স্যাটেলাইটের প্রয়োজনীয়তা ও অনুপস্থিতিতে যা ঘটবে পৃথিবীতে

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, আবহাওয়াসহ পৃথিবী ও মহাকাশের রহস্য উদঘাটনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে স্যাটেলাইট। তবে স্যাটেলাইটেরও রয়েছে বেশ কিছু নেতিবাচক দিক। যার মধ্যে নজরদারি, কক্ষপথকে ঝুঁকিপূর্ণ করা, মহাকাশের পরিবেশ দূষণ অন্যতম। 
পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে সহস্রাধিক স্যাটেলাইট। ছবি: নাসা অবজারভেটরি

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, আবহাওয়াসহ পৃথিবী ও মহাকাশের রহস্য উদঘাটনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে স্যাটেলাইট। তবে স্যাটেলাইটেরও রয়েছে বেশ কিছু নেতিবাচক দিক। যার মধ্যে নজরদারি, কক্ষপথকে ঝুঁকিপূর্ণ করা, মহাকাশের পরিবেশ দূষণ অন্যতম। 

এ ছাড়া স্নায়ুযুদ্ধ থেকে শুরু হওয়া মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় এসব কৃত্রিম উপগ্রহ হতে পারে অতি ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্র। 

কৃত্রিম উপগ্রহটা আসলে কী? কীভাবে তা কাজ করে? বর্তমান বিশ্বের এর প্রয়োজনীয়তা বা অবদান কী? কেন ই বা একে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবা হচ্ছে? এর অনুপস্থিতিতে মানবজীবনে কী প্রভাব পড়বে? 

ছবি: সংগৃহীত

স্যাটেলাইট কী?

ষোল শতকের মাঝামাঝি সময়ে ল্যাটিন স্যাটেলেস শব্দ থেকে উৎপত্তি হয় স্যাটেলাইট শব্দের। যার অর্থ উপগ্রহ। নাসার একটি তথ্যসূত্রে জানা যায়, স্যাটেলাইট হচ্ছে এমন একটি বস্তু যা অন্য একটি বড় বস্তুর চারপাশে ঘোরে। এই অর্থে পৃথিবীও একটি স্যাটেলাইট, কারণ এটা সূর্যকে কেন্দ্র করে চারদিকে ঘূর্ণায়মান। আর চাঁদ তো পৃথিবীর উপগ্রহই, যা পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। পৃথিবী এবং চাঁদকে বলা হয় প্রাকৃতিক 'উপগ্রহ'। 

স্যাটেলাইট সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা মূলত কৃত্রিম উপগ্রহকেন্দ্রিক। যে উপগ্রহ মানুষের তৈরি এবং যেটা পৃথিবী থেকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়। যা পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরে কিংবা কাঙ্ক্ষিত তথ্য আহরণের উদ্দেশ্যে মহাকাশের অন্য কোথাও ভ্রমণ করে। এগুলো সাধারণত পৃথিবী, অন্য গ্রহ-উপগ্রহ কিংবা মহাকাশের রহস্যময় নক্ষত্রপুঞ্জ বা ছায়াপথের ছবি তুলে পাঠায়। ছবিগুলো বিজ্ঞানীদের পৃথিবী, সৌরজগত এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে৷ কিছু স্যাটেলাইট সিগনাল পাঠানোর মাধ্যমে মোবাইল ফোন, টেলিভিশন চ্যানেল ও ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে সচল রাখার কাজে ব্যবহৃত হয়। 

১৯৫৭ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) স্পুটনিক-১ নামে বিশ্বের প্রথম স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠায়। এর পর থেকে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে পৃথিবী থেকে কয়েক হাজার স্যাটেলাইট পাঠানো হয়েছে। ২০১৮ সালে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে 'বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১' নামে একটা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে বাংলাদেশ। বিবিসির একটা তথ্যসূত্রে জানা যায়, দ্বিতীয় স্যাটেলাইট পাঠানোর জন্যে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি ইতোমধ্যেই রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত মহাকাশ সংস্থা রসকসমস-এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান গ্লাভকসমস-এর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। 

ছবি: সংগৃহীত

স্যাটেলাইটের গঠন ও প্রকারভেদ

ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে স্যাটেলাইট বিভিন্ন নকশায় ও আকারে তৈরি করা হয়। পৃথিবীপৃষ্ঠ, জল ও বাতাসসহ মহাকাশের গবেষণার কাজে অনেক স্যাটেলাইটে ক্যামেরা, বৈজ্ঞানিক সেন্সর, টেলিস্কোপসহ বিশেষ যন্ত্রপাতি সংযুক্ত করা হয়। তবে, এর মূল অংশ হচ্ছে দুটি। একটি হচ্ছে এন্টেনা, যা মূলত তথ্য বা সিগনাল গ্রহণ ও প্রেরণের কাজে লাগে। অন্যটি হচ্ছে শক্তির উৎস, যা আসে ব্যাটারি বা সৌর শক্তি থেকে। বেশিরভাগ স্যাটেলাইটের জীবদ্দশায় অবিরাম চলতে হয়, তাই এর শক্তির উৎস ও এন্টেনার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হয়। 

কক্ষপথের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে এবং গতিশীল থাকতে রকেটসহ প্রপালশন পদ্ধতি থাকে। স্যাটেলাইটকে সাধারণত হাল্কা, দ্রুতগতির এবং মজবুত হতে হয়। কারণ, উৎক্ষেপণের সময় স্যাটেলাইট বহনকারী রকেটকে অন্তত ঘণ্টায় ২৮ হাজার কিলোমিটার বেগে উঠতে হয়, যাকে কক্ষপথের বেগ ও বলা হয়। এই গতিতে যে শক তৈরি হয় এবং মহাকাশের প্রতিকূল পরিবেশ, বিকিরণ, ও তাপ সহ্য করতে হয় তার জন্যে স্যাটেলাইটকে অনেক মজবুত করতে হয়। স্যাটেলাইট হালকা রাখার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যয় কমানো। যেহেতু পুরো প্রক্রিয়াটাই অনেক বেশি ব্যয়বহুল। 

ছবি: সংগৃহীত

স্যাটেলাইট মূলত ২ প্রকার। আমাদের সৌরজগতে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান গ্রহগুলো এবং এসব গ্রহকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান উপগ্রহগুলো হচ্ছে প্রাকৃতিক স্যাটেলাইট। মানবসৃষ্টগুলো হচ্ছে কৃত্রিম উপগ্রহ। কৃত্রিম উপগ্রহ অনেক ধরনের হয়ে ঠাকে। যার মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যা, বায়োস্যাটেলাইট, যোগাযোগ, পৃথিবী পর্যবেক্ষণ, নেভিগেশন, সামরিক, বাণিজ্যিক, আবহাওয়া, পুনরুদ্ধার, অনুসন্ধানীসহ আরও বেশ কিছু ধরন আছে। অধিকাংশ স্যাটেলাইট যাত্রীহীন হয়ে থাকে।

তবে, বেশ কিছু স্যাটেলাইট আছে যা যাত্রী বহন করে থাকে। এদের মূল কাজ হচ্ছে পৃথিবী থেকে মহাকাশচারীদের নিয়ে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে (আইএসএস) যাওয়া এবং সেখান থেকে ফেরত আনা। আমেরিকার নাসা, রাশিয়ার রসকসমস, জাপানের জাক্সা, ইউরোপের ইএসএ, ও কানাডার সিএসএ-এর সমন্বিত ব্যবস্থায় পরিচালিত মহাকাশে বসবাসযোগ্য একটা স্যাটেলাইট। যা মূলত মহাকাশ গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও চাঁদ ও মঙ্গলে অভিযান পরিচালনার কাজ করে।  

স্যাটেলাইটের গুরুত্ব

ছয় দশকের বেশি সময় ধরে মানব জীবনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা রেখে চলেছে স্যাটেলাইট। তবে, এর প্রত্যক্ষ সুবিধা ভোগ হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থায়। সমস্ত পৃথিবীকে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত করেছে স্যাটেলাইট। গেল শতকের টেলিভিশন চ্যানেল, ইন্টারনেট ব্যবস্থা আবিষ্কার ও জনপ্রিয়তার পেছনে এর ভূমিকা অনেক। সম্পূর্ণ স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল জিপিএস এখন মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। 

সামরিক ক্ষেত্রেও এর রয়েছে ব্যাপক ব্যবহার। উন্নত দেশগুলো তাদের সামরিক বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি, শত্রু রাষ্ট্র, সন্ত্রাসী বাহিনী, উগ্রপন্থী, পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণকেন্দ্রসহ সামরিক নানান কাজে স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে। এ ছাড়া ওজন স্তরসহ বায়ুমণ্ডলের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের গবেষণার মূল উৎস হচ্ছে স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য। পৃথিবীর যাবতীয় উপাদানসহ সৌরজগৎ ও মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণার জন্যে মুখ্য ভূমিকা রাখছে এই প্রযুক্তি। 

ছবি: সংগৃহীত

এনবিসি নিউজের একটি প্রতিবেদন সূত্রে, স্যাটেলাইট প্রযুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ। এই প্রযুক্তির ফলে আগে থেকেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা সম্ভব হয়েছে, ফলে গত ৬ দশকে অন্তত হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বেঁচেছে। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। এক সময় মানুষ ঘুমন্ত অবস্থায় ঝড়ের কবলে পড়তো। ফলে, বাঁচার সুযোগ কমে আসতো, এখন আগে থেকেই অধিকাংশ দুর্যোগের ব্যাপারে জানা যায়। ফলে, নিরাপদে যাওয়ার সুযোগ পায়। 

স্যাটেলাইটহীন পৃথিবী

১৯৫৭ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১১ হাজার স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করেছে বলে জানাচ্ছে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম। আর এই সংখ্যাটা সম্প্রতি জ্যামিতিক হারে বেড়েছে, বিশেষ করে স্পেসেক্সর মতো প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাবে মহাকাশ নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্কের স্টারলিংক প্রজেক্টের মাধ্যমে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে মহাকাশে ৪২ হাজার স্যাটেলাইট পাঠানো হবে বলে জানায় বিজনেস ইনসাইডার।

মহাকাশ দূষণ

ভূ-পৃষ্ঠের উৎসসমূহ ধ্বংসের পরে মানুষ মহাকাশের পরিবেশ ও নষ্ট করে ফেলছে। ইতোমধ্যে যতগুলো স্যাটেলাইট পাঠানো হয়েছে তার ধ্বংসাবশেষের কারণে মহাকাশ দূষিত হয়ে গেছে। এসব স্যাটেলাইট থেকে সৃষ্ট অন্তত ১০০ টন ধ্বংসাবশেষ প্রতিবছর পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। এরপর, স্পেসএক্সের প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হলে এই সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। ভূ-পৃষ্ঠের পরিবেশের মতো মহাকাশের পরিবেশ ও ধ্বংস হয়ে যাবে। 

ছবি: সংগৃহীত

স্যাটেলাইট আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করে ফেলেছে। আচমকা যদি স্যাটেলাইটগুলো ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে পুরো পৃথিবীর মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ধস নামবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে যাবে, অনলাইন ব্যাংকিং, এটিএম ব্যাংকিং বন্ধ হয়ে যাবে। আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। জাহাজ, বিমান চলাচল কঠিন হয়ে যাবে। ইন্টারনেট, টেলিভিশন, রেডিও নেটওয়ার্ক অচল হয়ে যাবে। জিপিএস ছাড়া চলতে হবে।

এক কথায় বলতে গেলে, স্যাটেলাইট ছাড়া মানব সভ্যতা এক ধাক্কায়  মধ্যযুগে চলে যাবে। ফিরে যাবে ১৮ শতক বা তারও আগে। বিপুল সংখ্যক স্যাটেলাইটের ধ্বংসাত্মক পরিণতি বায়ুমণ্ডলের পাশাপাশি বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকির। এ ছাড়া, অনেক স্যাটেলাইট পারমাণবিক শক্তি চালিত, যার কয়েকটা আন্তঃ-মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র। সেসব যদি বিধ্বস্ত হয়ে কোথাও পড়ে, তবে সেই স্থান তেজস্ক্রিয় হয়ে যাবে, এমনকি পুরো পৃথিবীও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। 

তথ্যসূত্র: 

নাসা, এনবিসি নিউজ, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম, বিজনেস ইনসাইডার, বিবিসি, হোয়াট ইফ

Comments

The Daily Star  | English

Rain, at last, in some parts of Dhaka

After a month-long severe heatwave, Dhaka experienced rain and thundershowers in parts of the capital last night

1h ago