ওটিটি প্ল্যাটফর্মের উত্থান ও টেলিভিশনের ভবিষ্যৎ
স্ট্রেঞ্জার থিংস, স্কুইড গেমস বা মুন নাইট; সময়ের জনপ্রিয় সব টিভি সিরিজই এসেছে ভিডিও স্ট্রিমিং প্লাটফর্মগুলো থেকে। নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন, ডিজনি প্লাস ও এইচবিও ম্যাক্স বিশ্বব্যাপী অন্যতম জনপ্রিয় স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম।
টেলিভিশন জগতের সর্বোচ্চ সম্মাননা, অ্যামি অ্যাওয়ার্ডসে অধিকাংশ পুরস্কার যাচ্ছে এসব স্ট্রিমিং প্লাটফর্মগুলোর ঝুলিতে। গতবছর অ্যামিতে নেটফ্লিক্স আর এইচবিওর জুলিতে গেছে যথাক্রমে ১২৯ ও ১৩০টি মনোনয়ন। সেখানে নামজাদা টেলিভিশন নেটওয়ার্ক এনবিসি ও সিবিএসের ভাগ্যে জুটেছে সর্বসাকুল্যে ৭২টি মনোনয়ন।
স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ দেখে সহজেই অনুমান করে নেওয়া যায় টেলিভিশনের ভবিষ্যৎ। শুধু টেলিভিশন না, অনেকে বলছেন সিনেমার ভবিষ্যতও স্ট্রিমিং সার্ভিসে। মানুষের সিনেমা হলে যাওয়ার প্রবণতা যে হারে হ্রাস পাচ্ছে, সেটা দেখে এই ভবিষ্যৎবাণীকে একেবারে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না।
কয়েক দশকের মধ্যে আমাদের বিনোদন জগতে এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা যাবে, সেটা কে-ই বা ভেবেছিলেন। যুগের গতিপথ বদলে দেওয়া এই বিপ্লবের সূচনা কারা করেছিল, সেটা নিশ্চয়ই জানেন। প্রতিষ্ঠানটির নাম নেটফ্লিক্স এবং ব্যক্তির নাম রিড হ্যাস্টিংস।
ডিভিডির মাধ্যমে শুুরু
নেটফ্লিক্সের শুরুটা হয়েছিল একটি ডিভিডি সরবরাহকারী কোম্পানি হিসেবে। ১৯৯৭ সালে। তখন থিয়েটার ছাড়া মানুষের সিনেমা দেখার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে দোকান থেকে ধার করা ভিডিও-টেপ। রিড হ্যাস্টিংস নামের এক প্রযুক্তি ব্যবসায়ী তখন পরিকল্পনা আঁটেন ডিভিডিতে করে সিনেমা বিক্রি করার। ডিভিডির রেজ্যুলুশন ভিডিও-টেপের চেয়ে অনেকগুণে ভালো এবং আকারেও ছোট।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সে সময়ে ডিভিডি প্লেয়ার মাত্রই আমেরিকার বাজারে আসা শুরু করেছে। ডিভিডি প্লেয়ার নেই এক শতাংশ মানুষের বাসাতেও। অনেক ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ হবে জেনেও রিড বাজিটা নিলেন। বন্ধু মার্ক র্যান্ডলফকে নিয়ে খুললেন একটি ডিভিডি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, যার নাম নেটফ্লিক্স।
হ্যাস্টিংস তার দূরদর্শিতার সুফল পান খুব দ্রুতই। যুক্তরাষ্ট্রে বছর খানেকের মধ্যেই ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে নেটফ্লিক্স। দিনে ১০ হাজারের মতো অর্ডার আসতে শুরু করে। চোখের পলকে কোম্পানির ৫০ লাখ ডলারের মতো আয় করে ফেলে।
এই শতাব্দীর শুরুর দিকে ডিভিডি প্লেয়ারের দাম কমা শুরু করে। যে কারণে বাড়তে থাকে নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয়তা ও আয়। পরবর্তীতে ওয়ালমার্ট এবং ব্লকবাস্টার্স নামে ২ কোম্পানি প্রতিযোগিতায় নামলেও তারা বেশিদিন টিকতে পারেনি। ডিভিডির বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা অব্যাহত রাখে নেটফ্লিক্স।
ভিডিও অন ডিমান্ড
২০০৭ সালে কোম্পানির দশম বছরে হ্যাস্টিংস আরেকটি দূরদর্শী প্রকল্পের ঘোষণা দেন। ইউটিউবের জনপ্রিয়তা দেখে তার মাথায় আসে, সিনেমার পরবর্তী মাধ্যম হতে যাচ্ছে ইন্টারনেট। সুতরাং তিনি নেটফ্লিক্সের একটি 'ভিডিও অন ডিমান্ড' ওয়েবসাইট খোলার সিদ্ধান্ত নেন। যেখানে গ্রাহকরা চাইলেই তাদের প্রিয় সিনেমা স্ট্রিম করতে পারবেন। প্রথমদিকে এই ওয়েবসাইট পুরোপুরি ফ্রি ছিল। যেহেতু নেটফ্লিক্সের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য সেই সময়ে কোনো সিনেমার সত্ত্ব কেনা বেশ দুরূহ ব্যাপার ছিল, তাই তাদের সংগ্রহের অবস্থাও ছিল করুণ। ভালো মানের সিনেমা ছিল না বললেই চলে।
তবে ধীরে ধীরে বড় স্টুডিওগুলোর সঙ্গে চুক্তি করতে শুরু করে নেটফ্লিক্স। তাদের ওয়েবসাইটে যোগ হতে থাকে সনি, ডিজনি, প্যারামাউন্ট, এমজিএম, লায়ন্সগেটের মতো বড় বড় কোম্পানির কন্টেন্ট।
প্রচার খাতেও কম যায়নি নেটফ্লিক্স। বিনোদন জগতের বড় বড় ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে জুটিবদ্ধ হতে শুরু করে কোম্পানিটি। এক্সবক্স, প্লে-স্টেশন থেকে শুরু করে অ্যাপল; বাদ যায়নি কিছুই।
একচেটিয়া ব্যবসার সুফলও পাচ্ছিল নেটফ্লিক্স। প্রতিষ্ঠার ৩ বছরের মাঝে, ২০১০ সালে এসে দেখা যায়— যুক্তরাষ্ট্রে পিক আওয়ারে সমস্ত ইন্টারনেট ট্রাফিকের এক তৃতীয়াংশই দখল করে রাখছে নেটফ্লিক্স।
সেবছরই নেটফ্লিক্স প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে পা রাখে। তাদের সেবা পৌঁছায় কানাডায়। পরের বছর ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ানে পৌঁছে। ২০১২ সালে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছায় নেটফ্লিক্স।
হাউজ অব কার্ডস: নতুন যুগের শুরু
তর্ক-সাপেক্ষে নেটফ্লিক্সের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি আসে ২০১১ সালে।
নেটফ্লিক্সের তখন একরকম সর্বেসর্বা। নিজেদের বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা করা নেটফ্লিক্সের কাছে সব স্টুডিও নির্দ্বিধায় তাদের সিনেমা এবং টিভি-সিরিজের সত্ত্ব বিক্রি করে যাচ্ছে। নেটফ্লিক্সের অপর নামই হয়ে উঠছে অনলাইন স্ট্রিমিং। তখন হুট করে হ্যাস্টিংসের মাথায় 'ভূত' চাপে মৌলিক কনটেন্ট বানানোর। যেই কথা, সেই কাজ!
১০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে নেটফ্লিক্স হাতে নেয় রাজনীতিকেন্দ্রিক টিভি সিরিজ 'হাউজ অব কার্ডস'-এর প্রকল্প। পূর্ণ সৃজনশীল স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বোর্ডে আনে কিংবদন্তি পরিচালক ডেভিড ফিঞ্চারকে। সেই সঙ্গে শুরু হয় এক নতুন যুগ।
এখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, এমনিতে শত শত কনটেন্টে সমৃদ্ধ নেটফ্লিক্সে এক হাউজ অব কার্ডস কী-ই বা এমন তফাৎটা তৈরি করেছে!
তফাৎ মূলত তৈরি করেছে 'মৌলিক' বুলিটা। এই 'নেটফ্লিক্স অরিজিনাল'-এর মাধ্যমেই স্ট্রিমিং সার্ভিসের পাশাপাশি একটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নেটফ্লিক্স। বর্তমানে নেটফ্লিক্সের আয়ের মূল উৎস এই মৌলিক কনটেন্টগুলোই।
ভুল বললাম! নেটফ্লিক্সের আয়ের প্রধান উৎস আসলে এর সাবস্ক্রাইবাররা। ৮ থেকে ১২ ডলারের যে মাসিক ফি আপনি দিচ্ছেন, সেখান থেকেই আসছে নেটফ্লিক্সের মূল রাজস্ব (২০২১ সালে যা ছিল ৩০ বিলিয়ন ডলার)। তাই সাবস্ক্রাইবার যত বাড়বে, তাদের আয়ও তত বাড়বে। প্রতিযোগিতামূলক এই বাজারে সাবস্ক্রাইবার বাড়াতে বা ধরে রাখতে হলে ভালো মানের মৌলিক কনটেন্টের কোনো বিকল্প নেই। কেন না, তাদের তৈরি সাড়া জাগানো এই সিনেমা বা সিরিজগুলো নেটফ্লিক্স ছাড়া আর কোনো প্লাটফর্মে দেখতে পারবে না দর্শক।
হাউজ অব কার্ডসের পথ ধরে নেটফ্লিক্স তৈরি করেছে অ্যারেস্টেড ডেভেলপমেন্ট, অরেঞ্জ ইজ দ্য নিউ ব্ল্যাক, নার্কোস, দ্য ক্রাউন ও স্ট্রেঞ্জার থিংসের মতো সিরিজ।
হাউজ অব কার্ডসের কৃতিত্ব এখানেই শেষ না। ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাওয়া হাউজ কার্ডসের প্রথম সিজনের সব কটি এপিসোড একই সঙ্গে আপলোড করা হয়েছিল নেটফ্লিক্সের ওয়েবসাইটে। প্রতি সপ্তাহে একটি এপিসোড মুক্তি দেওয়ার রীতি থেকে বের হয়ে দর্শকদের এক বসায় পুরো সিজন দেখার সুযোগ করে দেয় নেটফ্লিক্স। বর্তমানে এক বসায় অনেকগুলো এপিসোড বা পুরো সিজন দেখার এই জনপ্রিয় রীতিকে মজা করে বলা হয় 'বিঞ্জ ওয়াচিং'।
হাউজ অব কার্ডসের মাধ্যমে নেটফ্লিক্স দুটি বার্তা পাঠিয়েছিল। এক, তাদের প্লাটফর্মে নির্মাতারা পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে। দুই, যেকোনো বড় প্রজেক্ট পরিচালনা করার জন্য অর্থের যোগান তারা দিতে পারবে। ডেভিড ফিঞ্চার, কেভিন স্পেসিদের এই সিরিজ দর্শক-সমালোচক দুই মহলেই নন্দিত হওয়ায় অন্যান্য নির্মাতা, অভিনেতারাও নেটফ্লিক্সের হয়ে কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত হতে শুরু করেন।
টেলিভিশনের ভবিষ্যৎ
প্রায় নেটফ্লিক্সের সমসাময়িক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছিল অ্যামাজন প্রাইম এবং হুলু। কিন্তু তাদের বাজার এবং সংগ্রহশালা ছিল সীমিত। আর নেটফ্লিক্সের সমান ঝুঁকি নেওয়ার সাহসও কখনোই দেখায়নি তারা। যার ফলে আরও কিছুকাল অব্যাহত থাকে নেটফ্লিক্সের একচেটিয়া ব্যবসা।
তবে ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয়তা দেখে বিনোদন জগতের হর্তাকর্তারা নিশ্চিত হয়ে যান, অনলাইন স্ট্রিমিংই টিভির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। তারা বুঝতে পারেন যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করতে পারলে টেলিভিশনের ভবিষ্যৎ হয়ে যাবে শুধুই নেটফ্লিক্স।
এ সময়ে ইউটিউব এবং ফেসবুকও তাদের নিজস্ব স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। নড়েচড়ে বসে নেটফ্লিক্সের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যামাজন প্রাইম ও হুলু। বাজেট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় এই ২ প্রতিষ্ঠান। তাদের সংগ্রহশালায় যোগ হতে থাকে নামি দামি সব কন্টেন্ট।
গত ৩-৪ বছরে আরও ডজন খানেক নেটওয়ার্ক নাম লিখিয়েছে এই স্ট্রিমিং জগতে। ডিজনি প্লাস, এইচবিও ম্যাক্স, পিকক, স্লিং ও ফুবো তাদের মধ্যে অন্যতম।
বর্তমানে বিশ্বের ১৯০টিরও বেশি দেশে সম্প্রচারিত হয় নেটফ্লিক্স। ডার্ক (জার্মান), স্যাক্রেড গেমস (হিন্দি), এলিট (স্প্যানিশ)-এর মতো সিরিজগুলো দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল ও ভাষাভাষী দর্শকের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে নেটফ্লিক্স। সাফল্যও পাচ্ছে।
তবে নেটফ্লিক্স একা না; এইচবিও ম্যাক্স, ডিজনি প্লাসও তাদের বৈশ্বিক বাজার বিস্তৃত করে চলেছে। অ্যামাজন প্রাইম ইতোমধ্যে নেটফ্লিক্সের সঙ্গে একরকম প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে বৈশ্বিক বাজারে। মুভি, সিরিজের পাশাপাশি স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলোতে জায়গা করে নিচ্ছে খেলাধুলা, টক শো, রিয়েলিটি শোর মতো কনটেন্ট। অচিরেই হয়তো বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হয়ে উঠবে স্ট্রিমিং সার্ভিস।
জরিপ অনুযায়ী, গড়পড়তা মার্কিনিরা এখন টিভির চেয়ে স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলোতে বেশি সময় ও অর্থ ব্যয় করে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র না, প্রথম বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ধীরে ধীরে টিভির স্থান দখল করছে স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলো। গতানুগতিক টিভি চ্যানেলগুলোও পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে খুলছে নিজেদের স্ট্রিমিং সার্ভিস। আমাদের দেশেও কিন্তু দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে স্ট্রিমিং সার্ভিস। পাশের দেশে হটস্টার, হইচইয়ের সাফল্যের পর বাংলাদেশেও এখন এই মডেলের কিছু স্ট্রিমিং সার্ভিস আত্মপ্রকাশ করেছে। বঙ্গ, বায়স্কোপ, চরকি তাদের মধ্যে অন্যতম।
মিডিয়ার সদা-পরিবর্তনশীল এই বাজারে কখনোই নিশ্চিতভাবে বলা যায় না ভবিষ্যৎ কেমন হবে। তবে, নেটফ্লিক্সের কারণে আমাদের বিনোদন গ্রহণের মাধ্যম যে চিরতরে বদলে গেছে, তা বলে দেওয়া যায়। গত এক দশকে বিনোদন জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা এই স্ট্রিমিং সার্ভিসের দেখানো পথে অন্তত আরও কয়েকবছর হাঁটবে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো।
Comments