ডিজিটাল সাম্রাজ্যবাদের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব

ছবি: দ্য ইকোনোমিস্ট

মহামারির কারণে সৃষ্ট নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সঙ্গে একটি গভীর সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তথ্য শেয়ার, মানবীয় যোগাযোগ, তথ্য সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও গবেষণা প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করতে ইন্টারনেট ও ইনোভেশনের প্রভাব অপরিহার্য। বিশ্বের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলো থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত প্রচারণা ও জনসংযোগের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের মতো ডিজিটাল মাধ্যম। পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়েও বিশেষ ভূমিকা রাখছে প্রভাবশালী এ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। 

উপনিবেশবাদের ধরন বদলেছে। অস্ত্রের ঝনঝনানি আর শাণিত বুদ্ধিমত্তার জোরে বিশ্বকে কোনঠাসা করে ইউরোপের একচেটিয়া শাসনের অবসান হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর ভর করে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইউরোপ থেকে বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্র চলে যায় আমেরিকার হাতে। আমেরিকার একচেটিয়া রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তৈরির পেছনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদান যেমন ছিল, ভাঙন ধরার পেছনেও সেই প্রযুক্তির বিকাশই অনেকাংশে দায়ী। একবিংশ শতাব্দীতে এসে রাশিয়া ও চীন আমেরিকার চোখে চোখ রেখে ভূ-রাজনীতির হিসাব দিচ্ছে পাল্টে। প্রযুক্তির প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি পড়েছে অর্থনীতিতে, পাশাপাশি রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতিসহ সব স্তরেই এর ছাপ পাওয়া যায়। 

ছবি: অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল

তথ্যবাজার ও অর্থনীতি

এক সময় তেল ছিল বিশ্ব রাজনীতির মূল স্বার্থ, যে স্থানটা এখন তথ্য বা ডাটার দখলে। তথ্যের মূল্যায়ন নিয়ে বহুদিন ধরেই গবেষণা চলছে, ২০১৭ সালে 'দ্য ইকোনোমিস্ট' তথ্যকে নতুন তেল বলে আখ্যা দিয়ে একটি স্টোরি প্রকাশ করে। তারপর থেকেই এই বিষয়ে বৈশ্বিক চর্চাটা তরান্বিত হয়। বর্তমানে, যার কাছে যতবেশি ডাটা, সে তত বেশি সম্পদশালী। প্রযুক্তি দানব গুগলের কথাই ধরা যাক, যাদের কাছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ডাটা সংরক্ষিত আছে। তাই বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানির তালিকাতেও প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান উপরের দিকে। 

২০২০ সালে বিশ্বের প্রথম সারির প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহারকারীদের তথ্য বিক্রি করে আয় করেছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। স্ট্যাটিস্টার তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী বিগ ডাটা ও বিজনেস এনালিটিকস থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় হবে ২৭৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তথ্যের এই বাজার থেকেই বোঝা যায় এর মূল্য কতটা। তথ্যের মাধ্যমে নাগরিকদের গতিবিধির ওপর নজরদারি করা যায়, ডিজিটাল টুল ব্যবহার করে তাদের প্রভাবিত করা যায়, অনুমান করা যায় সব ধরনের আচরণ ও তার ফলাফল সম্পর্কে। অনেক ক্ষেত্রে জনগণের মতামত ও কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণও করা যায়, এসবই রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিকদের কাছে অতি জরুরি বিষয়।  

ছবি: ওয়ার্ল্ড ফাইন্যান্সিয়াল রিভিউ

ডিজিটাল সাম্রাজ্যবাদ

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে ইতিহাসের প্রতিটি সভ্যতা, সমাজ, রাজ্য এবং সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন হয়েছে। প্রযুক্তির প্রভাবে পালটে গেছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র, স্বতন্ত্র সমাজ ব্যবস্থা, যোগাযোগ ও রাজনৈতিক চর্চা। যে জাতির প্রযুক্তি যত উন্নত, সে জাতির বিশ্ব সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে প্রভাবও তত বেশি। 

পশ্চিমা ও দূরপ্রাচ্যের সংস্কৃতি ও রাজনীতির ছাপ পরিলক্ষিত হয় অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাধর দেশগুলোতে। ভাষা, সিনেমা, সাহিত্য, প্রচারণা প্রকাশের মূল মাধ্যমে পরিণত হয়েছে ফেসবুক, টুইটার, টিকটকের মতো জনপ্রিয় প্রযুক্তিগুলো। খুব সহজ একটা উদাহরণ দিয়ে বলা যাক, সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে প্রযুক্তিতে উন্নত ভারতের 'পুষ্পা' নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়, যা ডিজিটাল প্লাটফর্ম ও টুল ব্যবহার করে বিশ্বের সর্বত্র প্রদর্শিত হয়। এই চলচ্চিত্রে মূল চরিত্র অভিনয় করা অভিনেতার বেশভূষা আর চলন-বলনের প্রভাব দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, যা বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যেও লক্ষণীয়। ওই অঞ্চলের ভাষা-সংস্কৃতিও বাঙালিদের থেকে অনেক আলাদা। অথচ, প্রতিনিয়ত লাখ লাখ বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীদের মধ্যে দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতি অনুকরণের প্রবণতা বাড়ছে। 

এই প্রবণতা বাড়ার পেছনে অনেক প্রভাব রাখছে চলচ্চিত্র, প্রযুক্তির কল্যাণে বাংলাদেশ দক্ষিণ ভারতের চলচ্চিত্রের একটা বড় বাজারে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে, পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব তো রয়েছেই, যা বিশ্বের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রতা কমার জন্যে দায়ী। সম্প্রতি, থাই নারীদের মধ্যে পশ্চিমা সংস্কৃতির সেলফি সংস্কৃতির প্রভাব এত বেশি পড়েছিল দেশটির সরকার সেই প্রভাব ঠেকাতে রীতিমত আইনি পথ বেছে নেয়। 

'দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস'-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব থেকে থাই নারীদের দূরে রাখতে দেশটির সরকার ২০০৭ সালের কম্পিউটার ক্রাইম অ্যাক্ট অনুযায়ী ছবি শেয়ার নিষিদ্ধ ও আইন ভঙ্গকারীকে ৫ বছরের কারাদণ্ড রেখে বিধান করে। এসবই আসলে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ, যা অনেকের কাছে ডিজিটাল সাম্রাজ্যবাদ হিসেবেও পরিচিত। 

পঞ্চম প্রজন্ম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

ইন্টারনেট অফ থিংসের (আইওটি) ওপর ভিত্তি করে বিশ্বে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ঘটবে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও পঞ্চম প্রজন্মের থাকবে বিশেষ ভূমিকা। বিশ্ব মোড়লদের মধ্যে পঞ্চম প্রজন্ম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে এক তীব্র প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাপী পঞ্চম প্রজন্মের বিশাল বাজার সৃষ্টি হবে। এর সঙ্গে ভবিষ্যত অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, ও ব্লকচেইন প্রযুক্তি। ২০৩৫ সালের মধ্যে কেবল পঞ্চম প্রযুক্তিই বিশ্ব অর্থনীতিতে ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার ও ২২ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। 

অন্যদিকে, ২০৩০ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান অনুমান করা হয়েছে ১৫ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। এই বিপুল পরিমাণ অর্থনীতি তেল কিংবা অতীতের সব ধরনের উৎসের চেয়ে বেশি মূল্যবান। ফলে, বিশ্ব রাজনীতিতে এর বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরাশক্তিগুলোর লড়াই চলবে। 

ছবি: এশিয়া টাইমস

সাম্প্রতিক চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমেরিকাভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঁচামালের যোগান থেকে শুরু করে বিশ্বের অধিকাংশ ইলেক্ট্রনিক পণ্য সরবারহে রয়েছে চীনের আধিপত্য। সেইসঙ্গে বিশ্বব্যাপী পঞ্চম প্রজন্মের অবকাঠামো গড়ে তুলতে বিশ্বের অনেক দেশ চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের সঙ্গে চুক্তি করেছে, এমনকি বাংলাদেশেও পঞ্চম প্রজন্মের প্রযুক্তির কারিগরি অংশীদার এই প্রতিষ্ঠানটি। চীনের এই প্রযুক্তি দানবের বৈশ্বিক প্রভাব ঠেকাতে ট্রাম্প প্রশাসনের তোড়জোড় কারও অজানা না। নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও সামাজিক নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ার শঙ্কায় কয়েকটি দেশ চুক্তি বাতিলও করেছে। 

পুলিশিং ও বিচার ব্যবস্থা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি অপরাধ সংঘটিত হবার আগেই সে সম্পর্কে জানতে পারবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। অনেক ক্ষেত্রে পরিকল্পনা পর্যায়ে অপরাধ চিহ্নিত করে তা ঠেকানো যাবে, যেখানে কাজ হবে ভবিষ্যদ্বাণীমূলক পুলিশিং একটি ব্যবস্থা। অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের কিছু পুলিশ বাহিনী ইতোমধ্যেই ভবিষ্যদ্বাণীমূলক পুলিশিং ব্যবহার বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু করেছে। 

আবার কিছু প্রযুক্তি দিয়ে একটা অপরাধ খুব সহজে প্রমাণ করা যায়, ফলে বিচার কার্যক্রম সহজ ও গতিশীল হতে পারে। যেমন: ডিভাইস ট্রাকিং, আইপি লোকেশন চিহ্নিত করা, ফোন কল ট্রাক করা ইত্যাদি। এজন্য কিছু নজরদারিমূলক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়, যা নিয়ে আবার অনেক বিতর্ক ও রয়েছে। বিশেষ করে পক্ষপাতমূলক ব্যবহার ও নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার খর্ব করা। 

সম্প্রতি বাংলাদেশে ফোনালাপ ফাঁসের মতো ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়, যা রাষ্ট্রের নাগরিকের নিরাপত্তার জন্যে হুমকিস্বরূপ। একটি রাজনৈতিক সরকার তার প্রতিপক্ষকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে তাদের প্রাইভেসি লঙ্ঘন করছে, বিশ্বব্যাপী যার বহু উদাহরণ দেখা যায়। এ ছাড়া চীন, রাশিয়া, ফিলিপিন্স, মিয়ানমারসহ বহু দেশের সরকার রাষ্ট্রের বিশিষ্ট নাগরিক, অধিকার কর্মী বা আন্দোলনকারীদের ওপর নজরদারি করে তাদের দমন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ছবি: সংগৃহীত

সম্পদের অস্বাভাবিক বৈষম্য 

উৎপাদনশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জ্ঞান অর্জনের সুযোগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ সমাজে প্রযুক্তির অনেক অবদান থাকলেও সম্পদের অস্বাভাবিক বৈষম্য সৃষ্টির অভিযোগ ও রয়েছে। সিলিকন ভ্যালিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সম্পদের দিকে তাকালেই এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। একেকটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মালিকের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ অনেক দেশের সমন্বিত জিডিপির চেয়েও বেশি। 

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মহামারির মধ্যে আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী জেফ বেজোসের ব্যক্তিগত সম্পদভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে ৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, আর তখন মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭৭ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। 

২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেজোসের প্রতি সেকেন্ডে আয় ছিল ৩ হাজার ৭০০ ডলারের বেশি। এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ বেশ কয়েকটি দেশের সমন্বিত জিডিপির চেয়েও বেশি। বিশ্বের সেরা ১০ ধনীর মধ্যে অন্তত ৮ জন প্রযুক্তিখাতের। সম্পদের এমন বৈষম্য, সমাজ ও রাজনীতির প্রতিটা স্তরে প্রভাব বিস্তার করে।

তথ্যসূত্র:
ফোর্বস, মিডিয়াম, দ্য ইকোনোমিস্ট, স্ট্যাটিস্টা, অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ও ইয়াহু ডট কম।
 

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh, Pakistan, China launch trilateral cooperation mechanism

A working group will be formed to follow up on and implement the understandings reached during the meeting

2h ago