হর্ন বাজানো বন্ধ হয়। কেবলমাত্র কোনো বিপদের আশঙ্কা থাকলে তবেই জাহাজগুলো জুরিখ লেকে হর্ন বাজাতে পারে।
টেস্পোথার্টির জরিমানা
৩০ জোনের জরিমানা গতির ওপর পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পায়। কোনো যানবাহন ৩০ এর পরিবর্তে ৩২ কিলোমিটার গতিতে চালানো হলে জরিমানা করা হবে ৪০ সুইজ ফ্রাঙ্ক। গতি ৬ থেকে ১০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় বেশি হলে জরিমানা হবে ১২০ ফ্রাঙ্ক এবং ১১ থেকে ১৫ হলে ২৫০ ফ্রাঙ্ক।
১৬ কিলোমিটার বেশি গতিতে গাড়ি চালালে জরিমানার সঙ্গে সতর্কতা নোটিশ আসবে। ২১ কিলোমিটার বেশি গতির ক্ষেত্রে জরিমানা, সতর্কতা এবং লাইসেন্স হস্তান্তরসহ তিরস্কারের নোটিশ দেওয়া হবে।
দ্বিগুণ অর্থাৎ ৬০ কিলোমিটার গতি বা তারচেয়ে বেশি গতিতে গাড়ি চালালে রেজার আইনে ১ থেকে ৪ বছরের জেল ও জরিমানা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
রেজার আইন
রেজার আইনে অপরাধের ধরন ভেদে বিভিন্ন মেয়াদে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। যেমন নির্ধারিত গতির দ্বিগুণ গতিতে গাড়ি চালালে ৪ বছর পর্যন্ত জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয় শাস্তির বিধান রয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় ক্যান্টন সোলোর্থনের ২১ বছরের কিশোরী লরেনার মৃত্যুর পরে রেজার আইনটি ব্যাপক ভাবে আলোচনায় আসে। লরেনাকে গাড়ি চাপা দেন ড্রাইভিং লাইসেন্সহীন এক যুবক। ওই যুবক তার অন্য বন্ধুদের সঙ্গে রাস্তায় গাড়ি নিয়ে প্রতিযোগিতা করার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লরেনাকে চাপা দেন। এর আগে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর অপরাধে খুব বেশি কঠোর আইন ছিল না। এই মৃত্যুর পর মানুষের ক্ষোভের মুখে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রেজার আইন করা হয়।
বেপরোয়া গতিতে যারা গাড়ি চালান তাদেরকে জার্মান ভাষায় বলা হয় গতিপাপী। গত ১ বছরে ৪০০ জনেরও বেশি গতিপাপীকে রেজার আইনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
ফেডারেল পরিসংখ্যান অফিসের মতে, রেজার আইন কার্যকর হওয়ার পর ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২ হাজার ২১ জন অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালিয়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। ২০১৩ সালে এমন অপরাধীদের সংখ্যা ছির মাত্র ৫২। ২০১৪ সালে ৩০২ এবং পরের বছরগুলোতে গড়ে প্রায় ৪১৬ জন দোষী সাব্যস্ত হন। অথচ, ২০২০ সালেই ৪২৫ জনকে এই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
সরাসরি কন্ট্রোল অথবা রাস্তায় বসানো বিভিন্ন ধরনের ক্যামেরার মাধ্যমে অধিক গতিতে গাড়ি চালানোর বিষয়টি শনাক্ত করা হয়। আধুনিক রেজার ক্যামেরা খুবই শক্তিশালী। এসব ক্যামেরার চোখ ফাঁকি দেওয়া কঠিন কাজ।
জুরিখ বা সুইজারল্যান্ডের শহরগুলোতে সাধারণত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ বক্স থাকে না। বলতে গেলে ট্রাফিক পুলিশও নেই। হাইওয়ে নিয়ন্ত্রণে বিশেষ পুলিশের বিশেষ একটি বিভাগ দায়িত্ব পালন করে। জুরিখে একমাত্র সেন্ট্রাল স্টেশনেই একটি ট্রাফিক বক্স রয়েছে। সেখানে অফিস শেষ সময়ে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য পুলিশ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
বাকিউল্লাহ খান, সুইজারল্যান্ড প্রবাসী সাংবাদিক
Comments