দুই শহীদের স্মৃতি মুছে যাওয়ার পথে, স্বীকৃতি মেলেনি আজও

একাত্তরের ২ এপ্রিল। রাত্রিকালীন কারফিউ চলছে। রাজশাহী শহরের শোভেন কুমার রায় পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে সেদিন তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পরেছিলেন।
তার বয়স তখন ২১ বছর, সবেমাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন।
বিছানায় যাওয়ার সময়ও তিনি আঁচ করতে পারেননি যে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মুহূর্তগুলোর সাক্ষী হতে চলেছেন তিনি। সেই রাতের স্মৃতি ভয়ানক দুঃস্বপ্নের মতো তাকে তাড়া করে ফিরবে সারা জীবন।
রাত সোয়া এগারোটা। সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন শোভেন। শহরের ফুদকিপাড়া এলাকায় তাদের দোতলা বাড়ির দরজায় সেই রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি জিপ এসে থামে। জিপের শব্দে বিছানা থেকে উঠে পরেন তিনি।
'কী ঘটতে চলেছে তা আঁচ করতে পারিনি আমরা কেউই', বলেন শোভেন রায়। 'আমরা সবাই ভেবেছিলাম বাবাকে হয়তো গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে কারণ আগেই দুবার এমন ঘটনা ঘটেছিল।'

শোভেন রায়ের বয়স এখন ৭২ বছর। যুদ্ধের পর তিনি মাস্টারস শেষ করেছিলেন, তবে দুঃসহ সেই স্মৃতির ভার তাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে সারাজীবন।
সম্প্রতি তাদের সেই পুরোনো বাড়িতে বসে দ্য ডেইলি স্টারকে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন তিনি।
জিপ থেকে রাইফেল নিয়ে এক পাকিস্তানি সেনা নামল। সে চিৎকার করে আমার বাবা কোথায় জানতে চাইলো।
'পান্ডে কাঁহা হ্যায়?' উর্দুভাষী সৈনিককে উদ্ধৃত করে বলেন শোভেন।
তার বাবা সুরেশ কুমার পান্ডে তৎকালীন রাজশাহী পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
সুরেশ পান্ডে তার দোতলার ঘরে ছিলেন। পাশের এক ঘরে শোভেন রায়, তার ছোট ভাই সৌমিত্র কুমার রায়, তখন তার বয়স ১৮, আর তাদের মা চিত্রলেখা দেবী ছিলেন। আর নিচতলার এক ঘরে ছিলেন সুরেশ পান্ডের ৯৮ বছর বয়স্ক মা জ্ঞানদা দেবী।
পাকিস্তানি আর্মির উপস্থিতিতে সবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।
'বাবা তাড়াহুড়ো করে আসছি বলতে বলতে বাড়ির প্রধান ফটকে ছুটে গেলেন।
আমি, আমার ভাই ও মা-- বাবাকে অনুসরণ করে নিচে নেমে বাইরের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলাম।

'পাকিস্তানি সেনা বাবার সাথে কথা বলতে বলতে বাইরের ঘরের দরজার কাছাকাছি চলে এলেন। এরপরে ওই সেনা আমার বাবাকে বাড়ির ভেতরে চলে যেতে বলল। ওই মুহূর্তে আমার মনে হল যেন কোন সমস্যা নেই, ওরা শুধু কথা বলতেই এসেছিল।'
তখনও শোভেনরা তিন জনই বাইরের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে।
'যখনই বাড়ির ভেতরে আসার জন্য আমার বাবা ঘুরে দাঁড়ালেন, ওই সেনা তার চিনা বন্দুক তুলে পেছন থেকে গুলি করল। গুলি করে সে আর সেখানে থামেনি। দৌড়ে জিপের কাছে চলে যায় এবং জিপটি তাকে নিয়ে দ্রুত চলে যায়।'
'আমি আমার বাবাকে মুখ থুবরে দরজার কাছে বারান্দায় পড়ে যেতে দেখলাম। তাড়াতাড়ি আমরা তাকে উঠিয়ে বসালাম। দেখলাম একটি গুলি তার মাথা ভেদ করে তার ডান চোখ উপড়ে নিয়েছে। মাথা দুই ভাগ হয়ে গেছে। মাথার ডান দিকটা ঝুলে পড়েছে। পরে দেখেছি বাবার মাথা ভেদ করার পর গুলিটা বিশ ইঞ্চি পুরু দুটি দেয়াল ভেদ করে আমাদের উঠানে গিয়ে পড়েছিল', বুজে আসা কণ্ঠে বলছিলেন শোভেন রায়।
'আমার মা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন, কিন্তু ওই একবারই। তারপর তিনি আমার, আমার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে শক্ত হলেন।'
'আমরা ধরাধরি করে বাবাকে ঘরের ভিতরে নিয়ে আমার দিদার পাশে একটি বিছানায় শোয়ালাম। মা বাবার ঝুলে পড়া মাথাটা সোজা করে একটা মাফলার দিয়ে বেঁধে দিলেন।'
'মা বাবাকে এক গ্লাস পানি এনে দিলেন। বাবা পানিটা মুখে নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।'
'কী ভয়ানক সেই দৃশ্য! যা আমার চোখের সামনেই ঘটেছিল, কথাটা বলে শোভেন রায় চোখের জল ধরে রাখতে একটু চুপ করে থাকেন।
সেই রাত থেকে সকাল পর্যন্ত এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হতে শত শত মানুষ সুরেশ কুমার পান্ডের বাড়িতে ভিড় করতে থাকল।
লাশ দেখতে এসে সবাই বলছিল, 'রাজশাহীর মাথা শেষ হয়ে গেছে, এখানে আর থাকা যাবে না।'
পরে শোভেন জেনেছিলেন যে স্থানীয় রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে তাদের বাড়ি শনাক্ত করতে সহায়তা করেছিল।
আরও জানতে পারেন, পান্ডেকে হত্যার মাত্র আধাঘণ্টা আগে শহরের ষষ্ঠিতলায় একইভাবে আরেকটি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল।
সেখানে হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন বীরেন্দ্রনাথ সরকার। তিনি ছিলেন একাধারে একজন আইনজীবী, সাংবাদিক এবং ফুটবলার। শোভেনের বাবার মতই সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব।
স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের মতে, সুরেশ পান্ডে এবং বীরেন্দ্রনাথ সরকার দুজনই পাকিস্তানি বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন কারণ তারা অসাম্প্রদায়িক চেতনার অগ্রদূত ছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধা ও কবি রুহুল আমিন প্রামাণিক বলেন, 'তারা তাদের জীবন বিসর্জন দিয়ে শত শত মানুষকে বাঁচিয়েছিলেন।'
তিনি বলেন, এই দুটি হত্যাকাণ্ড রাজশাহী এবং এর আশেপাশের জেলাগুলোতে যেমন ভয় ছড়িয়ে দিয়েছিল তেমনি অনেককে মুক্তিযুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
'আমরা ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম,' তিনি বলেন।
গবেষকদের মতে, সুরেশ পান্ডে এবং বীরেন্দ্রনাথ সরকার দুজনেরই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল।
সুরেশ পান্ডে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। পরে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ১৫ দিন এবং ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় এক মাস জেল খেটেছিলেন।
বীরেন্দ্রনাথ সরকারেরও পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে জেলে যাওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের পক্ষে মামলা লড়েছিলেন। পঞ্চাশের দশকে তিনি তিনি প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া (পিটিআই) এর রাজশাহী সংবাদদাতা ছিলেন। সেসময় তিনি রাজশাহী প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
এছাড়াও তারা দুজনে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখছিলেন।
২৫ মার্চ রাত থেকেই রাজশাহীর লোকজন শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করে। ২৮ মার্চ রাজশাহীতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে পুলিশের প্রতিরোধ ভেঙে পড়লে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তারা জানান, সেই সময় সুরেশ পান্ডে এবং বীরেন্দ্রনাথ সরকার পাকিস্থানিদের হাত থেকে রাজশাহী শহর রক্ষার জন্য জনগণকে একত্রিত করার চেষ্টা করছিলেন।
তারা পাড়ায় মহল্লায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভীত মানুষজনদের সাহস যুগিয়েছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করছিলেন। তারা বলেছিলেন জীবনের বিনিময়ে হলেও জন্মস্থান ফেলে কোথাও তারা যাবেন না এবং অন্যদের তারা তাই করতে বলেছিলেন।
বীরেন্দ্রনাথ সরকারকে হত্যা
রাজশাহীর আইনজীবী অংকুর সেন বীরেন্দ্রনাথ সরকারের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন।
একাত্তরে অংকুর সেনের বয়স ১৭ এবং তিনি বীরেন্দ্রনাথ সরকারের প্রতিবেশী ছিলেন। তার বাবা গৌরমোহন সেন বীরেন্দ্রনাথ সরকারের মুহুরি ছিলেন। তারা পাশাপাশি বাসায় থাকতেন।
অংকুর সেন জানান, অবিবাহিত বীরেন্দ্রনাথ সরকার শহরের ষষ্টিতলা এলাকায় একটি দোতলা বাড়িতে একা থাকতেন।
একাত্তরে ২ এপ্রিল রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে বীরেন্দ্রনাথ সরকার দোতলায় নিজের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন।

বীরেন্দ্রনাথ সরকারের দুই অনুসারী- বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের কিউরেটর শচীন সিদ্ধান্ত এবং আইনজীবী রনেশ মৈত্র নিচতলায় ঘুমিয়েছিলেন।
অংকুর বলেন, শচীন সিদ্ধান্ত এবং রনেশ মৈত্রের কাছে তিনি শুনেছেন যে দুইজন সশস্ত্র পাকিস্তানি সৈন্য বীরেন্দ্রনাথ সরকারের খোঁজে দরজায় ধাক্কা দিলে তারাই দরজা খুলে দেন এবং বলেন তিনি দোতলায় আছেন। সৈন্যরা উপরে উঠে গেলে তারা দুজন দৌড়ে যান অংকুরদের বাড়িতে।
পাকিস্তানি বাহিনী বীরেন্দ্রনাথ সরকারকে তার বিছানাতেই গুলি করে হত্যা করে।
'আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, আমি গুলির শব্দ শুনিনি,' অংকুর সেন বলেন।
'পরে আমি বাইরে বেড়িয়ে দেখেছিলাম যে দুইজন সশস্ত্র সেনা একজন বাঙালি রাজাকারের সাথে বীরেন্দ্রনাথ সরকারের বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।'
'বীরেন্দ্রনাথ সরকারের ঘরে গিয়ে দেখি মশারি টাঙ্গানোই আছে। রক্তমাখা বিছানায় তার লাশ পড়ে আছে। তার মাথায় ও পেটে দুটি গুলি লেগেছিল,' তিনি বলেন।
'পরদিন অনেক মানুষ বীরেন্দ্রনাথকে দেখতে এলেও তারপর কেউ আর অপেক্ষা করেনি, সবাই যে যার মতো শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। সৎকারের জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি, মুসলমান দুজন রিকশাওয়ালা – আফাজ ও উজিরের সাহায্যে আমি ও আমার পরিবার তার সৎকারের ব্যবস্থা করি।'
বীরেন্দ্রনাথ সরকার ও সুরেশ পান্ডের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া একসঙ্গে পঞ্চবটি শ্মশানে হয়। রাজশাহী শহরের দক্ষিণে বয়ে চলা পদ্মা নদীতে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এই দুই শহীদের দেহকণা।
তবুও স্বীকৃতি মিলেনি
দেশের জন্য তাদের এই আত্মত্যাগ সত্ত্বেও, তাদের স্মৃতি রক্ষার জন্য কোনো উদ্যোগ খুব কমই নেয়া হয়েছে।
সুরেশ পান্ডের নামে রাজশাহী শহরের একটি গলিপথ থাকলেও বীরেন্দ্রনাথ সরকারের স্মরণে কিছুই করা হয়নি বলে জানিয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা।
সুরেশ পান্ডের ছেলে শোভেন রায় জানান, তিনি দেখেছেন যে স্বাধীনতার পর বীরেন্দ্রনাথ সরকারের বাড়িতে তার জিনিসপত্র নিয়ে একটি স্মৃতি জাদুঘর স্থাপিত হয়েছিল।
সুরেশ পান্ডের বাড়ির কাছে মুন্নুজান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষ তার নামে নামকরণ করা হয় ২০১২ সালের শেষ দিকে। তাই দেরিতে হলেও তার স্মৃতি রক্ষার এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।
কিন্তু, এই প্রতিবেদক বীরেন্দ্রনাথ সরকারের বাড়িতে এবং মুন্নুজান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখেন যে তাদের স্মৃতির কোনো অস্তিত্ব আর নেই। মুন্নুজান স্কুলে সুরেশ পান্ডের নাম মুছে অন্য মনীষীদের নামে কক্ষের নামকরণ করা হয়েছে। বীরেন্দ্রনাথের বাড়িটি বেদখল হয়ে আছে। তার ঘরের মেঝে ধসে পড়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ বা দখলদারদের কারো কাছেই এই পরিস্থিতির যুক্তিসঙ্গত কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
তাদের দুজনকে শহীদ হিসেবে তালিকাভুক্তও করা হয়নি, তাদের পরিবারও যথাযথ সম্মান পায়নি।
'স্বীকৃতির আশায় থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে আমার মা ভারতে চলে যান। তিনি ২০০৬ সালে সেখানেই মারা যান। আমাদের জীবনও শেষের পথে। শহীদ পরিবার হিসেবে কেন স্বীকৃতি পাইনি জানি না, আমরা মারা গেলে এই কথাগুলো বলার আর কেউ থাকবে না,' বলেন শোভেন কুমার রায়।
Comments