বাজেটের ধাক্কা সামলাতে ঘরে ঘরে টাকার খনি চাই!
হলমার্ক কোম্পানির কথা মনে আছে? হলমার্কের টাকার খনি ছিল সোনালী ব্যাংক। দেদারছে টাকা নিয়েছে হলমার্কের মালিক দম্পতি তানভীর-জেসমিন। সহযোগিতা করেছে রাঘব বোয়ালরা। সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট। ব্যাংক লুটপাটের ইতিহাসে আসলেই ওটা একটা ‘হলমার্ক’; যা দেখে উৎসাহ পেয়েছে অন্যরা। কিছু লোকের টাকার খনিতে পরিণত হয়েছিল বেসিক ব্যাংক; সেখান থেকেও সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট। জনতা ব্যাংকও বিসমিল্লাহ গ্রুপের টাকার খনিতে পরিণত হল; তার লুটপাট হয়েছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি। এমন করে গত কয়েক বছরে ব্যাংক থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি হরিলুট হয়েছে।
তবে চিন্তার কারণ নেই; আমাদের সরকার বাহাদুরের কাছে আছে সবচেয়ে বড় টাকার খনি। লুট হয়ে যাওয়া ব্যাংকগুলতে মূলধন ঘাটতি মেটাতে দেওয়া হল ১২ হাজার কোটি টাকা এবং আরো দুই হাজার কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে নতুন বাজেটে! সরকার উদারতা দেখিয়েছে। তবে বিষয়টা পরের ধনে পোদ্দারির মত। কেননা ওই সব টাকার মালিক আম মোক্তার জনগণ। যাদের করের টাকায় গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক। তাই যখন কোনো ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট হয়ে যায়, ডাকাতি হয়ে যায়, সেটা জনগণের টাকাই যায়। আবার যখন ওই লুট হওয়া ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটাতে সরকার মহাশয় হাজার হাজার কোটি টাকা দান করেন, সেটাও জনগণেরই টাকা। জনগণের কাছ থেকে সরকার আদায় করে নানা কৌশলে, নানা ধরণের কর আর শুল্কের নাম করে। আম জনতা সে সবের কিছু জানে, অধিকাংশটাই জানে না।
আবার এই যে সরকার গত কয়েক বছর ধরে তেলের দারুণ ব্যবসা করছে, বিশাল অংকের মুনাফা করছে, সেটাও কিন্তু জনগণের পকেট থেকেই টাকা খসিয়ে হচ্ছে। গত কয়েক বছরে সরকার জনগণের কাছে নানা ধরনের তেল বিক্রি করে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি লাভ করেছে। কী দারুণ ব্যবসা! প্রতি লিটার অকটেনে কমপক্ষে ২৭ টাকা, পেট্রোলে ২৩ টাকা, ডিজেলে প্রায় ১৬ টাকা, এবং কেরোসিনে প্রায় ১৭ টাকা লাভ করছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে কম দামে কিনছে, আর দেশের বাজারে নিজের জনগণের কাছে উচ্চ দামে বিক্রি করছে। দাম কমানোর লক্ষণ নেই। অজুহাত হিসেবে বলা হচ্ছে, সরকারি কোম্পানি আগে কয়েক বছর নাকি ভর্তুকি দিয়ে তেল বিক্রি করেছে; জনগণকে কম দামে তেল দিয়েছে। তাতে লোকসান হয়েছে তাই এখন পুষিয়ে নিচ্ছে। কি চমৎকার যুক্তি! আমরা যারা জনগণ রাষ্ট্র তাদের সাথে মাড়োয়ারি কারবারি করে মুনাফা লুটছে। তবে যে টাকা আগে ভর্তুকি দিয়েছে সেই টাকার মালিকও যে জনগণ ছিল সেটা সরকার মহাশয় বোধ করি ভুলে গেছে। আবার এখন যে টাকা দিয়ে তেল আমদানি করে সরকার ব্যবসা করছে সেই টাকার মালিকও জনগণ।
লুট হওয়া ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মেটাতে অনৈতিক ভর্তুকি দিতে সরকার দ্বিধা করছে না। শুধু তেলের দাম কমিয়ে জনগণকে একটু স্বস্তি দিতে সরকারের বুকে শেল-সম বিঁধছে। জনগণেরও যেন সাত চড়ে রা নেই! চড়া দামে তেল কিনেই যাচ্ছে; পকেটে নিশ্চয় টাকার খনি আছে!
সরকার নিজেই যখন জনগণের সাথে অন্যায্য ব্যবসা করে তখন অসাধু ব্যবসায়ীদেরকে কেন উপদেশ বাণী শোনানো হয় খামোখা। সেই জন্যই বোধ হয় অসাধু ব্যবসায়ীরা সরকারের কোনো উপদেশ কানে নেয় না। কারণ সরকার মুখে যা বলে সেটা নিজেই করে না।
যাই হোক। জনগণের পকেটে টাকার খনির সন্ধান নিশ্চয় জানেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী। জানেন বলেই তো তিনি তার জীবনের “শ্রেষ্ঠ” বাজেটে এমনভাবে কর জাল বিছিয়েছেন যেন চুনোপুঁটিও কর না দিয়ে পার পেতে না পারে। প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর না দিলেও পরোক্ষ কর বা ভ্যাট দিতেই হবে। ধনী গরিব সমানে সমানে ভ্যাট দিতে হবে। আকস্মিক বন্যায় ধান হারানো হাওরের অসহায় কৃষক বা মোরার তাণ্ডব থেকে বেঁচে ফিরে আসা বঙ্গোপসাগরের জেলেদেরকেও দিতে হবে নানা ধরনের কর। জেলেরা যেমন কারেন্ট জাল পেতে চুনোপুঁটি সব ধরে ফেলে, তেমনি কর জাল পাতা হয়েছে; কর না দিয়ে রেহাই নেই। চার লক্ষ কোটি টাকা বাজেটের সিংহভাগ যোগান দিতে হবে জনগণকে। নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত জনগণের উপরেই অর্থমন্ত্রীর বেশি ভরসা। তারাই যোগান দিবে সিংহভাগ টাকা। অর্থমন্ত্রী মহোদয় নিশ্চিত করে জানেন শুরুতে একটু উচ্চবাচ্য হবে। যেটা প্রায় সময়ই হয়। আরো অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটবে, সেসব নিয়ে জনগণ ব্যস্ত থাকবে, তাকে নিয়ে সমালোচনা বেশি দিন চলবে না। সেই আত্মবিশ্বাস নিয়েইতো অর্থমন্ত্রী তার বাজেটকে নয় বছরে এমন ঢাউস আকার দিতে পেরেছেন।
১৯৭২ সালে প্রথম বাজেট ছিল এক হাজার কোটি টাকার কম। এক লক্ষ কোটি টাকার কাছে পৌঁছাতে সময় লাগে আরো ৩৬ বছর। সর্ব প্রথম অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বাজেটকে এক লক্ষ কোটি টাকার উপরে নিয়ে যান। সেটা বেশি বেশি দিন আগের কথা নয়; এইতো ২০০৯ সালে। তারপর থেকে প্রতি বছর আকার বেড়েছে গড়ে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি; যা এখন চার লক্ষ্য কোটি টাকার উপরে। এক বছর পর বাজেটের আকার হয়তো ৫ লক্ষ কোটি টাকা হবে। তখনও ভরসা জনগণ; নিম্নবিত্ত আর মধ্যেবিত্ত জনগণ। বিগত বছরগুলোতেও জনগণের টাকায় সরকার চলেছে, এই বছরও চলবে, আগামী বছরগুলোতেও চলবে। জয়তু জনগণ।
টাকা আর টাকা যেন টাকায় সয়লাব দেশ! দেশের গণ্ডি পেরিয়ে টাকা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও গেছে, পাচার হয়ে গেছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির হিসাবে, শুধু ২০১৪ সালেই পাচারের পরিমাণ হচ্ছে ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে মোট পাচারের পরিমাণ ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। দেশ থেকে যতো টাকা পাচার হয়েছে সেই টাকার মালিক কে?
অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা হচ্ছে কারণ তিনি ওই টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তার বাজেট বক্তব্যে কিছু বলেননি। বলবেনই বা কেনো বাজেট ঘাটতি দূর করতে অর্থমন্ত্রীর ওই সব পাচার হয়ে যাওয়া টাকার দরকার নেই। পাচার হওয়া টাকার পিছু পিছু ঘোরার দরকার নেই তার। তার আছে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্ত জনগণ; তারাই সব টাকার যোগান দিবে।
আর অর্থমন্ত্রীর আর্থিক নীতি খুব স্পষ্ট। বেশি বেশি আয় করো, বেশি বেশি ব্যয় করো। বেশি আয় আর বেশি ব্যয় করে তিনি নতুন বাজেটে বাস্তবায়ন করবেন। জনগণের উচিত বাজেটের সাথে তাল মিলিয়ে চলা। তাদের আর্থিক নীতি হওয়া উচিত-- বেশি বেশি আয় করো, বেশি বেশি ব্যয় করো, সংসারের চাকা সচল রাখো। অর্থমন্ত্রী আসলেই পণ্ডিত মানুষ! কেননা বেশি বেশি ব্যয় করলে অর্থমন্ত্রীরই লাভ। তার সরকার আয়কর পাবে, ভ্যাট পাবে, আরো কত ধরনের শুল্ক পাবে।
বেশি বেশি আয় করার জন্য কি করবেন? সংসারের সবাইকে আয় উপার্জন করতে হবে। সীমিত নয়; বেশি বেশি আয় করতে হবে। কিন্তু ন্যায় পথে শুধু চাকরি-বাকরি করে কি পোষাবে? চাকরির পাশাপাশি তবে আরো অন্য কিছু করতে হবে উপরি আয়ের জন্য? আয় আপনাকে বারাতেই হবে। তা না পারলে সংসারের চাকা থেমে যাবে, দোষ কিন্তু তখন সরকারকে দিলে চলবে না। উপায় কী তাহলে? সবচেয়ে সহজ উপায় ঘরে ঘরে যদি টাকার খনি পাওয়া যায়। অর্থমন্ত্রী যত খুশি কর-ভ্যাট-শুল্ক আরোপ করুন আমাদের কোনো অভিযোগ থাকবে না। যত খুশি গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ান; যত খুশি ব্যাংক আমানতের উপর আবগারি শুল্ক বসান; যত খুশি দ্রব্য মূল্য বাড়ুক না কেন আমরা আহা উহু করবো না। আমরা সব দিব; যত চাইবেন, দিব তার অনেক বেশি। ঘটতি বাজেট উদ্বৃত্ত বাজেট করে দিব। আমরা শুধু ঘরে ঘরে টাকার খনি চাই। আমাদের টাকার মেশিন সরবরাহ করতে পারেন। আমরা টাকার বন্যা বইয়ে দিব! আমাদের মাত্র একটা দাবি পূরণ করুন, আমরা আপনার হাজার হাজার দাবি পূরণ করে দিব!
Comments