অপবাদ ছাড়া বাজেটে মধ্যবিত্তের জন্য কিছু নেই

ভাড়া বাড়িতে থেকে যে মানুষটি বছরের পর বছর হাড়ভাঙা খাটুনি খাটছেন, এখনো তাকে দ্বিতীয় সন্তানের স্কুলের ফি দেওয়ার জন্য দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়। কোনো বিশেষ দিনে গরুর মাংস খেতে ইচ্ছা হলেও পকেটের দিকে তাকিয়ে তা কিনতে দ্বিধা করেন তিনি। মধ্যম আয়ের এই মানুষটির পরিবারের জন্য আগামী বাজেটে কোনো সুখবর তো নেই, বরং তাকে অপবাদ নিতে হয়েছে।

চলতি বছর মূল্যস্ফীতির কারণে কেবল খাদ্যের পেছনেই একটি মধ্যম আয়ের পরিবারের মোট মাসিক আয়ের প্রায় অর্ধেক ব্যয় করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট পেশ করার সময় মধ্যবিত্তের কথা একবারই উল্লেখ করেছেন। সেটাও কর ফাঁকি দেওয়ার দোষে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত বা তদূর্ধ্ব শ্রেণির জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটির মতো, যাদের অধিকাংশই আয়কর প্রদান করছে না। ফলে কর ফাঁকি রোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণসহ করযোগ্য আয়ধারী সকলকে কর-জালের আওতায় আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।'

মন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা ৭৫ লাখ ১০ হাজার। তাদের মধ্যে মাত্র ২৯ লাখ রিটার্ন দাখিল করেছেন।

আমাদের মোট জিডিপির ৭ দশমিক ৬ শতাংশ কর থেকে আসে। যেসব দেশের জিডিপিতে করের অবদান সর্বনিম্ন, বাংলাদেশ সেসব দেশের তালিকাতেই আছে।

দেশে মধ্যম আয়ের এই জনগোষ্ঠী সংখ্যায় মাত্র ৪ কোটি। কিন্তু যারা কর দিচ্ছেন না, তাদের প্রত্যেকে এই জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত, এমন কোনো তথ্য নেই।

 বরং গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, 'যারা কর ফাঁকি দেন তাদের একটি বড় অংশ ধনী বা উচ্চ আয়ের জনগোষ্ঠী।'

নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়েলথ-এক্সের ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশে পরের ৫ বছরে উচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তির সংখ্যা এতটাই বাড়বে যে, বিশ্বের মধ্যে বৃদ্ধির এই হার হবে তৃতীয়।

কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় উচ্চ আয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা কর ফাঁকি দেন, তাদের আটকাতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেননি অর্থমন্ত্রী।

গত অর্থবছরে ১০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের ওপর চালু করা সারচার্জ এ বছরেও ১০ শতাংশে বহাল আছে।

বার্ষিক ১৬ লাখ টাকা বা তার বেশি যারা আয় করেন, তাদের জন্য আয়কর হার ২০২০-২১ অর্থবছরে আগের ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছিল। এটিও অপরিবর্তিত আছে এবারের বাজেটে।

এ অবস্থায় 'কর ফাঁকিদাতাদের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে', এমন বক্তব্য মধ্যবিত্তকেই শেষ পর্যন্ত চাপে ফেলবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

বকেয়া রাজস্ব পরিশোধে ব্যর্থ হলে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে বলে প্রস্তাব করেছে সরকার। এ ব্যাপারে ফাহমিদা খাতুনের বক্তব্য, 'এগুলো খুবই কঠোর ব্যবস্থা। এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হলে তাতে বৈষম্যই বাড়বে।'

তার মতে, '(এমন হলে) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। যেখানে মধ্যবিত্তরাই এ বিধানের শিকার হবেন।'

 মূল্যস্ফীতির কারণে যখন একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মাসিক আয়ের অর্ধেকের বেশি খরচ হচ্ছে খাদ্য চাহিদা মেটাতে, তখনই তাদের উদ্দেশে এমন বিধানের প্রস্তাব করা হলো।

গত সপ্তাহে প্রকাশিত সিপিডির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজধানীতে ৪ সদস্যের একটি পরিবারের মাসের চাল, মুরগির মাংস, ফল, রান্নার তেলসহ ২০টি দৈনন্দিন খাদ্যপণ্যের দাম গত ৩০ মে ছিল ২১ হাজার ৩৫৮ টাকা।

এর সঙ্গে ৩ বেডরুমের একটি ফ্ল্যাটের ন্যূনতম ভাড়া, সাধারণ স্বাস্থ্য খরচ, স্বাস্থ্যবিধি, শিক্ষা, পরিবহন ও টেলিযোগাযোগের ব্যয় যোগ করলে ন্যূনতম মাসিক ব্যয় দাঁড়ায় ৭০ হাজার টাকা।

এটা অনেক মধ্যবিত্তের মাসিক আয়ের পুরোটা।

প্রাণীজ প্রোটিন পুরোপুরি বাদ দিয়ে শুধু ডিম খেলে বাজার খরচ ১০ হাজার টাকায় নামানো যায়।  

এই হিসাব অনুসারে, অনেক পরিবার সঞ্চয়ের জন্য যেখানে প্রায় কিছুই রাখতে পারেন না, সেখানে তারা আয়কর কীভাবে পরিশোধ করবেন, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

বাজেটে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ প্রদান ও দরিদ্রদের জন্য ফ্যামিলি কার্ডে নিত্যপণ্য বা ভর্তুকিতে প্রতি কেজি চাল ১০ টাকায় বিক্রির প্রস্তাব করা হয়েছে।

কিন্তু দরিদ্রদের থেকে একটু উপরে ও ধনীদের চেয়ে বেশ দূরে যাদের অবস্থান, তাদের জন্য এ ধরনের কোনো সুখবর নেই।

অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এ ব্যয়ের ৭৭ শতাংশ নাগরিকদেরই দিতে হয়। এটি মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।

কারণ সরকারের স্বাস্থ্য ব্যয় মোট জাতীয় বাজেটের ৬ শতাংশের কম।

গত ৫ জুন এক গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেছেন, সরকার যদি চিকিৎসা ও সার্জিক্যাল সাপ্লাই সাব-সেক্টরের জন্য বরাদ্দ ৩ গুণ করে এবং সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রের সব শূন্যপদ পূরণ করে তাহলে এই খরচ ৫১ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব।

কেবল মধ্যম আয়ের কনিষ্ঠ সদস্যরা একটি সুখবরের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। তা হলো, এ বছর থেকে সার্বজনীন পেনশন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার কথা।

এসব অসঙ্গতি সত্ত্বেও বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন, 'দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত রাজস্বের যোগান, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনয়নসহ সার্বিকভাবে একটি কল্যাণমূখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সম্পদের পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে আয়ের অসমতা হ্রাস এবং সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা আয়কর আরোপের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।'

তবে কার সম্পদ পুনর্বন্টন করে কাকে দেওয়া হচ্ছে? 

Comments

The Daily Star  | English

CSA getting scrapped

The interim government yesterday decided in principle to repeal the Cyber Security Act which has been used to curb press freedom and suppress political dissent.

5h ago