বাড়ছে কিউআর কোডের ব্যবহার, জেনে নিন সুবিধা-অসুবিধা
বর্তমান সময়ে মোবাইল ব্যাকিং এর সুবাদে কিউআর কোড আমাদের কাছে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন দোকানে ফোন নম্বর স্ক্যান করতে, কোনো ওয়েব সাইটের লিংকে প্রবেশ করতে কিউআর কোডের ব্যাবহার দেখা যায়। তবে করোনা মহামারির প্রভাবে কিউআর কোড আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে—এর স্পর্শহীন বৈশিষ্ট্যের কারণে।
আজকাল রেস্টুরেন্টগুলোও তাদের মেনু কিউআর কোডে নিয়ে আসছে। স্মার্ট ফোনের ক্যামেরা বের করে স্ক্যান করলেই তৎক্ষণাৎ খাবারের মেনু স্ক্রিনে চলে আসে। হাতে সংস্পর্শের কোনো ঝামেলা নেই। মেনু প্রিন্ট করানোর কোনো ঝামেলা নেই। এরকম হাজারটা ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়েছে কিউআর কোড।
কিউআর কোড কি?
কিউআর কোড হলো সাদা-কালো কিছু পিক্সেলে ভরা একটি বর্গাকার বাক্স যার মধ্যে সংরক্ষণ করা যেতে পারে প্রায় ৭ হাজারের মতোন অক্ষর অথবা সংখ্যা। কোডটি স্ক্যান করলেই পাওয়া যাবে সব তথ্য।
বিভিন্ন প্রকার তথ্য সংরক্ষণের কাজে কিউআর কোড ব্যবহার করা হয়। যেমন, কোনো পণ্যের তথ্য সম্পর্কে জানতে, ওয়াইফাই কানেক্ট করতে অথবা কারও মোবাইল নাম্বার নিতে। QR Code-এর পূর্ণ অর্থ হলো Quick Response code। মূলত দ্রুততার সঙ্গে কিউআর কোডের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ (ডাটা এনকোড) করা যায় বলে এই নাম।
কিউআর কোডের ব্যবহার
প্লেনের টিকিট থেকে শুরু করে কোনো অ্যাপ ডাউনলোড করতে আজকাল কিউআর কোডের ব্যবহার হয়। এর নানা ধরনের ব্যবহারের মধ্যে আছে,
বিজ্ঞাপন
পত্রিকায় কোনো ফোনের বিজ্ঞাপন দিলে তার পাশে অনেকেই কিউআর কোড দিয়ে দেয়। কোডটি স্ক্যান করলে যে কেউ ওই ফোনের বিজ্ঞাপন ভিডিওটি দেখতে পারে। তখন একইসঙ্গে দুইভাবে পণ্যের প্রচার করা সম্ভব হয়।
একাউন্ট ইনফরমেশন
ফেসবুক, টুইটারসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় একাউন্ট ইনফরমেশন আর লিখে দেওয়া লাগে না। চাইলেই সব তথ্য একটি কিউআর কোডে নিয়ে আসা যায়। পরে তা স্ক্যান করলে সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যক্তির একাউন্ট সামনে চলে আসে। মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপে আজকাল আগে থেকেই প্রোফাইল কিউআর কোড তৈরিই করা থাকে। যে কেউ চাইলে একান্ত নিজের কিউআর কোড ডিজাইন করে নিতে পারে।
প্রোডাক্ট প্যাকেজিং
একটি পণ্যের অনেক উপাদান থাকে, যা সব হয়তো প্যাকেটের গায়ে লেখা সম্ভব হয় না। তখন পণ্যের গায়ের কিউআর কোড স্ক্যান করলে ওই পণ্য সম্পর্কিত সব তথ্য পাওয়া যায়।
নিরাপত্তা
যেহেতু একটি কিউআর কোডে ব্যক্তিগত তথ্য অথবা পাসওয়ার্ড ইনপুট দেওয়া সম্ভব। তাই যেকোনো স্থানে ম্যানুয়ালি পাসওয়ার্ড ইনপুট দেওয়ার বদলে অনেকেই কিউ আর কোড ব্যবহার করেন। যা একইসঙ্গে নিরাপদ এবং দ্রুত।
কিউআর কোডের আবিষ্কার
৬০-এর দশকের পরে পুরো বিশ্ব যখন আরেকটি চীন-জাপান শিল্প বিপ্লবের সাক্ষী। প্রচুর কারখানা তৈরি হচ্ছিল, সেই সব কারখানায় তৈরি হচ্ছিল প্রচুর ডিজিটাল পণ্য। এত এত পণ্যের তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং সাজানো ছিল বেশ কষ্টসাধ্য একটি কাজ। তখন কারখানাগুলোতে এসব তথ্যগুলো ম্যানুয়ালি ইনপুট দেওয়া হতো। যার ফলে আলাদা করে প্রচুর সময় ব্যয় হচ্ছিল। ততদিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বারকোডের আবিষ্কার হয়ে গেছে। বারকোড স্ক্যান করেও তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল। তবে তাতে শুধু ২০টি অক্ষরই সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল। ডাটার পরিমাণের দিক থেকে তা ছিল খুবই সামান্য।
১৯৯৪ সালে কোনো এক লাঞ্চ ব্রেকে হয়তো এই কথা গুলোই চিন্তা করছিলেন জাপানি ইঞ্জিনিয়ার মাশাহিরো হারা। তিনি তখন জাপানের টয়োটা কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠান ডেনজো ওয়েভের চিফ ইঞ্জিনিয়ার।
সে সময়ের চাহিদা মিটিয়েই মাশাহিরো হারা আবিষ্কার করেছিলেন ৪ কোনা বক্সের সাদা কালো পিক্সেলে ভরা স্কানেবল কিউআর কোড। যার ফলে আগের বারকোডের চেয়ে ১০ গুণ বেশি দ্রুত এবং অধিক তথ্যও সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছিল। এ ছাড়া বারকোডের শুধু এক অ্যাঙ্গেলে ধরেই স্ক্যান করতে হতো। হিরো এমনভাবে নতুন কোডটি তৈরি করেছিলেন যে, ৩টি ভিন্ন এঙ্গেল থেকে তা স্ক্যান করা সম্ভব।
বারকোডের আইডিয়া নিয়েই নতুনভাবে তৈরি হয়েছিল এই কোড। তবে মাশাহিরো এর জন্য কোনো কপিরাইট পেটেন্ট ফাইল করেনি। ফলে যে কেউ সম্পূর্ণ বিনামূল্যেই এই কোড ব্যবহার করতে পারে। কারখানার পণ্যের তথ্য সংগ্রহের জন্য তৈরি হওয়া এই কিউআর কোড এখন ব্যবহার করা হচ্ছে সব জায়গায়। প্লেনের টিকিট থেকে শুরু করে ব্যাংকিং, সর্বত্রই এরা দেখা মেলে। সময় বাঁচানোর ক্ষেত্রে কিউআর কোড আসলেই মানুষের জীবনে বেশ একটা পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে।
কীভাবে ব্যবহার করবেন কিউআর কোড?
৯০-এর দশকে কিউআর কোডের আবিষ্কার করা হলেও জনসাধারণের মধ্যে তা জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে। বর্তমানে যেকোনো স্মার্ট ফোনের ক্যামেরা দিয়েই কিউআর কোড স্ক্যান করা যায়। ফোনে বিল্ট ইন স্ক্যানার না থাকলেও গুগল-প্লে স্টোর থেকে স্ক্যনার অ্যাপ ডাউনলোড করে নিতে পারেন। এরপর যেকোনো কিউআর কোডের দিকে ক্যামেরা তাক করলেই সঙ্গে সঙ্গে ওই কোডের সব তথ্য আপনি আপনার ফোনের স্ক্রিনে দেখতে পারবেন।
কীভাবে তৈরি করবেন?
হ্যাঁ, চাইলে আপনি নিজেও কিউআর কোড তৈরি করতে পারবেন। বর্তমান সময়ে বিজনেস কার্ডে, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইল শেয়ার করতে, ওয়েব সাইট লিংক দিতে কিউআর কোডের ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিনামূল্যে কিউআর কোড তৈরির বিভিন্ন ওয়েবসাইট রয়েছে, যেমন-
www.qr-code-generator.com
www.qrcode-monkey.com
ওয়েবসাইটে প্রবেশ করার পর আপনি যেকোনো অক্ষর বা সংখ্যা ইনপুট দিলেই সঙ্গে সঙ্গে সেটার কিউআর কোডের ছবি চলে আসবে। পরবর্তীতে সেই ছবিটি ডাউনলোড করে আপনি যেকোনো কাজে তা ব্যবহার করতে পারবেন।
কিউআর কোড কি নিরাপদ?
কোনো কিউআর কোড হ্যাক করা সম্ভব নয়। তবে হ্যাকার চাইলে ভুয়া ওয়েবসাইটের লিংক দিয়ে কোড তৈরি করতে পারে। স্ক্যান করার পর লিংকটিতে প্রবেশ করলে হয়তো আপনার লোকেশন ট্র্যাক করা হতে পারে বা একাউন্টের তথ্য চুরি হতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো কিউআর কোড স্ক্যান করার আগে তার সূত্র যাচাই করে নিতে।
তথ্যসূত্র:
www.qrcode.com
www.businessinsider.com
Comments