মেটাভার্স পরিবর্তন আনবে যেসব ক্ষেত্রে

২০২০ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। দক্ষিণ কোরিয়ার তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের প্রচেষ্টায় মৃত মেয়ে না-ইয়নের সঙ্গে মা ঝাং জি-এর মিলনের সাক্ষী হতে পেরেছিল পুরো বিশ্ব। মা তার মৃত মেয়েকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেই মা-মেয়ের আবেগঘন দৃশ্য বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (সংক্ষেপে 'ভিআর')-এর বদৌলতে। যা মেটাভার্স দুনিয়ারই একটি অংশ।
সম্প্রতি ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, অকুলাস ও হোয়াটসঅ্যাপের মালিকানাধীন কোম্পানির নাম 'মেটা' হওয়ায় বেশ শোরগোল হলেও মেটার উৎপত্তি অনেক আগেই। ১৯৯২ সালের নীল স্টিফেনসনের 'স্নো ক্রাশ' উপন্যাসে প্রথম পরিচয় মেলে মেটাভার্স নামের বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পকাহিনীর জগতের। গ্রিক শব্দ 'মেটা'-র অর্থ ওপর বা পরে। মেটা এবং ইউনিভার্স শব্দযুগলের সমন্বয়ে হয়েছে মেটাভার্স। যার অর্থ দাঁড়ায়- পৃথিবীর বাইরের জগৎ। যেখানে সশরীরে উপস্থিতির বিপরীতে বাস্তবের মতো উপভোগ করা যাবে প্রায় সবকিছু।

বর্তমান সময়ের আলোচিত এই প্রযুক্তির ওপরেই দাঁড়াবে সমগ্র বিশ্বের নেটওয়ার্ক। সহজ কথায়, মেটাভার্স হবে ইন্টারনেট জগতের ভবিষ্যৎ। অতীতে ফিরে গেলেই অনুধাবন করা যায় কোথায় ছিল ওয়ান-জি যুগ আর কোথায় প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়েছে ফাইভ-জি যুগের। মেটাভার্স প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও তাই। যার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি, ফাইভ-জি নেটওয়ার্কসহ আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স (সংক্ষেপে 'এআই') ও মেশিন লার্নিং, অগমেন্টেড রিয়েলিটিসহ অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি।
আর এসব প্রযুক্তির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মেটাভার্সের দুনিয়ায় কী কী করা যাবে জানলে অবাক হওয়ার পাশাপাশি চিন্তার উদ্রেকও ঘটতে পারে মস্তিষ্কের অন্তরালে। কেন? স্বাভাবিকভাবে সবকিছু যত বেশি সহজলভ্য হয়ে উঠবে, তত বেশি হুমকির মুখে পড়বে মানবসভ্যতা। মেটাভার্সের আগমনের ফলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকেই পছন্দের দেশে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করা যাবে। অনলাইন শপিং করতে গেলে আপনার পছন্দের পোশাকটি ঘরে বসেই ট্রায়াল দিয়ে যাচাই করতে পারবেন অনায়াসেই। কিংবা আপনার বন্ধুদের সঙ্গে কোনো ট্যুরে সামিল হতে না পারলেও সোশাল মিডিয়ার ট্যাগ অপশনে এক ক্লিকেই মিলিত হতে পারবেন যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে। গাড়ি কেনার ক্ষেত্রেও এক স্থানে বসেই ড্রাইভিং করে দেখতে পারবেন কোনো ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই।
ফেসবুক ইতোমধ্যে মেটাভার্স নিয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। সেই অনুযায়ী পরীক্ষামূলক কার্যক্রমও এগিয়ে চলছে সমান তালে। তাদের উল্লেখযোগ্য ফিচারগুলো খুব শিগগিরই আলোড়ন সৃষ্টি করবে বলে ধারণা করছেন প্রযুক্তিবিদগণ। সেগুলো হলো-

হরাইজন ওয়ার্ল্ডস
গত বছর ডিসেম্বরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় উন্মোচন করে এই সেবা। যা বিনামূল্যে ১৮ ও তার বেশি বয়সের ব্যবহারকারীদের একই সময়ে ২০ জন মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত হতে সাহায্য করবে। করতে সক্ষম। এটি হবে আপনার ঘরের ভার্চুয়াল পরিবেশের অনুরূপ। যেখানে ভার্চুয়ালি আমন্ত্রণ জানাতে পারবেন আপনার বন্ধু-সহকর্মীদের, একসঙ্গে আড্ডা দিতে পারবেন, ভিডিও স্ট্রিমিং করতে পারবেন, খেলতে পারবেন নানা ধরনের গেমস। যার পুরোটাই ঘটবে বাস্তব জগতের মতোই।

হরাইজন ওয়ার্করুমস
কোভিড-১৯ এর সময়ে অনলাইন প্লাটফর্মগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে অফিস-আদালতের কার্যসম্পাদনে। সে কথা মাথায় রেখে আর ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রকে আরও বেশি উন্নততর রূপ প্রদানে ফেসবুকের মেটা নামক নতুন সংস্করণে রেখেছে ওয়ার্করুমস ফিচার। বর্তমানে যেসব দেশে ওকুলাস কুইস্ট-২ বিনামূল্যে ব্যবহারের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে সেসব দেশে ফেসবুক একাউন্ট ছাড়া ভিন্ন প্রফেশনাল একাউন্ট দিয়ে লগইন করে ঘরে বসেই কাজ করা যাবে অফিশিয়াল পরিবেশে। যেখানে ব্যবহৃত হয়েছে মিক্সড-রিয়েলিটি ডেস্ক ও কী-বোর্ড ট্র্যাকিং, হ্যান্ড ট্র্যাকিং, রিমোট ডেস্কটপ স্ট্রিমিং, ভিডিও কনফারেন্সিং ইন্টগ্রেশন, স্প্যাশিয়াল অডিও এবং ওকুলাস এভাটারস ইত্যাদি ফিচারসমূহ। যার ফলে মিটিং, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামসহ সকল কাজ সম্পাদন করা সম্ভব হবে সহকর্মীদের পাশাপাশি বসেই।

ফিটনেস ও ওয়েলনেস সার্ভিস
চারিদিকে সবকিছুই যখন অত্যাধুনিক তখন শরীরচর্চায় কেন হবে বিপরীত? এজন্য মেটা নিয়ে আসছে আধুনিক মানের সব সরঞ্জামের ভার্চুয়াল সংস্করণ। এজন্য সম্প্রতি মেটার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে 'উইদিন' ও 'সুপারন্যাচারাল' নামের ভিআরভিত্তিক ভার্চুয়াল ওয়ার্কআউট অ্যাপ্লিকেশন। যার ফলে ওকুলাসের হেডসেট ও বক্সিং গ্লাভস ব্যবহার করে প্রতিদিনকার ব্যায়াম সেরে নিতে পারবেন আপনার বাসায়, প্রয়োজন হবে না জিমনেশিয়াম আর প্রশিক্ষকের।

গেমিং
ভার্চুয়াল জগতের আরেকটি জনপ্রিয় ক্ষেত্র হতে যাচ্ছে গেমিং। গেম ডেভলপারদের মতে, 'মেটা ইজ আ গেম বিয়ন্ড দ্য গেম'। মেটার সংস্করণে গেমগুলোতে থাকবে থ্রি-ডি এক্সপিরিয়েন্সের সুযোগ। যার ফলে বাস্তবিক অনুভূতি পাওয়া যাবে গেমের অভ্যন্তরীণ পরিবেশে। ইতোমধ্যে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ মেটা গেমের মাধ্যমে ১০০ মিলিয়ন ডলার আয়ের আশা ব্যক্ত করেছেন।
প্রশ্ন করা যেতে পারে, মেটাভার্সের দুনিয়ায় কি শুধু ফেসবুক রাজত্ব করবে? না। ফেসবুকের পাশাপাশি মাইক্রোসফট, এনভিডিয়া, অ্যাপল, গুগল এবং গেমস নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান রোব্লক্স, এপিক গেমসও ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে নিজেদের মেটাভার্স তৈরিতে। সুদুরপ্রসারী উদ্যোগে গেম ও ভোক্তাপণ্য বিপণনকারী কোম্পানিগুলো বেশ তোড়জোড় করছে বলা চলে। ফোর্টনাইট নির্মাতা এপিক গেমস ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চলেছে তাদের মেটাভার্স প্রতিষ্ঠায়। আবার গত বছর জুন মাসে ইতালিয়ান ফ্যাশন হাউজ 'গুচি' রোব্লক্সের সঙ্গে ডিজিটাল পণ্য বিপণনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। তাছাড়া কোকাকোলা কোম্পানি 'ক্লিনিক' নামের মেটাভার্সে ডিজিটাল টোকেন বিক্রির কথা জানিয়েছে।
এ তো গেল মুদ্রার এপিঠ। অর্থাৎ মেটাভার্সের সুবিধা ও উদ্যোগের কথা। তারপর আসে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং নিরাপত্তার প্রশ্ন। বর্তমানে সোশাল মিডিয়ার প্রতি যেভাবে আসক্তি জন্মেছে, উন্নততর সংস্করণে এর ফলাফল ভয়াবহ হবে কি না তা এখন নির্ভর করছে সময়ের হাতে। আর নিরাপত্তা? কিছুদিন আগেই ফেসবুকের কিছু গোপন নথিপত্র প্রকাশ্যে আসার পরে জনমনে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। মেটাভার্স নামের প্রযুক্তির বদৌলতে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিয়েও সন্দেহ করছেন বিশ্লেষকরা। ধারণা মোতাবেক, বাস্তব জীবনের চেয়ে ভার্চুয়াল জগতেই দিনের ৮০ ভাগ সময় অতিবাহিত হবে। ফলে এই প্রযুক্তি ব্যবহারে আগের তুলনায় অধিক সম্পৃক্ততা থাকবে মানুষের সঙ্গে অনলাইন জগতের। ভেবে দেখুন, বর্তমানে স্বল্প তথ্যের মাধ্যমেই ফেসবুক যেভাবে বিজ্ঞাপনের পসরা সাজিয়ে বসেছে, ভবিষ্যতে যখন পুরো ব্যক্তিগত তথ্য দিয়েই চলবে তার ফলাফল কী হতে পারে? হ্যাঁ। এটাই হলো ফেসবুকের বিজনেস মডেল।

ভার্চুয়াল রিয়ালিটি বিশেষজ্ঞ ভেরিটি ম্যাকিনটোশের ভাষ্যমতে, ' ভিআর বা এআর প্রযুক্তিতে ফেসবুকের বড় বিনিয়োগের একটি বড় কারণ হলো 'গ্রাহক তথ্য'। কেন না এ ধরনের প্ল্যাটফর্ম থেকে বিপুল পরিমাণ তথ্য উপাত্ত হাতিয়ে নেওয়া যায়। মেটাভার্সের মাধ্যমে ফেসবুকসহ অন্যান্য কোম্পানিগুলো ভার্চুয়াল দুনিয়ায় নিজেদের উপনিবেশ বানিয়ে ফেলতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ম্যাকিনটোশ।
তবে তথ্য ব্যবসায়ীদের সোনার খনি এবং ইন্টারনেটের প্রাণ মেটাভার্সের আগমনের পথ কিছুটা বন্ধুর হতে পারে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে। ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক সম্বলিত অবকাঠামোর অভাব, হেডসেটের অধিক মূল্য, ডিভাইসের স্বল্পতার মতো নানা প্রতিবন্ধকতা সমাধানের পর দেখা মিলতে পারে বহুমাত্রিক যোগাযোগের হাতিয়ার মেটাভার্সের।
ফেসবুকের রিয়েলিটি ল্যাবসের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রো বোসওর্থ এবং ফেসবুকের গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিক ক্লেগ ব্লগ পোস্টে বলেন, 'মেটাভার্স একক কিছু নয়। এটি একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও তৈরি করা সম্ভব নয়। রাতারাতি তৈরিও হয়ে যাবে না। মেটাভার্স পরিপূর্ণতা পেতে সময় লাগবে আরও অন্তত ১০-১৫ বছর।'
তাছাড়া মেটাভার্সে আরও বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে বলে উল্লেখ করেছে মেটা কর্তৃপক্ষ। এ প্রযুক্তিকে কার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট শিল্পের অংশীদার, মানবাধিকার গোষ্ঠী, সরকার, অলাভজনক সংস্থা এবং একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের জন্য ৫ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে ফেসবুক। এ ছাড়া ইউরোপে মেটাভার্সের প্রসারে ১০ হাজার দক্ষ কর্মীও নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
Comments