তরুণ উদ্যোক্তাদের থাকতে হবে যেসব দক্ষতা

আজকাল তরুণ-তরুণীদের কাছে এন্ট্রাপ্রেনারশিপ বা শিল্পোদ্যোগ একটি সুপরিচিত শব্দ। আপনার চারপাশে তাকালে দেখতে পাবেন প্রায় প্রতি মাসেই কেউ না কেউ ছোটখাটো ব্যবসা বা স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিযান শুরু করছেন।

তবে দীর্ঘ মেয়াদে, হাতে গোনা অল্প যে কজন মানুষ এ যাত্রায় সাফল্যের মুখ দেখেন, তারা কীভাবে এটি অর্জন করেন? এর জন্য কী কী কাজে দক্ষতা বা কোন ধরনের আত্মত্যাগের প্রয়োজন হবে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এ যাত্রায় যেসব বাধাবিপত্তি আসবে, সেগুলো কীভাবে অতিক্রম করা যাবে?

আপনি যদি একজন উদীয়মান উদ্যোক্তা হয়ে থাকেন তাহলে কিছু অত্যাবশ্যক দক্ষতা রয়েছে যেগুলো অর্জন করার কথা আপনি বিবেচনা করতে পারেন। যারা ইতোমধ্যে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাদের কাছে দ্য ডেইলি স্টার জানতে চেয়েছিল এ ধরনের কিছু দক্ষতার ব্যাপারে।

সারা ক্ষণ শেখার মনোভাব

যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলায় আপনার ইতিবাচক মনোভাব অনেক বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। বিশেষ করে আপনি যদি একজন উদ্যোক্তা হয়ে থাকেন। নিঃসন্দেহে এ যাত্রায় আপনাকে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ছাত্রসুলভ মনোভাব, খোলা মন ও বহুমুখী মানসিকতা বজায় রাখতে হবে। যাত্রাপথে অসংখ্য ভুল ও ব্যর্থতা আসবে। কিন্তু অহংকার এড়িয়ে চলতে হবে এবং একই ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন বারবার না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।

বিক্রয় ও পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপনের দক্ষতা

অনেক সফল উদ্যোক্তার মতে, অত্যাবশ্যক দক্ষতার তালিকায় এগুলো সবার উপরে। রিমোটলি'র প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও সায়েম ফারুক বলেন, 'কোনো কিছু বিক্রি করতে পারার যে দক্ষতা, তা শুধুমাত্র আপনার ব্যবসাকে অন্যের কাছে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রেই নয় বরং অন্যান্য ব্যক্তিগত বিষয়ের ক্ষেত্রেও কাজে লাগে।'

বণ্টনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সিইও সামিহা তাহসিন সায়েমের সঙ্গে একমত হন। তিনি বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি বিক্রয় ও যোগাযোগ স্থাপনের দক্ষতাগুলো সবার আগে আয়ত্তে আনা প্রয়োজন। উদ্যোক্তা হিসেবে আপনি খুব সম্ভবত দৈনন্দিন জীবনের কোনো একটি সমস্যার সমাধান দিচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে, আপনাকে সেই সমাধানটি আপনার ভোক্তা, বিনিয়োগকারী, সহকর্মী এমনকী ভবিষ্যৎ সহপ্রতিষ্ঠাতাদের কাছেও বিক্রি করতে হবে।'

বিক্রির দক্ষতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে এ রকম অনেক বই পাওয়া যায়। আপনি ইউটিউবে ভিডিও দেখেও অনেক কিছু শিখতে পারবেন। তবে মনে রাখবেন, আপনি যা শিখছেন তা কার্যক্ষেত্রে ব্যবহার করতে থাকলেই কেবল আপনি আরও দক্ষ হয়ে উঠবেন।

নিরন্তর উদ্ভাবন

আপনাকে সারাক্ষণ উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তি কাজে লাগাতে হবে, যাকে ইংরেজিতে 'আউট অব বক্স' চিন্তাধারা বলা হয়। ফ্যাটি বান ও হার্ট ওয়ার্ল্ডের প্রতিষ্ঠাতা তাহসিন রব এই মন্ত্রে বিশ্বাসী। তিনি বলেন, 'আপনাকে সব সময় নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে এবং নিজেকে নতুন করে উদ্ভাবনের মাধ্যমে আপনার আগের সংস্করণের চেয়ে আরও উন্নত হিসেবে তুলে ধরতে হবে।' একইসঙ্গে, গ্রাহকের প্রতিক্রিয়া আমলে নিতে হবে, কারণ সেখান থেকে উদ্ভাবনের নতুন নতুন ক্ষেত্র বের হয়ে আসে, জানান তিনি।

সুষ্ঠু গ্রাহক সেবা

কখনো কখনো মানবিক অনুভূতিগুলো আমাদের চিন্তাধারা এবং কীভাবে মানুষের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হয়, সে বিষয়গুলোকে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন করতে পারে। গ্রাহকদের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য। কারো মধ্যে অহংকার চলে এলেও এ সমস্যা দেখা দেয়।

তাহসিন বলেন, 'আপনার অহংকারকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন। আপনার একটি ভালো দিনে একজন গ্রাহক এসে আপনার কাছে ৩টি অভিযোগ জানালেও আপনার দিনটিকে নষ্ট হতে দেবেন না। তাদের সঙ্গে ধৈর্য্য হারাবেন না। বরং, তাদের কথা শুনুন এবং দেখুন কীসের ভিত্তিতে এই অভিযোগগুলো এসেছে। তাদেরকে গুরুত্ব দিন। গ্রাহকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করার জন্য এটি অত্যাবশ্যক।'

প্রযুক্তির ক্ষমতা

প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের জীবনে পাকাপাকি স্থান করে নিয়েছে, বিশেষ করে এই করোনাভাইরাস মহামারির আধুনিক যুগে। প্রযুক্তি বোঝার মানে এই না যে আপনাকে কোডিং ও প্রোগ্রামিংয়ে পারদর্শিতা অর্জন করে সফল হতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে প্রযুক্তির সক্ষমতাকে আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী কাজে লাগানোর দক্ষতা অর্জন।

আপনার ব্যবসার ভবিষ্যৎ দিক-নির্দেশনার ব্যাপারে আপনি তথ্য নির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং এ জন্য আপনি মেশিন লার্নিং, ডেটা সায়েন্স ও অ্যানালিটিক্সের সাহায্য নিতে পারেন। এ ছাড়া, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে ডিজিটাল বিপণন করে আপনি ব্যবসায় বড় আকারের সাফল্য পেতে পারেন।

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা

ব্যবসা করতে গেলে নানা রকম চ্যালেঞ্জ আসবেই। কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করা, নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী খুঁজে পাওয়া, পেমেন্ট গ্রহণ করা, ভালো একটি ডেলিভারি অংশীদার খুঁজে পাওয়া, বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে কাজ করা (বিশেষ করে প্রচুর 'অভদ্র' মানুষ), বিপণন করা, কখনো হাল ছেড়ে না দেওয়া, নতুন পণ্য ও সেবা চালু করার জন্য উদ্ভাবনী ক্ষমতার ব্যবহার এবং বিভিন্ন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া; এসবই উদ্যোক্তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ।

এর শেষ কোথায়? সামিহা বলেন, 'প্রথম যে বিষয়টি আমাকে শিখতে হয়েছে, তা হলো কীভাবে সমালোচনা গ্রহণ করা যায়। শুরুতে বিষয়টি খুবই ডিমোটিভেটিং ছিল কিন্তু খুব সম্ভবত এটাই আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। কখনো কখনো মুখ বন্ধ রেখে চুপচাপ কাজ শিখে যেতে হয়।'

তিনি আরও বলেন, 'একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আপনার জানতে হবে, ভালো সময়গুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় না (খারাপ সময়ও)। আপনাকে সারাক্ষণই উদ্ভাবন করতে হবে, মানুষের প্রতিক্রিয়া জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। দ্বিতীয় শিক্ষা হবে এটা মেনে নেওয়া, যে কখনোই সব কিছু নিখুঁত হবে না। এটা এমন একটি প্রক্রিয়া যার সঙ্গে আপনাকে মানিয়ে নিতে হবে।'

নারী উদ্যোক্তাদের বাড়তি চ্যালেঞ্জ

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে আমাদের দেশে একজন স্বাধীন নারী হিসেবে সফল হওয়া অনেক কঠিন একটি ব্যাপার। মেয়েদের জন্য পরিবেশ পরিস্থিতি কখনোই পুরোপুরি অনুকূল থাকে না। সামিহার মতে, একজন নারী উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। তিনি সতর্ক করেন, এতে নারী উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত হওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেন, 'এ থেকে উত্তরণের সেরা উপায় হচ্ছে এমন কিছু মানুষের সমর্থন জোগাড় করা, যারা আপনার সক্ষমতা সম্পর্কে জানেন এবং যারা আপনার সক্ষমতা সম্পর্কে আপনাকে সন্দিহান হতে দেবেন না।'

নিজের যত্ন নিন

একজন উদ্যোক্তার জীবন খুবই ঝামেলাপূর্ণ। সায়েম ফারুক বলেন, 'অনেক নির্ঘুম রাত এবং পরিবার-পরিজন ও বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ হারানোকে উদ্যোক্তা জীবনের ব্যয় হিসেবে বিবেচনা করা যায়। খুব সম্ভবত, আমার সবচেয়ে বড় বিসর্জন হচ্ছে নিজের স্বাস্থ্য ও মনের শান্তি বিলিয়ে দেওয়া। কীভাবে আগামী মাসে সবার বেতন দেবেন, সেটা বুঝে উঠতে না পারার মতো ভীতিকর পরিস্থিতি আর কিছুই হতে পারে না।'

'সবার আগে নিজের সম্পর্কে উপলব্ধি আসতে হবে। কিন্তু সেটি অর্জনের আগে, আপনার নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। এই প্রস্তুতি নেওয়ার পর আসে প্রাথমিক বিষয়গুলো, যেমন সময় মতো ঘুম থেকে ওঠা ও খাওয়া-দাওয়া করা, শরীরচর্চা করা, উপযুক্ত সহায়ক ব্যবস্থা থাকা। এ বিষয়গুলো ঠিক থাকলে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যও ঠিক থাকবে', বলেন তিনি।

শেষ কথা

উদ্যোক্তা হওয়ার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছেন, সে ব্যাপারে একটি সুস্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি। যদি আপনি জাঁকজমক খোঁজেন, তাহলে এটি আপনার ক্ষেত্র নয়। একজন উদ্যোক্তার কাজ সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন এবং এটি অনেকসময় একটি চাকরি থেকেও অনেক বেশি কিছু, কারণ কখনো কখনো আপনি কীভাবে গ্রাহকদের সন্তুষ্ট রাখবেন কিংবা কীভাবে আপনার কর্মীদের আগামী মাসের বেতন দেবেন, সে চিন্তা মাথায় নিয়ে আপনাকে রাতে ঘুমাতে যেতে হবে। সুতরাং আপনি যা করছেন, তা নিয়ে যদি সত্যিকার অর্থে অনুরাগী না হোন, তাহলে আপনি সারাক্ষণই অনুপ্রেরণার অভাবে ভুগবেন।

শিল্পোদ্যোগ এমন একটি বিলাসিতা, যেটি সবাই আয়ত্ত করতে পারেন না। সায়েম ফারুকের ভাষায়, 'যদি কারো তার পরিবারের প্রতি আর্থিক দায়বদ্ধতা থাকে, তাহলে তার উচিৎ হবে চাকরি করার অপেক্ষাকৃত নিরাপদ পথে চলা। এটা একটি চরম সত্য।'

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Kamal Hossain urges vigilance against obstacles to nation-building effort

"The main goal of the freedom — gained through the great Liberation War — was to establish democracy, justice, human rights and build a society free from exploitation. But we have failed to achieve that in the last 54 years," says Dr Kamal

6m ago