মহামারিতে থমকে আছে জোবাইকের চাকা

ছবি: সংগৃহীত

করোনাভাইরাস মহামারিতে বড় ধরনের সংকটে পড়েছে বাইসাইকেল ভাড়া দেওয়া প্রতিষ্ঠান জোবাইক। দীর্ঘদিনেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রমের একটি বড় অংশই বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে।

গত বছরের মার্চে বাংলাদেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে কার্যক্রম সীমিত করে জোবাইক। সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে বারবার লকডাউন ও জনসাধারণের চলাচলে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়ে জোবাইকের ব্যবসায়। মহামারির আগে দেশের ছয়টি জায়গায় জোবাইকের কার্যক্রম থাকলেও এখন চালু আছে মাত্র দুটি এলাকায়। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটির আয় কমে অস্তিত্বের সংকট তৈরি হয়েছে।

নির্দিষ্ট এলাকাগুলোতে মোবাইল ফোনে একটি অ্যাপ দিয়ে জোবাইকের বাইসাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। এই সেবা চালু করার পর খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। সুলভ, সুস্বাস্থ্য সহায়ক ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প বাহন হিসেবে জোবাইকের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়।

জোবাইকের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেদী রেজা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ‘অ্যাপটি জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল। সেই সঙ্গে আমাদের বাইকের সংখ্যা ও কার্যক্রমের পরিধি বাড়ছিল। মহামারি সেটা থমকে দিয়েছে।’

পাঠাওয়ের মাধ্যমে রাইড শেয়ারিং সেবা বাংলাদেশে প্রথম চালু হয় ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে। এর কয়েক মাস পরে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান উবার ঢাকার রাস্তায় কার্যক্রম শুরু করে। বাংলাদেশে অন্যান্য রাইড শেয়ারিং সেবাগুলোর মধ্যে চালু আছে ওভাই। তবে বাইসাইকেল ভাড়ার জন্য জোবাইক প্রথমবারের মতো এ ধরনের অ্যাপ নিয়ে আসে।

বর্তমান সংকটে টিকে থাকার জন্য জোবাইক তাদের ৭৫ শতাংশ কর্মী ছাটাই করতে বাধ্য হয়েছে। মহামারির আগে প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৫ জন কর্মী ছিলেন, এখন সংখ্যাটি কমে হয়েছে মাত্র ১২।

রেজা বলেন, ‘আমরা আমাদের ব্যবসায়িক মডেলে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। আরও অভিনব সেবা নিয়ে আসার জন্য কাজ করছি, যাতে করে মহামারির মধ্যেও আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারি।’

তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পরিবর্তে জোবাইক এখন আবাসিক এলাকাগুলোতে প্রসারের দিকে জোর দিচ্ছে।

রেজা ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জোবাইক প্রতিষ্ঠা করতে চীনের সবচেয়ে বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবার চাকরি ছেড়ে দেন। একই বছরের ১৮ জুন কক্সবাজারে প্রথম চালু হয় জোবাইক।

মাত্র ২০টি বাইসাইকেল নিয়ে যাত্রা শুরু করার কয়েক মাস পরেই জোবাইক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে ঢাকায় কিছু জায়গায় কার্যক্রম শুরু করে জোবাইক। ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রতি পাঁচ মিনিটের জন্য তিন টাকা এবং অন্যান্য এলাকায় মিনিটে এক টাকা করে ভাড়া লাগে জোবাইকের বাইসাইকেল ব্যবহারে। অ্যাপ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই টাকা পরিশোধ হয় যায়।

২০২০ সালের জুনের মধ্যে জোবাইকের সাইকেলের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে যায়। কার্যক্রম চালু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মিরপুর ডিওএইচএস ও গুলশান এলাকায়। ঢাকার বাইরে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জোবাইকের চাকা ঘুরতে শুরু করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজিদা ইসলাম শ্রাবণী হল থেকে ক্লাসে যাওয়া-আসার জন্য প্রতিদিন দুই বার জোবাইক ব্যবহার করতেন। নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বাইসাইকেলে সময় ও টাকা বাঁচত। এটা ব্যবহার করাও খুব সহজ ছিল। রিকশার ওপরও নির্ভরতা কমছিল।’

জোবাইকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এখন মাত্র দুটি এলাকায় তাদের কার্যক্রম চলছে—মিরপুর ডিওএইচএস ও গুলশান।

তবে সম্প্রতি এই প্রতিবেদক গুলশান এলাকায় গিয়ে জোবাইকের কোনো বাইসাইকেল খুঁজে পাননি কোথাও। এমনকি, অ্যাপে ‘রিফিল পয়েন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত স্থানে গিয়েও কোনো বাইসাইকেল দেখা যায়নি।

কয়েকজন এলাকাবাসী দ্য ডেইলি স্টারকে জানান তারা গত কয়েক সপ্তাহে কাউকে জোবাইক ব্যবহার করতে দেখেননি।

মিরপুর ডিওএইচএসের দুজন বাসিন্দাও একই কথা জানান।

তবে জোবাইকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় তারা গুলশানের কার্যক্রম আংশিকভাবে বন্ধ রেখেছেন।

মহামারিতে বসে থেকে মরিচা ধরে অনেকগুলো বাইসাইকেলের ক্ষতি হয়েছে।

মেহেদী রেজা জানান, ‘মহামারিতে ক্যাম্পাসের মাঠে পড়ে থেকে মরিচা ধরে প্রায় ১৪০টি বাইসাইকেলের ক্ষতি হয়েছে।’

জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা অবস্থায় জোবাইক দৈনিক এক লাখ রাইড সেবা দিয়েছে মানুষকে। ২০১৯ এর অক্টোবরে প্রতিষ্ঠানটি প্রথম যখন তাদের সেবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করেছিল, তখনই তারা ব্রেক-ইভেন পয়েন্টে পৌঁছে যায়। এরপর আঘাত হানে মহামারি।

মন্দার সময়টাতে ব্যবসা চালু রাখতে ‘জোডেলিভারি’ সেবা চালু করেছিল জোবাইক। কিন্তু ছয় মাস চলার পরও সাফল্য না পাওয়ায় সেবাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

রেজা বলেন, ‘আমরা এখন তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছি। আমাদের একটি বিনিয়োগ নিশ্চিত হয়েছে, যেটি এখন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এতে আমরা শহরে আরও বাইসাইকেল নামাতে পারব।

এই মুহূর্তে গুলশানে ৩৫ হাজার ও মিরপুরে ছয় হাজার নিবন্ধিত জোবাইক ব্যবহারকারী আছে। মহামারির আগে গুলশানে দৈনিক এক হাজার থেকে দেড় হাজার ও মিরপুরে ৬০০ রাইড পরিচালনা করতো প্রতিষ্ঠানটি।

২০১৮ সালের ২৯ এপ্রিল অ্যাপটি গুগলের প্লে স্টোরে অবমুক্ত করার পর থেকে এ বছরের ১২ জুলাই পর্যন্ত অন্তত ১০ লাখ মানুষ অ্যাপটি ইন্সটল করেছেন।

রেজার মতে, জোবাইক ব্যবহার করার কারণে গত আড়াই বছরে বায়ুমণ্ডলে আট লাখ ৭৫ হাজার পাউন্ড কার্বন ডাই অক্সাইড কম নিঃসরণ হয়েছে।

‘মহামারি মানুষকে প্রকৃতি ও তার কল্যাণের কথা বেশি করে ভাবতে বাধ্য করছে। তাই আমরা মনে করি মহামারি পরিস্থিতির উন্নতি হলে জোবাইক আবারও শক্তি নিয়ে ফিরে আসবে, কারণ ব্যবহারকারীরা প্রায়ই আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন কবে থেকে আমরা আবার পুরোদমে সেবাগুলো চালু করব’, বলেন রেজা।

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

2h ago