পণ্ডিত শিব কুমার শর্মা: সন্তুরকে বিশ্বসংগীতে তুলে ধরা মহানায়ক

'সন্তুর আমার কাছে উপাসনার মতো। এই বাদ্যযন্ত্রটি যখন আমার হাতে থাকে, তখন কি আমি পৃথিবীতে থাকি? কে যেন মরমি কণ্ঠে ডেকে যান আমাকে। সন্তুরের মাধ্যমে আমি তার সন্ধান করি। এই যন্ত্রে একটি নতুন সুর যখন সৃষ্টি হয়, আমি তাকে দেখতে পাই যেন!'
এক সাক্ষাৎকারে সন্তুরের প্রতি তার দরদী আবেগটা ধরা পড়ে এভাবেই।
মঞ্চে যখন তিনি উপবিষ্ট হতেন, সমস্ত জনস্রোত স্তব্ধ হয়ে যেত এক স্বর্গীয় মুহূর্তের জন্য। তার শুরুটা হতো পাহাড়ি ধুন দিয়ে। চোখ বুজে ধ্যানে মগ্ন এক প্রাচীন ঋষির প্রতিচ্ছবি। চোখ বুজে পাহাড় ঘেরা সেই শুভ্র উপত্যকাকে দেখতে পান যিনি। কুয়াশায় মোড়ানো তাওয়ি নদীর বাঁক থেকে কোন অচেনা মেষ বালকের হাত ধরে ভেসে আসা সন্তুরের মর্মভেদী সুর। অতঃপর সন্তুরের তারে মৃদু স্পর্শ। ধ্যান ভঙ্গের বদলে আচ্ছন্ন মনজগৎ পাড়ি দেয় তুষারে শুভ্র উপত্যকায়। সেই শুভ্র প্রাচীন ঋষির সন্তুরে এমনই দখল।

তার শুরুটা অবশ্য সন্তুরে হয়নি। বাবা পণ্ডিত উমা দত্ত শর্মা ছিলেন জম্মুর বিখ্যাত তবলচী। বংশ পরম্পরায় তার পরিবারের হাতেই অর্পিত ছিল মহারাজা প্রতাপ সিংয়ের পারিবারিক মন্দিরে পূজার অর্ঘ্য দানের। ঠাকুরদা পণ্ডিত সন্ত রামজি পর্যন্ত বংশ পরম্পরায় পালন করেছিলেন সেই অর্পিত দায়িত্ব। উমা দত্ত শর্মা নিজেও জম্মুতে থাকাকালীন নিয়মিত সংগীত পরিবেশন করতেন মহারাজা প্রতাপ সিংয়ের পারিবারিক মন্দিরে।
জম্মুর পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় তখন বিরাজমান সুফিয়ানা সংগীতের আসর। প্রতিটি ঘরে তখন আবদুল্লাহ তিব্বত বাকাল, গুলাম মুহাম্মদ কালিম বাফ, শেখ আব্দুল আজিজের সুফিয়ানা সংগীতের মোহাচ্ছন্ন আবেশ। সংগীতে কারো হাতেখড়ি হলেই সবার সামনেই যেন এক অদৃশ্য গন্তব্য তারা।
পণ্ডিত উমা দত্ত শর্মা অবশ্য সে পথে হাঁটলেন না। নিজে তবলচী ও কণ্ঠসংগীত শিল্পী হওয়ায় ছেলেকেও দিয়েছিলেন তবলা ও কণ্ঠ সংগীতে হাতেখড়ি। যখন তবলায় হাতেখড়ি হলো শিব কুমারের, তখন বয়সটা মাত্র ৫। রেডিও জম্মু ও শ্রীনগরে প্রথম তবলা পরিবেশনের সময় বয়স কেবল ৭। সেই থেকে উচ্চাঙ্গসংগীতের সঙ্গে এক অনন্য প্রেম গড়ে উঠলো শিবের। একে একে যন্ত্রসংগীতে বেহালা, হারমোনিয়ামেও অনবদ্য দখল চলে এলো শিব কুমারের।

শিব কুমারের বয়স তখন মাত্র ১৩। সালটা ১৯৫১, একদিন সকালে প্রতিদিনের মতোই রেওয়াজে বসেছিলেন শিব কুমার। হঠাৎ ছেলের হাতে সন্তুর তুলে দিলেন বাবা উমা দত্ত শর্মা। বললেন, 'বাজাও তো দেখি।' কিছুক্ষণ বাজাতেই বাবা বললেন, 'থামো।' অতঃপর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, 'আজ থেকে এই সন্তুরই তোমার সঙ্গী।' বাবাই ঠিক করে দিলেন পুত্রের গন্তব্য।
ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতে সন্তুর কি করে আসে! কারণ বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত তো সন্তুর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে ঘেঁষতেই পারেনি। সন্তুর নামক যন্ত্রটি তখন সীমাবদ্ধ কেবল কাশ্মীরের দিগন্ত ছোঁয়া উপত্যকায়। কাশ্মীর উপত্যকার বাইরে উপমহাদেশে তখনো কেউ সন্তুর দেখা তো দূরের কথা সন্তুর নামটিও শোনেনি।
বছর চারেক একটানা চললো নিবিড় প্রশিক্ষণ। বাবা আর সন্তুরের ওস্তাদ ও পণ্ডিতদের কাছে জোর তালিম চললো শিব কুমারের। রাত-দিন কোনো বিকার নেই। দিনের ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা কঠোর অধ্যবসায়।
সুযোগও এলো হাতের মুঠোয়। সালটা ১৯৫৫। বোম্বাইতে বসেছিল হরিদাশ সংগীত সম্মেলনের আসর। ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের অন্যতম বৃহৎ আসর এটি। মঞ্চে উপবিষ্ট হয়ে ধ্যান লয়ে বাজালেন শিব কুমার। কিন্তু বিধি বাম। শ্রোতা-দর্শকের প্রতিক্রিয়া ভীষণ হতাশাজনক। কাশ্মীর উপত্যকার এই যন্ত্রকে কেউ যেন শাস্ত্রীয় সংগীতে মেনে নিতেই নারাজ। অনেকে তো বলেই বসলেন, 'ও থাক না কাশ্মীরেই। পুরো ভারতবর্ষেই কেন ছড়াতে হবে?' কিন্তু অনড় উমা দত্ত শর্মা। বাবার গলায় তীব্র প্রশ্রয়। বাড়ি ফিরে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললেন, 'আজ হয়তো সবাই বলছে সন্তুর কি করে ঠাঁই পায় হিন্দুস্থানের সংগীত সমাবেশে। কাল ঠিকই উপলব্ধি করবে এই সন্তুর কেবল কাশ্মীরের নয়, গোটা ভারতবর্ষের।' জোর পেলেন শিব কুমার। ফিরে গেলেন আপন জগতে।

প্রতি বছর কলকাতায় বসলো 'অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্স'। সেখানেও সন্তুরকে সঙ্গী করলেন শিব কুমার। কিন্তু এখানেও সকলের দ্বিমত। তবে এবার আগের তুলনায় খানিকটা ব্যতিক্রম। সবার সরল স্বীকারোক্তি, 'শুনতে ভীষণ চমৎকার। বাজিয়েছও অনবদ্য।' কিন্তু এরপরই কঠিন স্বর। 'এই যন্ত্র দিয়ে যে শাস্ত্রীয় সংগীত হবে না। এতে আলাপের সুযোগ কোথায়? তুমি ভীষণ মেধাবী। সন্তুর নিয়ে পড়ে না থেকে অন্য কিছু বাজাও। এ তো প্রতিভার অপচয়। অন্য কিছু তুলে নাও। সংগীত নাম করবে।'
কিন্তু বাবা উমা দত্ত শর্মা রণে ভঙ্গ না দিয়ে গোঁ ধরে রইলেন। এ দিকে বাবার আদেশ, 'সন্তুরই গন্তব্য তোমার।' একপর্যায়ে গবেষণায় বসে গেলেন শিব কুমার শর্মা। সন্তুরের ব্রিজ আর তার নিয়ে করলেন বিস্তর গবেষণা। শুনতে ভালো লাগে না, এমন টঙ্কার ধ্বনি এড়াতে স্পাইকের বদলে যন্ত্রটিকে পায়ের ওপর বসালেন তিনি। জাপানের 'কোতো' যন্ত্র থেকে ধারণা নিয়ে কাজ করার পর মীড় আর গমকের কাজ হতে শুরু করলেন সন্তুরে।
পরের বছর ১৯৫৬ সালে চলচ্চিত্রে নেপথ্য সংগীতে বাজানোর সুযোগ পেলেন শিব কুমার। ভি শান্তা রামের বিখ্যাত চলচ্চিত্র 'ঝনক ঝনক পায়েল বাজে'। ভি শান্তা রামের পরিচালনায় এই চলচ্চিত্র ছিল সুপারহিট।
কিন্তু চলচ্চিত্র এক কথা আর শাস্ত্রীয় সংগীতের আসর ভিন্ন। তাই কঠোর অনুশীলন চালিয়ে যান শিব কুমার শর্মা। তার লক্ষ্য তখন শাস্ত্রীয় সংগীতের আসর। ততদিনে মুম্বাইতে চলে এসেছেন শিব কুমার।

টানা ৫ বছর কাজ করার পর সন্তুরের নিজস্ব একটি ধরণ দাঁড়ালো। ১৯৫৯ সালের শেষ দিকে বোম্বাইতে বসলো উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর। সে আসরে সন্তুরে এক অনন্য বাদনে মুগ্ধ হলেন আগত শ্রোতা থেকে সংগীত বোদ্ধারাও। সংগীত বোদ্ধারা উপলব্ধি করলেন, সন্তুরের জয় অবশ্যম্ভাবী। সংগীতজ্ঞরা সহাস্যে বুক চাপড়ে বললেন, 'হচ্ছে এবার। এগিয়ে যাও।' দিলেন এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
এই অনুপ্রেরণাতেই পরের বছর ১৯৫৭ সালে সন্তুরে নিজের প্রথম অ্যালবাম বের হলো শিব কুমার শর্মার। এই অ্যালবামটি লুফে নেয় সংগীত পিপাসুরা। এরপর ধীরে ধীরে শিব কুমার শর্মার হাত ধরে আবির্ভূত হলো সন্তুরের সুরের মূর্ছনার মায়া জাদুর পর্ব।
১৯৬৭ সালে কিংবদন্তী বংশীবাদক পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া এবং গিটারবাদক পণ্ডিত ব্রিজ ভূষণ কাবরার সঙ্গে মিশ্র অ্যালবামের পরিকল্পনা করেছিলেন শিব কুমার শর্মা। সে বছরই প্রকাশিত হলো মিশ্র অ্যালবাম 'কল অব দ্য ভ্যালী'। এই অ্যালবামটি আজ পর্যন্ত ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যালবাম।
এরপর একে একে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার সঙ্গে 'সিলসিলা', 'ফাসলে', 'বিজয়', 'চাঁদনি', 'লমহে', 'পরম্পরা', 'সাহিবাঁ' ও 'ডর' এর মতো বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রের নেপথ্য সংগীতে কাজ করেছিলেন শিব কুমার শর্মা। এর প্রথম ও শেষ ছবি ২টি ছিল সবদিক দিয়েই ইতিহাস সৃষ্টিকারী। এর মধ্যে ৪টি চলচ্চিত্রই ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে মনোনীত হয়েছিল।

শিব কুমার শর্মা আর হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার জুটিটি ছিল ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক প্রবাদ প্রতিম স্বর্ণোজ্জ্বল সংগীত জুটি। কেবল তাই নয়, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ইতিহাসেও হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া এবং শিব কুমার শর্মা জুটি ছিল অদ্বিতীয়।
অন্যদিকে কিংবদন্তি তবলাবাদক ওস্তাদ জাকির হোসেনের সঙ্গেও তার ছিল এক অবিশ্বাস্য সংগীত জুটি। ১৯৮৭ সালে ওস্তাদ জাকির হোসেনের সঙ্গে তার রাগ মধুভান্তি ও রাগ মিশ্র তিলাংয়ের দ্বৈত অ্যালবামটিও ছিল ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ অ্যালবাম।
এ ছাড়া 'রাগ পূর্ব কল্যাণ', 'রাগ রাগেশ্বরী', 'আনন্দ'সহ বেশ কয়েকটি দ্বৈত অ্যালবাম উপহার দিয়েছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতের এই ২ বিরলতম প্রতিভা।
বলা বাহুল্য, যে সন্তুর ৫০ দশকের শেষভাগ পর্যন্ত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অবহেলিত, সেই সন্তুরই পরবর্তীতে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের আসর জয় করে পাশ্চাত্যের ইউরোপ, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রের সুবিখ্যাত উচ্চাঙ্গসংগীতের আসরে পরিবেশিত হলো সুউচ্চ মহিমায়।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে সন্তুরকে বিশ্বসংগীতের আপন পর্দায় তুলে ধরার সেই অনন্য মহানায়ক কাশ্মীরের শুভ্র পাহাড়ি উপত্যকার ভূস্বর্গ থেকে উঠে আসা শুভ্রকেশের সংগীতে মায়েস্ত্রো পণ্ডিত শিব কুমার শর্মা।
আজ পণ্ডিত শিব কুমার শর্মার শারীরিক বিচ্ছেদ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সন্তুরের সুরের মূর্ছনা তাকে চিরকাল অমলিন করে রাখবে গোটা সংগীত দুনিয়ায়।
তথ্য সূত্র:
Shiv Kumar Sharma: The Man & His Music/ Ina Pur
'ধনুকের টঙ্কার ধ্বনিকে বশ করে সুরে এনেছি।' প্রথম আলো: সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন হারুন আল রশীদ
'তরুণদের ভালোবাসা বিস্ময়কর'। প্রথম আলো: সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ
Comments