পৃথিবীতে কোনো গ্রহাণু আঘাত হানলে কী ঘটবে?

ধরুন একটা গ্রহাণু আচমকা গতিপথ বদলে পৃথিবীর দিকে আসতে শুরু করেছে। আজ রাতের মধ্যে ব্যস্ততম কোনো শহরের প্রাণকেন্দ্রে আঘাত হানবে। তাহলে কী ঘটতে পারে?
গ্রহাণুর নাম কমবেশি সবাই শুনেছেন। উল্কা বা উল্কাপিণ্ড, যার আঘাতে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি বছর আগে অতিকায় ডাইনোসর পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। তাহলে প্রায় ২ কোটি মানুষের যান্ত্রিক ঢাকা নগরীর অবস্থা কী হবে? আর এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাই বা কতটুকু, যদি গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হেনেই থাকে তাহলে সেটার ক্ষতি পরিমাপই বা করা হবে কীভাবে? পৃথিবী কি ধ্বংস হয়ে যাবে? এমন দুর্ঘটনা এড়ানোর কোনো সুযোগ আছে কি না বা গ্রহাণুকে ঠেকানোর প্রযুক্তি পৃথিবীর কাছে আছে কি? আজকে এসব বিষয়ে আলোচনা করা হবে।

গ্রহাণু
যেসব গ্রহ-উপগ্রহ দিয়ে সৌরজগৎ সৃষ্টি হয়েছে সেসব গ্রহ-উপগ্রহের অবশিষ্ট টুকরোগুলোই হচ্ছে গ্রহাণু। যা সূর্যকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান। মাঝেমধ্যে কয়েকটা ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর কক্ষপথে ঢুকে পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটাতে পারে। আশার কথা হচ্ছে, অধিকাংশ গ্রহাণু আকারে খুব ছোট হয়। পৃথিবীর জন্যে পর্যাপ্ত ক্ষতিকর গ্রহাণুর সংখ্যা অবশ্য কম, যেগুলো পৃথিবীতে আঘাত হানার সম্ভাবনা আরও কম। তবুও, তা একেবারেই অসম্ভব নয়।
প্রতিনিয়ত অসংখ্য গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত করছে। মহাকাশ থেকে রোজ শত শত টন ধুলোবালি নিক্ষিপ্ত হয় পৃথিবীর দিকে। তবে, বছরে প্রায় একবার একটা গাড়ির আকারের গ্রহাণু আমাদের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে পারলেও মেসোস্ফিয়ার স্তরে এসে পুড়ে যায়। কখনো পৃথিবীর পৃষ্ঠে পৌঁছাতে পারে না। তবে, ডাইনোসর বিলুপ্তির জন্যে দায়ী ১০-১২ কিলোমিটার পরিধির একটি গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হানলে সেটা হবে অন্য বিষয়। এমন গ্রহাণুর সংখ্যা খুব কম এবং তা কয়েক মিলিয়ন বছরে একবার পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসতে পারে।
মূল চিন্তার বিষয় হচ্ছে, একটি ফুটবল মাঠের আকারের গ্রহাণু নিয়ে। যা প্রতি ২ হাজার বছরে একবার পৃথিবীর দিকে আসে। যদি তেমন আকারের একটা গ্রহাণু আজ রাতেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়ে? পৃথিবীর পৃষ্ঠের মাত্র ৩ শতাংশ জনবসতিপূর্ণ। অর্থাৎ, ফুটবল মাঠের আকারের ১০০টা গ্রহাণুর মধ্যে ৯৭টি শুধু সমুদ্রে ডুবে বা জনবসতিহীন জঙ্গলে আঘাত হানবে। পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশের আয়তন খুবই ছোট, তাই ঢাকায় আঘাত হানার সম্ভাবনা আরও কম।

ভাগ্য যদি প্রতিকূলে থাকে আর গ্রহাণুটা ঢাকার দিকে আসে তাহলে লোকজন সরিয়ে নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যাবে? যদি ১০০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটা গ্রহাণু সেকেন্ডে ৩০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলে, তবে এই গতিতে মেসোস্ফিয়ার অতিক্রম করে মাত্র ৩ সেকেন্ডেই পৃথিবীতে আঘাত হানবে। যা প্রায় ৭ কিলোমিটার পরিধির মধ্যের সমস্ত অবকাঠামোর ক্ষতিসাধনে সক্ষম। ঢাকা শহরের বর্তমান ট্রাফিক পরিস্থিতিতে ৩ ঘণ্টাতেও ৭ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়া দুরূহ। অর্থাৎ কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ হারাবে।

২০১৩ সালের দিকে রাশিয়ার চেলিয়াবিনস্কে ২০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি গ্রহাণু আঘাত হানে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কয়েক হাজার বাড়িঘর, আহত হয়েছিল সহস্রাধিক মানুষ। মাত্র ৩৩ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হলেও কোনো প্রাণহানি ঘটেনি, যা ছিল বিরল ঘটনা। কারণ, পাথর আকৃতির উল্কাপিণ্ডটি (গ্রহাণু) ছিল হিরোশিমায় আঘাত হানা ২০টা বোমার মতো শক্তিশালী। কিন্তু, আমরা যেটা আলোচনা করছি সেই উল্কাপিণ্ডটি এটার চেয়ে অন্তত ৫ গুণ বড়। তবে, তা ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত একটা গ্রহাণুর মতো ধ্বংসাত্মক হবে না নিশ্চয়ই।
সিবিএসর একটি তথ্যসূত্রে জানা যায়, ১৯০৮ সালে পূর্ব সাইবেরিয়ার কম জনবসতিপূর্ণ তুঙ্গুস্কা অঞ্চলে ২০০ ফুট প্রশস্ত একটি গ্রহাণু আঘাত হেনেছিল। যেটা পৃথিবী পৃষ্ঠে বিস্ফোরিত হবার পর ৩ থেকে ৩০ মেগাটনের মতো শক্তি নিয়ে আশেপাশে একটি বায়ু বিস্ফোরণ তৈরি করেছিল। পাশাপাশি, ৮৩০ বর্গ মাইলজুড়ে থাকা গাছগুলোকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল। তাহলে ১০ কিলোমিটারের একটা গ্রহাণুর আঘাত পৃথিবীর প্রাণীর অস্তিত্বকে সংকটে ফেলে দেবে।
এদিকে, ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত একটি গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হানার মাধ্যমে যে শক ওয়েব হবে, তাতেই পৃথিবীর একটা বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। পৃষ্ঠে শত কিলোমটারজুড়ে একটি বিশাল গর্তের সৃষ্টি হবে। গ্রহাণুটির ধ্বংসাবশেষ পৃথিবীর বাইরে একটি বলয় সৃষ্টি করবে, যা দেখতে শনি গ্রহের বলয়ের মতো হবে।

তার বেশিরভাগ আবার একসময় বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতেই বর্ষিত হবে। শহরগুলো ঢেকে যাবে, বনগুলো জ্বলে যাবে ও অরক্ষিত সবকিছুই ঝলসে যাবে উত্তপ্ত ধ্বংসাবশেষের উত্তাপে। তবে, এর আগে একটি ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে নিতে পারলে বেঁচে থাকা যাবে।
তবে, সেই বেঁচে থাকাটা হবে সংক্ষিপ্ত। কারণ, পৃষ্ঠে গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবী পৃষ্ঠ একসময় ধুলোতে ঢেকে যাবে, যা সূর্যের আলো পর্যন্ত আটকে দেবে। আর সূর্যের আলো ছাড়া পৃথিবীতে অধিকাংশ প্রাণী ও গাছপালা মারা যাবে। এমন পরিস্থিতি অন্তত বছর খানেক ধরে চলবে, খুব বেশি ধনী না হলে এই সময়টা বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। খাদ্যাভাবে দরিদ্রদের পরিণতি হবে ডাইনোসরের মতো।
এমন পরিস্থিতি দেখা দিলে তা প্রতিরোধের মতো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা এখনো আবিষ্কার হয়নি। বার্তা সংস্থা সিএনএন থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে স্পেস এক্স প্রতিষ্ঠাতা এলন মাস্ক একটি বড় পাথর পৃথিবীতে আঘাত হানার ব্যাপারে সতর্ক করে বলেছিলেন, বর্তমানে তা ঠেকানোর কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই।

তবে আশার বিষয় হচ্ছে, বেশিরভাগ গ্রহাণু থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য বায়ুমণ্ডল রয়েছে এবং পৃথিবীর চারপাশে সমস্ত মহাকাশের শিলাগুলোর ওপর নজর রাখার জন্য নাসাসহ আরও অনেক স্যাটেলাইট রয়েছে। তবে, অনেক দেরি না হওয়া পর্যন্ত আগত গ্রহাণু শনাক্ত করা খুব কঠিন। এ ছাড়া, বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ডার্ট নামে নাসা একটি যান মহাকাশে পাঠায়। যা মূলত পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা কোনো গ্রহাণুকে তার গতিপথ থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেবার জন্য তৈরি।
গ্রন্থনা: এস এম সোহাগ
তথ্যসূত্র: হোয়াট ইফ, বিবিসি, সিবিএস
Comments