ঈদে ক্রেতার আস্থা চট্টগ্রামের ‘মেড ইন খলিফাপট্টি’

বংশপরম্পরা কাজ শিখেছেন খলিফাপট্টির কারিগররা। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

ছোট ছোট কক্ষে ৪-৫টি করে সেলাই মেশিন, আট-দশেক মানুষ। রাত-দিন মেশিনের শব্দ। ঈদের আগে চট্টগ্রামের খলিফাপট্টির পরিচিত দৃশ্য এমনই।

নগরীর আন্দরকিল্লাহর পাশে ৬ দশক আগে গড়ে উঠেছিল থান কাপড় ও সেলাইয়ের এ মার্কেটটি। ছোট ও মাঝারি ৪ শতাধিক দোকানে প্রায় ৩ হাজার কর্মচারীদের বিরামহীন ব্যস্ততায় চলছে ক্রেতাদের ঈদের পোশাক তৈরির কাজ।

ঢাকার ইসলামপুর ও চট্টগ্রামের টেরিবাজার থেকে থান কাপড় সংগ্রহ করে নিজস্ব ডিজাইনে সব বয়সের চাহিদা অনুযায়ী কাপড় প্রস্তুত করে দেওয়ার জন্য বিখ্যাত খলিফাপট্টি। বিশেষ করে নারী ও ছোটদের কাপড় বিক্রি হয় বেশি।

বংশপরম্পরা কাজ শিখেছেন এখানকার কারিগররা। নিজস্ব ডিজাইনের কাপড়ের পাশাপাশি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী হালের ফ্যাশন 'পুষ্পা' ও 'কাচা বাদাম' ডিজাইনেও জামা তৈরিতে সিদ্ধহস্ত তারা। যে কোনো ডিজাইন একবার দেখলে তা সুঁই-সুতায় কাপড়ে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন।

সম্প্রতি সরেজমিনে খলিফাপট্টি গিয়ে দেখা যায়, দোকানে একপাশে ক্রেতাদের পছন্দ মতো কাপড় দেখাচ্ছেন বিক্রয় কর্মীরা। কারিগরদের কেউ কাপড় কাটছেন, কেউ সেলাই করছেন, কেউ আবার ব্যস্ত কাপড় ইস্ত্রি করা নিয়ে।

বিরামহীন ব্যস্ততায় চলছে ঈদের পোশাক তৈরির কাজ। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

থান কাপড়ের পাশাপাশি তৈরি পোশাকও বিক্রি হয় এসব দোকানে। তৈরি পোশাকের মধ্যে আছে থ্রিপিস, লেহেঙ্গা, স্কার্ট, শাড়ি, পাঞ্জাবি, পায়জামা ও বিভিন্ন বয়সের বাচ্চাদের জামা।

কর্মচারীরা জানান, বছরের সবসময় ব্যস্ততা থাকলেও ঈদের আগে ব্যস্ততা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সকাল ১০টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা ও সেলাইয়ের কাজ। প্রতিটি দোকানে ২টি থেকে ২০টি পর্যন্ত সেলাই মেশিন থাকে। সেখানে ২ শিফটে কাজ করেন মালিক ও কর্মচারীরা।  যেসব কাপড়ে পুঁথি ও পাথরের কাজ থাকে তার জন্য আছেন আলাদা কারিগর।

চট্টগ্রাম জেলা ছড়াও আশপাশের জেলা শহর ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, সিলেট, কক্সবাজার, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি থেকে অনেক ব্যবসায়ীরা খলিফাপট্টির ডিজাইন ও সেলাই করা কাপড় কিনে যান।

ঈদের ২-৩ মাস আগে থেকেই ক্রেতাদের আনাগোনা বাড়তে থাকে বলে জানান কর্মচারীরা।

নূর ফ্যাশনের সত্ত্বাধিকারী আলম হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খলিফাপট্টির কাপড় ও সেলাইয়ের আলাদা একটা কদর আছে। এখানে আমরা তিন প্রজন্ম ধরে ব্যবসা করছি। প্রতিনিয়ত আমরা নতুন নতুন ডিজাইনের কাপড় তৈরি করে থাকি।'

'এখানকার কারিগররা দীর্ঘদিন কাজ করার কারণে নিজেরাই এসব ডিজাইন করতে পারেন। একইসঙ্গে হালের জনপ্রিয় বিভিন্ন ডিজাইনও আমরা অনুসরণ করি। তাছাড়া ক্রেতাদের দেওয়া স্যাম্পল অনুযায়ীও ডিজাইন করা হয়,' বলেন তিনি।

ঈদের আগে ক্রেতারা মার্কেটে আসছেন তাদের পছন্দের পোশাক কিনিতে। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

ফাইভ স্টার গার্মেন্টসের সত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ রাসেল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খলিফাপট্টির পোশাক কারখানাগুলোর বিশেষত্ব কম খরচে রুচিশীল পোশাক তৈরি। নূন্যতম ১৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকায় এখানে পোশাক তৈরি হয়। এখানে আলাদাভাবে কাটিং মাস্টার, ডিজাইনার না থাকার কারণে সাশ্রয়ী মূল্যে পোশাক বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'যে কোনো ডিজাইন একবার দেখলেই আমরা অবিকল সে ডিজাইনের পোশাক তৈরি করতে পারি। নিজেরাই ডিজাইনার, নিজেরাই কারিগর।'

সামিয়া ফ্যাশনের কর্মী শাহজাহান বলেন, 'একসময় এখানকার তৈরি পোশাক শুধু চট্টগ্রামের খুচরা মার্কেটগুলোতে বিক্রি হতো। কিন্তু আশির দশকের পর কম মূল্যের কারণে সারা দেশেই এখন খলিফাপট্টির পোশাক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।'

পরিবারের সদস্যদের জন্য এখানে জামা কিনতে এসেছেন রাউজান উপজেলার গহিরা এলাকার বাসিন্দা আনিসুর রহমান। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানে ছোট বাচ্চাদের কাপড় পাইকারি দামে পোশাক পাওয়া যায়। তাই প্রতিবছর এখান থেকে ঈদের কেনাকাটা করি। কাপড়ের মানও ভালো।'

পটিয়া উপজেলা বাজারের রহমানিয়া ফ্যাশন হাউজের মালিক আহসানুর রহমান বলেন, 'প্রতি মাসে ২ বার এখান থেকে পাইকারি দামে কাপড় কিনে আমার দোকানে বিক্রি করি। ঈদের চাহিদা বেশি থাকায় এখন প্রতি সপ্তাহেই কাপড় সংগ্রহ করতে হচ্ছে।'

খলিফাপট্টি বণিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সামসুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঈদকে ঘিরেই মূলত এখানকার ব্যবসা জমে উঠে। বাচ্চাদের কাপড় ও মেয়েদের পোশাকই সবচেয়ে তৈরি হয়।'

তিনি বলেন, 'ভারতীয় পোশাকের কারণে এখানকার ব্যবসায়ীরা সুবিধা করতে পারছেন না। ভারত থেকে চোরাই পথে পোশাক আসার কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী আমরা বাজার দখল করতে পারিনি।'

'খলিফাপট্টির ৪০০ ব্যবসায়ীর পাশাপাশি নগরীর আরও অন্তত ৫০০ দোকান আছে। সবাইকে একসঙ্গে করে কোনো একটি শিল্প অঞ্চল তৈরি করা হলে খালিফাপট্টির পণ্যের প্রসার হবে এবং বিদেশি পোশাক আমদানিও কমে যাবে,' বলেন এই ব্যবসায়ী।

ব্যবসায়ীরা জানান, ৪৭ সালে দেশভাগের পর আইয়ুব আলী সওদাগর নামে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের এক দর্জি নগরীর এই এলাকায় প্রথম ব্যবসা শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে ব্যবসা প্রসারিত হয়ে এলাকাটি পরিচিত হয় খলিফাপট্টি নামে। মূলত দর্জিদের খলিফা নামে ডাকা হয় বলেই এ নামকরণ করা হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

Comments

The Daily Star  | English

‘People's will, not mine’

Yunus tells Malaysia's Bernama why he stepped into Bangladesh's political hot seat

7h ago