এক রাতেই করিমুল হারিয়েছিলেন ২৭ জন স্বজন

দুটো ঘর পাশাপাশি, দক্ষিণের ঘরটা কিছুটা ছোট, উত্তরের ঘরটা একটু বড়। বাড়ির সামনেই কাচারি ঘর। একপাশে রান্নাঘর। সামনে বড় এক উঠান। বাড়িতে ঢুকতেই যেন রাজ্যের নিস্তব্ধতা পেয়ে বসলো। মানুষজনের শূন্যতা। কেউ আছেন বলে কয়েকবার ডাকতেই স্যান্ডো গেঞ্জির উপরে গামছা প্যাঁচানো একজন বয়স্ক মানুষ এগিয়ে এলেন। তিনি করিমুল হক।
জানালেন ৫০ বছর আগে এই বাড়ি ছিল জমজমাট। আজকের এমন শূন্যতা ছিল না সেদিন। সীমান্তবর্তী বলে প্রায় বাড়িই তখন আত্মীয়স্বজনে ভর্তি। অনেকে বহু দূর থেকে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। কেবলই শরণার্থী হয়ে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার অপেক্ষায়। এই বাড়ি থেকে ভারতীয় সীমান্ত রেখা কয়েকশো মিটার হবে বড়জোর। রাত হলেই মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে প্রবেশ করেন ত্রিপুরায়। ত্রিপুরা পৌঁছাতে পারলে নিরাপদ। পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে রক্ষা।
জুন মাসের ১৫ তারিখ ছিল সেদিন। উত্তর জামমুড়া ভূঁইয়া বাড়িতে সেদিন দুপুর বেলায় পারিবারিক একটি মিলাদ উপলক্ষে এসেছিলেন আত্মীয় স্বজনেরা। সারাদিন বাড়িতে উৎসব ভাব। বহুদিন পর অনেকের সঙ্গে অনেকের দেখা হলো। বিকেলের মধ্যে মিলাদ শেষে অনেকে ফিরেও গেলেন নিজ নিজ বাড়িতে। তবে নিকটাত্মীয়দের কয়েকজন জোরাজুরি করায় থেকে গেলেন এই বাড়িতেই। কিছু আত্মীয়স্বজন আগে থেকেই ছিলেন বাড়িতে। দেশে যে যুদ্ধ চলছে এক মুহূর্তের জন্য বেমালুম ভুলে গেল সবাই। রাত নয়টা নাগাদ চললো আড্ডা, নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতা।
কুপির আলোতে কারো কারো চোখে ঘুমের আবহ টের পাওয়া গেল। এরপর সবাই একসাথে বসে খেলেন রাতের খাবার। এদিকে দুই ঘরে জনা তিরিশের বেশি মানুষ। দুই ঘরে তো ঠাঁই হবে না। তাই চার জনকে পাঠানো হলো কাচারি ঘরে। দুই ঘরে রইলেন ২৭ জন। সকাল হলেই কেউ কেউ চলে যাবেন বাড়িতে। কয়েকজন শরণার্থী হিসেবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে যাবেন ভারত। সঙ্গে কাপড়চোপড়ও তাই আনা।
রাত দশটা কি সাড়ে দশটা নাগাদ সবাই শুয়ে পড়লেন।
রাত আনুমানিক তখন সাড়ে ১২টা। হঠাৎই বিকট শব্দের আওয়াজ। যেন পৃথিবীর ধ্বংসের প্রলয়লীলা শুরু হয়ে গেছে। বাইরে দাউদাউ আগুন জ্বলছে। করিমুল হক দরজা খুলতেই দেখলেন রাতে ঘুমানোর আগে দেখা দক্ষিণের ঘর মাটিতে মিশে গেছে। প্রায় সবাই মৃত। কয়েকজন পানি পানি বলে চেঁচাচ্ছে। সঙ্গে থাকা তার ভাই ও মামাতো ভাই পানি আনতে গিয়ে দেখেন বিকট শব্দে আরেকটি মাটি কাঁপানো ভয়াবহ শব্দ। এবার উত্তরের ঘরের এক তৃতীয়াংশই মাটিতে মিশে গেল। পর পর দুটো শেলের বিস্ফোরণে ঘর দেবে গেছে মাটিতে। আহাজারি চিৎকার আর মানুষের কান্নার রোল শুনে এই রাতেই আশেপাশের বাড়ি থেকে ছুটে এলেন মানুষ। কয়েক ঘণ্টা আগে যে বাড়ি ছিল আনন্দে সমাগম, মুহূর্তেই তা পরিণত হলো নরকে। পরপর দুটো শেল বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন ২৭ জন।
জানা যায় কয়েক মাইল দূরে কালীরহাট থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প থেকে রাত সাড়ে ১২টার দিকে পরপর তিনটি মর্টার শেল নিক্ষেপ করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। দুটি শেল বিস্ফোরিত হলেও একটি শেল অবিস্ফোরিত থেকে যায়।
সেদিনের সেই শেলের আঘাত থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন করিমুল হক। সেদিনের ১৫ বছর বয়সী করিমুল এখন বৃদ্ধ। তিনি বর্তমানে দুটি ঘরের দিকে দেখিয়ে বললেন 'ঠিক এই ঘরের জায়গাত আছিল এই ঘর গুলান। আমরা আছিলাম সামনের কাচারি ঘরে। কালীরহাটের দিক থেকে পাকিস্তানি মিলিটারি তিনখান শেল মাইরলো। একটা পড়লো দক্ষিণের ঘরে, আরেকটা দক্ষিণ আর উত্তরের ঘরের মাঝখানে। আরেকটা উঠানে পড়লেও ফাটে নাই। এক রাইতের মইধ্যেই যে এমনে এতিম হইয়া যামু ভাবি নাই। মা বাপ, ভাই বোন, নানী, মামা, মামী, ফুফু, খালা সব হারাইলাম এক রাইতে। মোট মিলে ২৭ জন।'
কাচারি ঘরে থাকায় ভাগ্যক্রমে সেদিন রাতে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি, তার ভাইসহ চার জন।
ফুলগাজী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল বাশার বলেন, 'সেদিন রাতে আমরা ছিলাম মুন্সীরহাট মুক্তারবাড়ি ডিফেন্সে। যখন শেল পড়ল তখন আমরা বিকট শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। পরদিন সকালে দেখি মৃতদের মধ্যে কারো হাত নেই, কারো পা নেই। এরপর স্থানীয় গ্রামবাসী মিলে দুটি কবর খনন করে ২৭ জনকে আমরা দাফন করলাম।'

গত পঞ্চাশ বছর ধরে করিমুল হক নীরবেই বয়ে বেড়াচ্ছেন একসঙ্গে এতো স্বজন হারানোর যন্ত্রণা। এক রাতের ব্যবধানে নিজের প্রায় পুরো পরিবার হারিয়ে ফেলা সেদিনের পনেরো বছরের কিশোর করিমুলের জীবন কেটেছে আর্থিক দুরাবস্থা আর অনটনে। সেদিন রাতে হারানো স্বজনদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মৃতিফলকের সামনে দাঁড়াতে গিয়ে বাঁধ মানলো না তার অশ্রু। আক্ষেপের গলায় বললেন, 'কতোজনে কতো কিছু পাইলো, আমগোর ভাইগ্যেই কিছু জুটলো না।'
Comments