‘মাতৃপ্রেম বা দেশপ্রেম দুটোই আমাকে বেশ টানে’
২০১৯ সালের ৮ জুলাই দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর। সে বছর ১৩ জুলাই সেই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ প্রকাশিত হয়। এই গুণী শিল্পীর প্রয়াণে সাক্ষাৎকারের পুরোটাই আবারও প্রকাশ করা হলো।
এই পথ চলা শুরু হলো যেভাবে?
আমার বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গাতে। আমাদের এলাকায় প্রচুর হিন্দু বাস করতো। সে কারণে একটি সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হয়েছে। আমি বন্ধুদের সঙ্গে গলা ছেড়ে কীর্তন গাইতাম, বাউল গান গাইতাম। বিভিন্ন গানের আসরে যেতাম। বাবা আমাকে নিয়ে যেতেন। এভাবে গানের প্রতি আমার ভালোলাগা তৈরি হয়ে যায়। এরপর বাবা বাড়ির জন্য একটি রেডিও কিনলেন। তখন রেডিওতে গান শেখার অনুষ্ঠান হতো। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে সেই অনুষ্ঠান শুনতাম। সুর মিলিয়ে গান গাইতাম। এভাবেই আমার সঙ্গীতের সঙ্গে পথচলা শুরু হয়।
গণসংগীত কেন বেছে নিলেন?
মাতৃপ্রেম বা দেশপ্রেম দুটোই আমাকে বেশ টানে। দেশপ্রেম আমাকে সাহস যোগায়। সংগীতের অনেক শাখা থাকার পরও আমি সারাজীবন গণসংগীত করেছি মানুষের প্রতি মানুষ হিসেবে আমার দায়বদ্ধতা থেকে। আর আমি আজও মানুষের জন্য গান গাই।
গণসংগীতকে কীভাবে বিশ্লেষণ করেন?
সংগীতের সঙ্গে যখন 'গণ' শব্দটি যুক্ত হয়ে এক ভিন্নধর্মী সংগীত ভাষার জন্ম দেয় তখন তাকে আমরা গণসংগীত বলি। গণসংগীত মুক্তির গান, শোষণ মুক্তির গান এবং মানবমুক্তির গান। সংগীত আমাদের বিশ্বস্ত সহচর। '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট, '৬২, '৬৯-সহ বাঙালির অনেক আন্দোলন সংগ্রামের সাথী এই গণসংগীত।
মোট কতটি ভাষায় গান করেছেন?
বিশ্বের ৩০টির বেশি দেশে আমি সংগীত পরিবেশন করার জন্য গেছি। আমরা বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু ভাষায় যেমন গান করেছি, তেমনি চায়নিজ, কোরিয়ান, জাপানিজ ভাষাসহ বিশ্বের যখন যে দেশে গেছি, সেই দেশের ভাষায় গান তুলে পরিবেশন করেছি। ১৯৭৭ সালে প্রথম কালচারাল ডেলিগেট হিসেবে আফগানিস্তান সফর করি। এরপর বিভিন্ন দেশে গেছি। অনেক জায়গায় সুযোগ পেয়েছি প্রখ্যাত ওস্তাদদের সঙ্গে গান করার। আমার মনে পড়ে, ১৯৮৯ সালে কোরিয়া সফর করেছিলাম। তখন বর্তমান প্রেসিডেন্টের দাদা ছিলেন ক্ষমতায়।
কোন মাধ্যমে গান করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?
আমি আসলে অনেক জায়গায় অনেক মাধ্যমে কাজ করেছি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি মঞ্চে। এখানে একটা মায়া আছে। দর্শক- শ্রোতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হয়। প্রতিক্রিয়াও পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে।
গানের পরিসংখ্যান-
এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি গান করেছি। ৩০টি অ্যালবাম করেছি। আশির দশকে দেবু চৌধুরীর প্রযোজনায় বৈশাখী প্রোডাকশন থেকে 'আউল বাউল ফকির' শিরোনামে আমার প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এরপর ডন মিউজিক থেকে সখিনার সিরিজ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে তিনটি সখিনা ও চারটি পার্বতীপুর স্টেশনে। কনকর্ড থেকে প্রকাশিত হয় শবমেহের, উরিরচরের সখিনা, মধুমিতা মুভিজ থেকে প্রকাশিত হয় মুক্তি, টোকাই, সরগম থেকে সখিনার বিলাপ, শিখা অনির্বাণ অ্যালবাম। সেখানে জন হেনরি, ম্যান্ডেলার মতো গানগুলো ছিল। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
নিজের গানের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় কয়েকটি গানের কথা জানতে চাই-
আমি মনে করি বাগানের সব ফুলই সুন্দর। আমার কাছে আমার সব গানই সন্তানতুল্য। তবে এর মাঝে মায়ের একধার দুধের ধার, ইস্কুল খোলেছেন, মন আমার দেহ ঘড়ি, ও সখিনা, মোর সখিনার কপালের টিপ, দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কালো কালো মানুষের দেশে, বনমালি তুমিসহ বেশ কিছু গান মানুষের মুখে মুখে শুনি।
নিজের কোন পরিচয়ে বেশি ভালো লাগে?
আমি গণসংগীতের শিল্পী হিসেবেই নিজেকে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এরপরও শ্রোতা আমাকে যেভাবে প্রিয় মনে করেন, সেখানে আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ শ্রোতার ভালোবাসাই হচ্ছে বড়। আমি যদি চেতনায় লেলিন হই, তাহলে লালন হতে পেরেছি। যদি মার্ক্স হই চেতনায়, তাহলে মাইজভাণ্ডারী হতে পেরেছি।
একাত্তরের স্মৃতিচারণা-
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ষাটের দশকের আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে গণঅভ্যুত্থান অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। আমার বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার শিবচরে। প্রথমে ১ জুলাই ভারতে ট্রেনিংয়ের জন্য যাই। এরপর যুদ্ধে অংশ নেই। তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যখন অনুষ্ঠান শুনতাম, মনে হতো আমাকে সেখানে গিয়েই গানের মাধ্যমে যুদ্ধ করতে হবে। সেটা আমি করেছি। যশোর রোড ধরে গিয়েছিলাম। মৌসুমী ভৌমিকের যশোর রোডের গানটি আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের উত্তাল ভাষণ শুনে কম বয়সের অনেকেও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। রাজপথে দুরন্ত মিছিলে সবাই ছুটে আসে রেসকোর্স ময়দানে। বঙ্গবন্ধুর বজ্র কণ্ঠ ভেসে আসে। তিনি যেন কবিতার ঢেউ ঠেলে দিয়েছিলেন 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম'। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। আমি স্যালুট করি জাতীয় চার নেতাকে। আমি স্মরণ করি যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাদের।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেই দিনগুলোর কথা বলুন-
স্বাধীন বাংলা বেতারের গান সরাসরি সম্প্রচার হতো। একটা মাইক্রোফোন দিয়ে তবলা, দোতারা, হারমোনিয়ামে ও মন্দিরার সাউন্ড যেত। সেই সময় কত কষ্ট করে আমরা গান করেছি। সেটাকে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতির গান, স্বাধীন বাংলা বেতারের গান ও মুক্তির গান এই তিন পর্বে ভাগ করা যায়।
এখনও যে স্বপ্ন দেখেন-
আমরা যে স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম, সেই স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এটা হতে হয়তো আরও সময়ের প্রয়োজন। আজকের বাংলাদেশ এখনও ধূলি, ধূসর, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের জনপদ। এই জনপদ কবে হবে সখিনার দীপ্ত পদভারে সবুজ ফসলের মাঠ। সেদিন স্বপ্ন ছিল শোষণহীন ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ। কিন্তু এটা বাস্তবায়িত হয়নি। ভবিষ্যতে হবে সেই প্রত্যাশা করি।
মজার স্মৃতি-
আমার বিয়েটা প্রেমের। আমার ভক্ত ও অনুরাগীদের অনেকেই আমাকে চিঠি লিখতেন। এর মধ্যে তিনিও একজন। তাকে ভালোবেসে নাম দিয়েছিলাম বনলক্ষ্মী। এখন সে আমার ঘরের লক্ষ্মী। আমি, ফিরোজ সাঁই ও আমার আরও দুই বন্ধু মিলে শাহবাগে গভীর রাত পর্যন্ত বনলক্ষ্মীর চিঠির জবাব লিখতাম। চিঠি আসত আবার অন্য এক আপার বাসায়। সেখানে গিয়ে চিঠি নিয়ে আসতাম। কত কষ্ট করে একটি চিঠি হাতে পৌঁছাত, তা কল্পনাও করা যায় না।
গান নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা-
গণসংগীতের সমন্বয় পরিষদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংগীত নিয়ে ভবিষ্যৎ হচ্ছে গণসংগীতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হবে। ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী রয়েছে। গণসংগীত একাডেমি করব। আমার বিশ্বাস, এর মধ্য দিয়ে আরও অনেক ফকির আলমগীর বের হয়ে আসবে। আমরা গণসংগীতের তেমন শিল্পী পাচ্ছি না। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব বিকল্প খুঁজে বের করা। এ জন্যই একাডেমি করতে হবে।
অবসর কীভাবে কাটান?
আমি অবসরে লিখি। এ পর্যন্ত আমার ১৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে। আগামীতে আরও কিছু বই বের হবে।
কোনো অপ্রাপ্তি আছে?
আমি ২০১৩ সালে ফেলোশিপ পেয়েছি, ২০১৫ সালে সঙ্গীতে মহাসম্মান পদক পেয়েছি পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে, ২০১৮ সালে ঢালিউড অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে, একুশে পদক পেয়েছি। একুশে পদক পাওয়াটা খুবই স্মরণীয়। কারণ, এবিএম মূসা, সুভাষ দত্ত, কেজি মোস্তফা, হাসান আজিজুল হক, হাসান ইমাম, আলি যাকের, আলতামাসসহ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বলদের সঙ্গে ১৯৯৯ সালে এই পদক পাই। সেই ১৯ বছর আগে। সেই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা পদক আমার প্রাপ্য ছিল। আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শব্দ সৈনিক। গত ৫০ বছরে গণসংগীতকে আমি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে দিয়েছি। বন্যার মতো জাতীয় দুর্যোগ, মহামারি, রোহিঙ্গা ইস্যুসহ সমসাময়িক সামাজিক দায়বদ্ধতা ছাড়াও আমি শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে গান গেয়েছি। লেলিন থেকে লালন, মার্ক্স থেকে মাইজভাণ্ডারী— ৫০ বছর ধরে গানের এই যে তাল ধরে রেখেছি তার জন্য আমি স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার দাবি রাখতে পারি।
Comments