শ্রদ্ধাঞ্জলি: দিলীপ কুমারকে
ভারতীয় উপমহাদেশে দিলীপ কুমার (১১ ডিসেম্বর ১৯২১—৭ জুলাই ২০২১) ছিলেন বিনোদন জগত থেকে ওঠা ব্যক্তিত্ব যার প্রতি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের একটা গভীর শ্রদ্ধাপূর্ণ আস্থা ছিল। ব্যক্তি আর অভিনয় জীবনের প্রলম্বিত অধ্যায়ে নিজের ব্যক্তিত্ব বলেই মানুষের এই গভীর আস্থা দিলীপ কুমার অর্জন করতে পেরেছিলেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের অঙ্গনে সত্যজিৎ রায় ছাড়া মানুষের এমন সার্বিক গভীর আস্থা বিনোদন দুনিয়ার আর কেউ সর্বাত্মকভাবে অর্জন করতে পেরেছিলেন কি না সেই বিষয়ে সন্দেহ আছে।
উত্তমকুমার থেকে অমিতাভ বচ্চন—বিনোদন দুনিয়ার সফল বহু মানুষই সমাজ এবং রাজনীতি সচেতন হতে গিয়ে অনেক সময়ই রাজনীতির ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যের লক্ষ্মণরেখার প্রতি ঠিকমতো দৃষ্টিপাত করে উঠতে পারেননি। ফলে অতিক্রম করেছেন সেই রেখাচিহ্ন। আর তার জেরে বিনোদন ব্যক্তিত্ব হয়েও দলীয় রাজনীতির কৌণিক বিন্দুতে অবস্থান করে আমজনতার সার্বিক আস্থার জায়গাতে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় রাখতে পারেননি। এইখানে সবদিক থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন দিলীপ কুমার। সংস্কৃতির প্রাঙ্গণে যে জাতি-ধর্ম-ভাষার কোনো প্রাচীর থাকতে পারে না—নিজের দীর্ঘ যাপনচিত্রের প্রতিটি খুঁটিনাটির ভিতর দিয়ে দিলীপ কুমার সেটা দেখিয়ে গেলেন। আর এমন একটা সময়ে তিনি সম্প্রীতির সেতুবন্ধনের এই পরম ঋত্বিকের ভূমিকা পালন করে গেলেন, যে সময়টাতে গোটা উপমহাদেশ ধর্ম আর জাতপাতের, ভাষার দীনতার বিষে নীলকণ্ঠ হয়ে আছে।
অভিনয় জগৎ থেকে অবসর নেওয়ার অনেক অনেক বছর পর একজন বৃদ্ধ প্রাক্তন যখন শান্তির জন্যে প্রতিবেশী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে ফোন করেন, যে মাটিতে তিনি জন্মেছিলেন, সেই মাটির প্রতি এতটাই শিল্পীর শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস যে, বিদেশ হয়ে যাওয়া স্বদেশের জল-মাটি-আগুনও শান্তির কাকুতিতে শামিল হয়—এমনটা বিরল সৌভাগ্য গোটা বিশ্বে দিলীপ কুমার ছাড়া আর কোনো অভিনেতা অর্জন করতে পারেননি। রাজনীতির মানুষদের ভিতরে ভারত—পাকিস্তান ঘিরে যতোই তাপ উত্তাপের জিগির থাকুক না কেন, সংস্কৃতির সেতু বন্ধনে সীমান্ত যে কোনো প্রতিবদ্ধকতা হতে পারে না—দিলীপ কুমার যেভাবে প্রমাণ করে গেছেন তা সারা বিশ্বে বিরল।
মানুষের সঙ্গে মানুষের সেতুবন্ধন রচনায় দিলীপ কুমার কেমন বিরল চরিত্রের ব্যক্তিত্ব ছিলেন তা বাংলাদেশের প্রখ্যাত সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম নিজে একবার দেখেছিলেন। সেইবার হাসান ইমাম ঈদের দিন অনেকটা সময় ছিলেন দিলীপ কুমারের বাড়িতে। ঈদের নামাজের পর খাওয়া দাওয়া হচ্ছে। বাইরে ব্যান্ড পার্টি বাজিয়ে শোভাযাত্রা যাচ্ছে। প্রত্যেকটি ব্যান্ড পার্টির দল আসছে দিলীপ কুমারের দুয়ারে। হাসান ইমাম দেখেছিলেন; প্রত্যেকবার দিলীপ কুমার নিজে উঠে গিয়ে ব্যান্ডপার্টির মানুষদের হাতে উপহার তুলে দিয়ে আসছেন। কেবলমাত্র অভিজাত সমাজের কাছেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখছেন না দিলীপ কুমার। অতি সাধারণ বান্ডপার্টিতে বাজাচ্ছেন এমন মানুষদের কাছেও তিনি একেবারে নিজের মানুষ হিসেবেই নিজেকে মেলে ধরছেন।
বিনোদন দুনিয়ার ভিতরে আছেন বলে সমাজ সচেতনতার ধারাবাহিকতাকে এড়িয়ে চলতেন দিলীপ কুমার—তেমনটা ভাববার কিন্তু কোনো কারণ নেই। জীবনের শেষ পর্বে কার্গিল যুদ্ধের অবসানে পাকিস্তানের কাছে বন্ধুত্বের বার্তা দিতে ভারতের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি সবথেকে যোগ্য মানুষ ভেবেছিলেন দিলীপ কুমারকেই। তাই প্রটোকল ভেঙেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলবার পর রিসিভারটি দিয়েছিলেন দিলীপ কুমারকেই। আবার এই বাজপিরই রাজনৈতিক সহযোগী শিবসেনা এবং তার প্রধান বাল ঠাকরে যখন পাকিস্তানের সর্বোচ্চ খেতাব না নিতে দিলীপ কুমারকে পরামর্শ দিলেন, তখন অটলবিহারী বাজপেয়িই পাল্টা পরামর্শ দিয়েছিলেন দিলীপ কুমারকে; শিসেনার ফতোয়া উপেক্ষা করতে।
মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীন বাংলাদেশ ঘিরে প্রবল উৎসাহ ছিল রুপালি দুনিয়ার এই মানুষটির। বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে দেশ কেমন চলছে সেই খবর সৈয়দ হাসান ইমামের সঙ্গে দেখা হলেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিতে ভুলতেন না। হাসান ইমামের কাছে যখন শুনলেন, তার চলচ্চিত্র টিমের মানুষেরা একবার আলাপ করতে চান, এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন দেখা করতে। হাসান ইমামের ‘অবিচার’ ছবির শুটিং চলছিল তখন মুম্বাইতে। ইউনিটের একটা বড় দলের সঙ্গে একদিন অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন দিলীপ কুমার। ফিল্মের খবরের সঙ্গে বাংলাদেশ, সেখানকার মানুষ, সত্তরের দশকের শেষ পর্যায়ে কেমন চলছে বাংলাদেশ—হাসান ইমামের ইউনিটের মানুষদের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে নিয়েছিলেন দিলীপ কুমার।
ইউসুফ খানকে দিলীপ কুমার নাম নিয়ে প্রথম অভিনয়ের পরামর্শ দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশের পাবনার মেয়ে দেবিকারাণী, এটা দিলীপ কুমার কখনো ভুলতে পারেননি। দেবিকারাণী, বাঙালি আর বাংলাদেশের প্রতি তাই একটা অন্য রকমের হৃদয়ের টান অনুভব করতেন দিলীপ কুমার। বাংলা ফিল্মের জগতে যেমন বিশ শতকের প্রথম পর্বে কুন্দনলাল সায়গল সহ বহু অভিনেতার জীবনে মাতৃমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন কিংবদন্তী শিল্পী কানন দেবী, তেমনই মুম্বাই ফিল্মের দুনিয়াতে ভূমিকা ছিল দেবিকারাণীর। দিলীপ কুমার শিল্পী জীবনের একদম প্রথম পর্বে দেবিকারাণীর স্নেহপূর্ণ ভূমিকার কারণে চিরদিন বাঙালি আর বাংলাদেশের প্রতি একটা নাড়ির টান ছিল দিলীপ কুমারের।
বাংলাদেশের লালমনিরহাট অঞ্চলে রেল শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে একটা সময়ে যুক্ত ছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ। এই লালমনিরহাটে রেল শ্রমিকদের ভিতরে কাজ করতে করতেই জ্যোতি বসুরও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা তৈরি। গৌরকিশোরের লালমনিরহাটে রেল শ্রমিক আন্দোলন, তাদের জীবন-জীবিকা দেখার ধারাভাষ্যই 'সাগিনা মাহাতো'। সেই কাহিনী অবলম্বনে তপন সিংহের ছবিতে অভিনয়ের ভিতর দিয়েই দিলীপ কুমার হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির আপনজন।
ষাটের দশকের শেষ পর্বের পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক উত্তাপ, টানাপোড়েন, সেই অবস্থার ভিতর দিয়ে এই 'সাগিনা মাহাতো'র চলচ্চিত্রায়ন বামপন্থীদের একাংশের কাছে অপছন্দের কাজ হলেও ফিল্মটির বিষয়বস্তুর উপস্থাপনে অবিভক্ত বাংলার একটি সময়ের সমাজচিত্রের যে চিত্রমালা দিলীপ কুমার ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তা বাংলার সামাজিক ইতিহাসের একটি আকর। একাংশের বামপন্থীরা গৌরকিশোরের এই গল্পটির জন্যে তাকে প্রতিক্রিয়াশীল মনে করলেও সৃষ্টি যে কখনো দলীয় রাজনীতির ধামাধরা হতে পারে না, বিশ শতকে ঠিক এই ইস্যুতেই ঋত্বিক ঘটক, সমরেশ বসুদের সঙ্গে দলপন্থী বামেদের সংঘাত তৈরি হয়েছিল। অনেকটা এই কারণেই অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক যখন বি টি রণদিভে, তার সাংস্কৃতিক মৌলবাদী নীতির জন্যেই ভারত ছেড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছিলেন কলিম শরাফি। আর সেই জায়গা থেকেই একাংশের বামপন্থীদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন গৌরকিশোর আর তার গল্প অবলম্বনে ফিল্মের মুখ্য অভিনেতা দিলীপ কুমার। তবে সেই তিক্ততা দিলীপ কুমার বয়ে বেড়াননি। বামপন্থীরাও নন। জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর উভয়ের ভুল বোঝাবুঝি সরাতে জ্যোতিবাবু এবং দিলীপ কুমার দুজনেই খুব আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
গৌতম রায়, ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক
Comments