অর্থমন্ত্রী: যত দোষ নন্দ ঘোষ

স্টার ফাইল ফটো

ব্যাংক আমানতের উপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধিসহ কয়েকটা প্রস্তাব নিয়ে ক্ষুব্ধ সরকারি দলের সদস্যরা অর্থমন্ত্রীর উপর ক্ষোভ প্রকাশ করেই চলেছেন। তারা শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব বাতিলের দাবি জানাচ্ছেন। সোমবার বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের কয়েক জন জ্যেষ্ঠ এমপি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের তীব্র সমালোচনা করেছেন। এমনকি তাদের একজন তাকে কম কথা বলারও পরামর্শ দিয়েছেন। তার ভাষায় অর্থমন্ত্রী নাকি বেশি কথা বলছেন এবং সে জন্য সরকারকে বিব্রত হতে হচ্ছে।

জুনের শুরুতে সংসদে বাজেট পাশের পর অর্থমন্ত্রী মহোদয় বলেছিলেন এটা তার জীবনের সেরা বাজেট। এ বাজেটে কোনো দুর্বলতা নেই। সরকারি দল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এই বাজেটকে স্বাগত জানিয়েছিল; অনেক জায়গায় আনন্দ মিছিল পর্যন্ত বের করেছিল। এমন বাজেট দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানো হয়েছিল। কিন্তু ওই যে ব্যাংক হিসাবের উপর আবগারি শুল্ক বাড়ানো, ১৫ শতাংশ একক ভাট, দুর্নীতিতে মূলধন সংকটে থাকা কয়েকটা সরকারি ব্যাংকে মূলধন সরবরাহের প্রস্তাবগুলো অনেক এমপিকে খেপিয়ে তুলেছে। প্রস্তাবগুলোর মধ্য আবগারি শুল্ক প্রসঙ্গটা বেশি আলোচিত, সমালোচিত। প্রস্তাবটা অর্থমন্ত্রীরও দুশমন হয়ে দেখা দিয়েছে।

সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির একজন এমপি মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ পর্যন্ত দাবি করেছেন। শুধু তাই নয় ব্যাংকে বিগত কয়েক বছর অনিয়ম দুর্নীতির ঘটনায় অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হওয়া উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

একটা বিষয় লক্ষণীয়। বাজেটের সমালোচনা করতে গিয়ে সরকারি দলের এমপিদের কেউই সরকারের সমালোচনা করছেন না। তাদের আক্রোশের কেন্দ্রবিন্দু মুহিত। অথচ প্রস্তাবিত বাজেট সরকারের মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হবার পর মুহিত সেটা সংসদে পেশ করেছে। এ বাজেটে সরকারের আর্থিক ও রাজনৈতিক নীতির প্রকাশ ঘটেছে। তাতে অর্থমন্ত্রীর নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রকাশ ঘটেনি। তবে কি সরকারের সমালোচনা করতে ভয়? সরকারের সমালোচনা করলে কি প্রধানমন্ত্রী নাখোশ হবেন?

সমালোচিত সব প্রস্তাবগুলোর জন্য মুহিত কি এককভাবে দায়ী? তাই যদি হয় তবে প্রশ্ন জাগে, কোনো আলাপ আলোচনা ছাড়াই কি মন্ত্রিসভা বাজেট অনুমোদন করে দিয়েছে? রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন হিসেবে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব কি মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত নয়?

আর কয়েক বছরে ব্যাংক খাতে যে লুটপাটের কথা আলোচিত হচ্ছে ওই সব ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারার জন্য কি মুহিত এককভাবে দায়ী? অভিযুক্তরা কিভাবে এত ক্ষমতাবান হলেন যে তাদের বিপক্ষে ব্যবস্থা নেয়া গেলো না এবং টাকা উদ্ধার হল না?

অর্থমন্ত্রী নিজেই জাতীয় সংসদে ২০১৫ সালের ৩০ জুন বাজেট পাসের দিন সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কেন নিতে পারছিলেন না তা বলেছিলেন। তিনি ওই দিন বলেন, “নিজেদের লোকের কারণে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।” তারপর দুই বছর পার হয়েছে। অর্থমন্ত্রী না হয় এককভাবে ব্যর্থ তবে সরকার সমষ্টিগতভাবে কী করেছে গত দুই বছর?

অন্যদিকে, আবগারি শুল্ক প্রস্তাবের জন্য অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করে দুইজন মন্ত্রী সংসদে ঝাঁজালো বক্তব্য দেওয়ায় মন্ত্রিসভার কার্যপ্রণালী নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। মন্ত্রিসভায় কি তাহলে সরকারের প্রস্তাবিত নীতি নিয়ে কোনো বিতর্ক বা আলোচনার সুযোগ নেই? বিনা বিতর্ক এবং আলোচনায় সব কিছু মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়ে যায়? আর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হোক বা না হোক দুই জন মন্ত্রী সংসদীয় রীতি নীতি উপেক্ষা করে কী করে সংসদে উক্ত প্রস্তাবের বিপক্ষে কথা বলেন? কেমন জানি উদ্ভট সব কিছু!

সমালোচনার ঝড় উঠায় অর্থমন্ত্রী আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাবটি বাতিল করা হবে বলে মোটামুটি নিশ্চিত করেছেন। তবে অন্য প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে কিছু বলেননি। যদি অর্থমন্ত্রী তার অন্য প্রস্তাবে অনড় থাকেন তাহলে ক্ষুব্ধ এমপিরা কি করতে পারবেন? জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে অনুমোদনের জন্য। যাদের নিয়ে সংসদ গঠিত সেই এমপিরা যদি ভোট না দেন তাহলেও কি বাজেট পাশ হয়ে যাবে? অবশ্যই সেটা সম্ভব নয়; এমপিদের ভোট ছাড়া বাজেট পাশ হবে না। কিন্তু সরকারি দলের যে সব এমপি বাজেটের কিছু প্রস্তাব নিয়ে ক্ষুব্ধ তারা কি পারবেন প্রস্তাবগুলোর বিপক্ষে ভোট দিতে?

এমপিরা যতই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটান বা ক্ষোভে ফেটে পরুন তাতে অর্থমন্ত্রীর ভয় পাবার বা চিন্তিত হবার কোনো কারণ নেই। তিনি খুব ভালো করেই জানেন সরকার ও দল তার সাথে আছে; তাই দলের এমপিরা ভোট দিয়ে তার প্রত্যেকটা প্রস্তাব পাশ করে দিতে বাধ্য; এর ব্যত্যয় ঘটবে না। কোনো এমপি এদিক সেদিক করলে নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনবেন।

মুহিতের সকল শক্তির উৎস সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০। দলীয় সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভোট দিলেই একজন এমপি অনুচ্ছেদ ৭০ এর আঘাতে সংসদে সদস্য পদ হারাবেন। তাহলে এখন যেসব এমপি মুহিতের কঠোর সমালোচনা করছেন তারাই চোখ কান বন্ধ করে অর্থমন্ত্রীর সব প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিবেন। এটাই হল আমাদের গণতন্ত্রের সৌন্দর্য! সংসদের অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে, কিন্তু ভোট দেওয়ার বেলায় এমপিদের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। হাত পা বেঁধে পানিতে ফেলে দিয়ে বলা হচ্ছে সাতার কাটো, না পারলে দলের সিদ্ধান্ত মেনে নাও বিনা বাক্যব্যয়ে। এভাবেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে একজন এমপি দলের বন্দিতে পরিণত হন।

সেই বন্দিদশার কথাই তুলে ধরেছেন আওয়ামী লীগের এমপি রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম। সোমবার বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বলেন তারা হুইপদের হাতের ইশারায় ভোট দেন। বাজেট পাশে সংসদ সদস্যদের কোনো ভূমিকা নেই। আর ভূমিকা নেই বলেই অর্থমন্ত্রী তার প্রস্তাবে অনড় থাকতে পারছেন। তিনি সংসদ সদস্যদের সংসদে ভোট দানের স্বাধীনতা দেয়ার জন্য অনুচ্ছেদ ৭০ সংশোধনের দাবি জানান।

রফিকুল ইসলামের দাবি দাবি হিসেবেই থেকে যাবে। কোনো দল কখনো চাইবে না এমপিরা স্বাধীনভাবে ভোট দান করুক। এমপিরা যতদিন পরাধীন থাকবে তত দিন মন্ত্রীরা দাপটের সাথে ক্ষমতার ব্যাবহার, অপব্যবহার সব করতে পারবেন। তাদেরকে সংসদে জবাবদিহি করতে হবে না। সরকার মহাশয় জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকবে।

সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদই সরকারের জন্ম দেয় বা গঠন করে। আবার সংসদ চাইলে কোনো সরকারের অবসান ঘটাতে পারে। অর্থাৎ সংসদ হল সরকারের সৃষ্টিকর্তা আর সরকার হল তার সৃষ্টি। কিন্তু সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ থাকার কারণে সৃষ্টিকর্তার উপরে অবস্থান নিয়েছে সৃষ্টি। নিজের সৃষ্টির উপর সৃষ্টিকর্তার নিয়ন্ত্রণ নেই। উল্টো সৃষ্টিই নিয়ন্ত্রণ করে সৃষ্টিকর্তাকে। এটাই হল আমাদের নিজস্ব মডেলের গণতন্ত্র। যে কারণে সংসদে বাজেট পেশ, আলোচনা শুধু আনুষ্ঠানিকতা। এমনটাই চলছে গত কয়েক দশক, এটাই চলবে যত দিন অনুচ্ছেদ ৭০ খড়গ হয়ে থাকবে; যত দিন রাজনৈতিক দৈন্য দূর হবে না; যত দিন দলে গণতন্ত্রের ঠাঁই হবে না।

Comments

The Daily Star  | English

No clear roadmap for investment

The budget for FY26 has drawn strong criticism from business leaders who say it lacks a clear roadmap for improving the investment climate, bolstering industrial competitiveness, and implementing overdue reforms in the banking sector.

15h ago