উড়োজাহাজের চেয়েও দ্রুতগতিতে ছুটবে হাইপারলুপ ট্রেন

যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসের মরুভূমিতে ২০২০ সালের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো একটি যাত্রীবাহী ট্রেনের পরীক্ষা সম্পন্ন করে ভার্জিন হাইপারলুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ট্রেনটির গতি ছিল বোয়িং-৭৪৭ বিমানের চেয়েও বেশি। এ ছাড়া চৌম্বকীয় প্রযুক্তিতে ট্রেনটি পরিচালিত হওয়ায় একদিকে যেমন পরিবেশবান্ধব হবে, অন্যদিকে পরিচালনা ব্যয়ও অনেক কম হবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
পডের ভেতর ভার্জিন হাইপারলুপের দুই কর্মী। ছবি: সিএনবিসি

যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসের মরুভূমিতে ২০২০ সালের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো একটি যাত্রীবাহী ট্রেনের পরীক্ষা সম্পন্ন করে ভার্জিন হাইপারলুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ট্রেনটির গতি ছিল বোয়িং-৭৪৭ বিমানের চেয়েও বেশি। এ ছাড়া চৌম্বকীয় প্রযুক্তিতে ট্রেনটি পরিচালিত হওয়ায় একদিকে যেমন পরিবেশবান্ধব হবে, অন্যদিকে পরিচালনা ব্যয়ও অনেক কম হবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

২০১৩ সালে এই আধুনিক পরিবহনটির ধারণা দেন টেসলার প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক। এরপর প্রায় ৪ শতাধিক যাত্রীহীন পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। বাস্তবায়নের অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে ভবিষ্যতের এক যোগাযোগমাধ্যম।

তাত্ত্বিকভাবে বলা হচ্ছে, একটি হাইপারলুপ ট্রেন ঘণ্টায় ১২ শ ৩০ কিলোমিটার বা ৭৬০ মাইলের বেশি গতিতে ছুটতে পারবে। অর্থাৎ হাইপারলুপ ট্রেনে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ২০ মিনিটের কম সময়।
 
হাইপারলুপ ট্রেন কী

যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্যে একটি পরিকল্পিত ও প্রস্তাবিত পদ্ধতি। হাইপারলুপ মূলত এক ধরনের ভ্যাকুয়াম ট্রেন বা ভ্যাকট্রেন। হাইপারলুপ প্রযুক্তির মাধ্যমে খুব অল্প বায়ুচাপ বিশিষ্ট এক ধরনের বিশেষ ক্যাপসুল বা পডের মাধ্যমে মানুষ ও পণ্য পরিবহন করা যাবে। সাধারণ ট্রেনে বগি বা কামরা থাকলেও হাইপারলুপ ট্রেনে থাকবে ক্যাপসুল বা পড। এ ধরনের পড একটি টানেল বা টিউবের মধ্য দিয়ে চলাচলের ফলে বাতাসের চাপ থাকবে শূন্য। যার ফলে প্রায় বাঁধাহীনভাবে চলাচল করতে পারবে ট্রেনটি। আর এই টানেল বা টিউব নির্মিত হবে ম্যাগনেটিক লেভিটেশন বা ম্যাগলেভ প্রযুক্তির মাধ্যমে।

ছবি: সংগৃহীত

বর্তমানে অনেক দেশেই ম্যাগলেভ প্রযুক্তিতে ট্রেন চলাচল করছে। সেগুলো মূলত বুলেট ট্রেন হিসেবে জনপ্রিয়। হাইপার লুপ-এর ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি থাকবে টানেলের ভেতরে। যা চুম্বকের চুম্বকত্ব ধর্মকে কাজে লাগিয়ে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক সাসপেনশন ও ইলেকট্রোডাইনামিক সাসপেনশন পদ্ধতিতে পডগুলো ভাসিয়ে রাখবে এবং অস্বাভাবিক গতিতে ছুটে চলতে সাহায্য করবে।

কীভাবে কাজ করবে হাইপারলুপ ট্রেন

হাইপারলুপের অন্যতম একটা বিশেষত্ব হচ্ছে, এতে বাতাসের ঘর্ষণ প্রায় শূন্য পর্যায়ে থাকে। ফলে বাঁধাহীনভাবে চলতে পারায় এর গতি বেড়ে যায় কয়েক গুণ। আর টিউবটি বায়ুশূন্য করতে ব্যবহার করা হয় পাম্প।

শক্তির সবচেয়ে বড় ব্যবহারগুলোর মধ্যে একটি হলো উচ্চ গতির ভ্রমণে বায়ু প্রতিরোধকে অতিক্রম করা। এয়ারলাইনাররা বায়ুচাপ কমাতে কম ঘন বাতাসের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করার জন্য বেশি উচ্চতায় আরোহণ করে। স্থল মাধ্যমে একই ধরনের পরিবেশ তৈরির জন্য হাইপারলুপ ক্যাপসুলগুলোকে একটি টিউবের মধ্যে রেখে বাতাসের চাপ শূন্যের পর্যায়ে নেওয়া হয়। যা ট্রেনগুলোকে মাটিতে থাকা অবস্থায় কার্যকরভাবে বিমানের গতিতে ভ্রমণের গতিবেগ সৃষ্টি করে দেয়।

ছবি: সংগৃহীত

ইলন মাস্কের মডেলে হাইপারলুপ টিউবের অভ্যন্তরীণ বাতাসের চাপ মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডলের চাপের প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ। যার অর্থ হচ্ছে ১০০ প্যাসকেলের সমান কার্যকরী চাপ, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের অবস্থার তুলনায় বাতাসের টেনে আনার শক্তিকে এক হাজার গুণ কমিয়ে দেয় এবং একে দেড় লাখ ফুট উপর থেকে উড়ে যাওয়ার সমান গতিসম্পন্ন করে।

ইলন মাস্কের এই মডেলের হাইপারলুপ ক্যাপসুলগুলো টিউবের অভ্যন্তরে ২৮টি এয়ার-বেয়ারিং স্কি সেটে ভেসে থাকবে। এ ছাড়া মাস্কের নকশায় প্রতিটা ক্যাপসুল বা পডে ২৮ জন করে যাত্রী বহন করা সম্ভব হবে।

হাইপারলুপের অন্য সংস্করণটি হচ্ছে ম্যাগনেটিক লেভিটেশন। ম্যাগলেভ পদ্ধতিতে চুম্বকগুলোর দুই মেরুতে একে অপরকে আকর্ষণ করে আর নিজেদের মেরুদের মধ্য বিকর্ষণ করে। ম্যাগলেভ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে রেল ট্র্যাকে ব্যবহৃত ম্যাগনেটগুলো চুম্বক ধর্ম কাজে লাগিয়ে বগিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

ছবি: সংগৃহীত

অন্যদিকে, হাইপারলুপ ট্রেনে ম্যাগলেভ প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি টিউব বা টানেলের ভেতর বায়ু চাপ ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশের মতো কমিয়ে ফেলে চৌম্বক ধর্ম কাজি লাগিয়ে ক্যাপসুল বা পডগুলোকে ভাসিয়ে রাখা হয়।

এ ধরনের পরিবহনের ফলে ঘর্ষণ কমে যায়, যা ম্যাগলেভ ট্রেনের চেয়েও হাইপারলুপের গতিকে বাড়িয়ে দেয়। একই সঙ্গে যাত্রা হয় আরামদায়ক, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। ম্যাগলেভ ট্রেনের চেয়ে হাইপারলুপ অনেক বেশি সাশ্রয়ী। তবে, হাইপারলুপের গতিপথ হতে হয় সরল। বাক বা মোড় থাকলে সেখানে হাইপারলুপের চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। এই ট্রেন একটানা ৯৩০ মাইল বা ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। যদি সর্বোচ্চ গতিতে চালানো সম্ভব হয় তাহলে এই পথ পাড়ি দিতে ৮০-৯০ মিনিটের বেশি সময় লাগে না।

২০১৩ সালে ইলন মাস্কের ঘোষণার পর হাইপারলুপ প্রযুক্তি বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বর্তমানে বেশ কয়েকটা দেশ হাইপারলুপ নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশের পাশাপাশি অবকাঠামো নির্মাণের কাজও শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি দুবাই ও ভারতেও হাইপারলুপ নির্মিত হচ্ছে। চেন্নাই-বেঙ্গালুরুর মধ্যে ৩৪৫ কিলোমিটার পথকে প্রস্তাবিত হাইপারলুপ রুট হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছে ভারত সরকার। আবুধাবি থেকে দুবাই, হেলসিংকি থেকে স্টকহোমসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটা রুটে হাইপারলুপ নির্মাণের আলোচনা চলছে।

হাইপারলুপের নির্মাণ ব্যয়

২০১৩ সালে ইলন মাস্ক যখন হাইপারলুপ হাই-স্পিড ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমের ধারণা দিয়েছিলেন, তখন তিনি লস এঞ্জেলেস থেকে স্যান ফ্রান্সিসকো পর্যন্ত আধা ঘণ্টার একটি রুটের নির্মাণ ব্যয় অনুমান করেছিলেন ৬ বিলিয়ন ডলার। যেখানে মাইলপ্রতি খরচ হতে পারে ১১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার।
তবে, ফোর্বস-এর ফাঁস হওয়া নথিগুলো থেকে জানা গেছে যে, মাস্কের ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্যে যে দুটো সংস্থা কাজ করছে, তাদের মধ্যে একটি হাইপারলুপ ওয়ান ১০৭ মাইলব্যাপী বে এরিয়া প্রকল্পের ব্যয় ৯ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৩ বিলিয়ন ডলার এবং মাইলপ্রতি ব্যয় ৮৪ মিলিয়ন ডলার থেকে ১২১ মিলিয়ন ডলার হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

ছবি: সংগৃহীত

অর্থাৎ, মাস্কের মূল অনুমান থেকে বাস্তবে হাইপারলুপ নির্মাণব্যায় অনেক বেশি। তবুও, এতে যাতায়াত খরচ বিমানের চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মাস্কের হিসাব অনুযায়ী, স্যানফ্রান্সিসকো থেকে লস এঞ্জেলস রুটে প্রতি ৩০ সেকেন্ড পরপর একটি করে পড ছেড়ে যাবে। হাইপারলুপে যাতায়াত খরচ সাধারণ ট্রেনের টিকিটের চেয়ে বেশি হলেও বিমানের চেয়ে কম হবে এবং অন্য সব মাধ্যমের চেয়ে এর বাড়তি সুবিধা হলো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি।

বিবিসির তথ্যসূত্রে, হাইপারলুপ প্রযুক্তি পরিবহন খাতে বিপ্লব নিয়ে আসতে চলেছে। আর এই প্রযুক্তি যে বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে তা ভার্জিন হাইপারলুপের যাত্রীসহ ট্রায়াল থেকেই স্পষ্ট। প্রতিষ্ঠানটির দুজন কর্মী ১৫ সেকেন্ডের এই ট্রায়ালে ঘণ্টায় ১৭২ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যে পরীক্ষামূলক একটি ট্র্যাকে ভ্রমণ করেছেন। যদিও এটা প্রতিষ্ঠানটির ঘণ্টায় হাজার কিলোমিটারের বেশি গতিতে পরিবহণ লক্ষ্যমাত্রার একটা ভগ্নাংশ মাত্র। তবে, ভার্জিন ছাড়াও বর্তমানে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হাইপারলুপ প্রযুক্তি বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে।

 

তথ্যসূত্র:

বিজনেস ইনসাইডার, বিবিসি, ভক্স, ইকোনোমিক টাইমস ও ভার্জিন হাইপারলুপ

Comments

The Daily Star  | English

US sanction on Aziz not under visa policy: foreign minister

Bangladesh embassy in Washington was informed about the sanction, he says

2h ago