এরশাদ নির্দোষ, মহান!
বন্দুকের নলের জোরে যিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে বঙ্গভবন থেকে বিদায় করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন; দেশের সংবিধান স্থগিত করে সামরিক শাসন জারি করেছিলেন; চার বছরের অধিক কাল সংবিধান স্থগিত রেখে নিজের তৈরি করা সামরিক আদেশ বলে খেয়াল খুশিমতো দেশ চালিয়েছেন। সংবিধানের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলেও পরবর্তী আরও চার বছরের অধিককাল যিনি দেশে স্বৈরতন্ত্র বহাল রেখেছিলেন; যাকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলকে দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে আন্দোলন করতে হয়েছিল; যার সামরিক শাসন আমলকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে; সেই এরশাদ এখন দাবি করছেন যে রাষ্ট্রক্ষমতা নেওয়ার ক্ষেত্রে তার নিজের কোনো দোষ ছিল না; তিনি নাকি দেশ ও জাতির স্বার্থে ক্ষমতা নিয়েছিলেন!
প্রস্তাবিত বাজেটের আলোচনায় অংশ নিয়ে গত বুধবার তিনি এমন দাবি করেই ক্ষান্ত হননি নিজের পক্ষে সাফাইও গেয়েছেন। তার ভাষ্য ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রাহমান হত্যাকাণ্ডের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেন বিএনপি নেতা বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। এরশাদ দাবি করেছেন এক বছরের মাথায় সাত্তার বলেন, “আমার মন্ত্রিসভার সকল সদস্য দুর্নীতিপরায়ণ। আমি দেশ পরিচালনায় অপারগ। সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাই।’’
এ যেন এক নতুন ইতিহাস! এত দিন যে ইতিহাস আমরা জানতাম তা ভুল। এরশাদ সাত্তারকে বাধ্য করেনি তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। সেনাবাহিনী প্রধান হয়েও এরশাদ সে সময় একটা পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে ক্ষমতার ভাগ চেয়েছিলেন সে কথা আজ ঠিক নয়? জিয়া হত্যাকাণ্ডের পরপরই ১৯৮১ সালেই এরশাদ ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলেন- এমন সব দলিল দস্তাবেজ এখন ভুল? নিজের ক্ষমতা দখলের পথ পরিষ্কার করতে জেনারেল মঞ্জুরসহ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার যে ভূমিকার অভিযোগ সে সব তবে কি আজ অসত্য?
এরশাদের দাবি অনুযায়ী, ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে বিচারপতি সাত্তার নাকি তার উপর জোর করে দেশ পরিচালনার ক্ষমতা চাপিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমরা প্রস্তুত ছিলাম না, কারণ দেশ পরিচালনা করা সহজ ব্যাপার নয়। এটা আমি উপলব্ধি করি। আমি ক্ষমতা নিতে চাইনি। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না, ক্ষমতা নিতে হয়েছিল। বাধ্য হয়ে এই দায়িত্ব আমাকে গ্রহণ করতে হয়েছিল।’’
তার এ বক্তব্য প্রমাণ করে যে ক্ষমতার প্রতি তার কোনো মোহ ছিল না। তিনি সাত্তারের চাপের মুখে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে মহানুভবতার প্রমাণ দিয়েছেন। তিনি সে সময় ক্ষমতা না নিলে এই দেশের কি ভাগ্য বিপর্যয় হত না? এরশাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকা উচিত! অথচ দুর্নীতির দায়ে তাকেই জেল খাটতে হল!
আমরা এত দিন জানতাম এরশাদ নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে তার পূর্বসূরি জেনারেল আইয়ুব খান ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের সব পথ অনুসরণ করেছিলেন। তিনি জাতীয় পার্টি নামক একটি দল গঠন করে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে কারচুপি করে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে নিজের দলকে জিতিয়েছেন। সংবিধান সংশোধন করে নিজের অবৈধ ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসনের বৈধতা দিয়েছেন। কেউ যাতে তার অবৈধ কর্মকাণ্ড নিয়ে আদালতে মামলা করতে না পারেন, সংবিধান সংশোধন করে তিনি সে ব্যবস্থাও পাকাপোক্ত করেছিলেন। ১৯৮৮ সালে যিনি আরেকটি এক দলীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছিলেন। যাকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে গণতন্ত্রের মুক্তির জন্যই শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াসহ অনেক রাজনীতিবিদকে দীর্ঘ দিন রাজপথের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হয়েছে।
সেই এরশাদ এখন বলছেন ভিন্ন কথা। এ তো নতুন ইতিহাস। তিনি বলছেন, “১৯৮৪ সালে নির্বাচন দিয়েছিলাম। নির্বাচন দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কেউ ওই নির্বাচনে অংশ নেননি। তাই আমাকে দল গঠন করতে হয়েছিল।”
আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ নেতারা যারা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে ছিলেন তাদের উপস্থিতিতেই সংসদে এরশাদ এমন উদ্ভট ইতিহাস বর্ণনা করছিলেন। কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি। বাক স্বাধীনতা মানে কি যা ইচ্ছা তাই বলে যাওয়া? বাক স্বাধীনতা মানে কি ইতিহাস বিকৃত করার স্বাধীনতা? বাক স্বাধীনতা মানে কি সংবিধান লঙ্ঘনকারী ব্যক্তির নিজের সাফাইয়ের ফিরিস্তি দেওয়ার জন্য সংসদের সময় বরাদ্দ করা আর সংসদ পরিচালনার ব্যয়ভার জনগণকেই বহন করতে হবে?
আরও মজার বিষয় হল এরশাদ সংসদে মিথ্যাচার করেছেন, বিচারপতি সাত্তার সম্পর্কে মানহানিকর যে মন্তব্য করেছেন তা নিয়ে তার দল বিএনপি বা সাত্তারের কোনো উত্তরসূরি এরশাদের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা পর্যন্ত করতে পারবেন না। কেননা সংসদ সদস্য হিসেবে এরশাদ সাহেব সাংবিধানিক দায়মুক্তি ভোগ করছেন। তার বাক স্বাধীনতা অপরিসীম। তিনি যা খুশি বলতে পারেন। তার বক্তব্য নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এ কেমন গণতন্ত্র? এ কেমন বাকস্বাধীনতা?
ভবিষ্যতে কেউ যেন সংবিধান লঙ্ঘন করে সামরিক আইন জারী করতে না পারে সে জন্য ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে অবৈধ ভাবে রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলকে মৃত্যুদণ্ডের অপরাধ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখলকারী এরশাদ ২০১৪ সাল থেকে মন্ত্রীর পদ মর্যাদায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়ে আছেন। দেশের দুর্বল গণতন্ত্রের কারণেই এরশাদ আজ তার বর্তমান অবস্থানে আছেন। তার স্ত্রী হয়েছেন সংসদে বিরোধী দলের নেতা। দলের তিন জন এমপি মন্ত্রী হয়েছেন। দেশের জন্ডিসাক্রান্ত রাজনীতি সুস্থ না হলে আগামী দিনগুলোতেও এরশাদ এমন অনেক আজগুবি নতুন নতুন ইতিহাস রচনা করবেন। একজন পতিত স্বৈরাচার ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত না হয়ে বরং নিজে লিখে যাবেন সংবিধান লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের নতুন ইতিহাস!
Comments