‘ঘুষ খায় পুলিশে, জান দেয় মফিজে’

​শুনতে অস্বাভাবিক লাগলেও প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ—রংপুরের পীরগঞ্জে আজ সকালে ট্রাক উল্টে ১৬ জন নিহত হবার ঘটনায় কি সরকারের জবাবদিহি করা উচিত?
প্রিয়জনের সাথে ঈদের ছুটি কাটাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরছে মানুষ। ছবি: পলাশ খান

শুনতে অস্বাভাবিক লাগলেও প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ—রংপুরের পীরগঞ্জে আজ সকালে ট্রাক উল্টে ১৬ জন নিহত হবার ঘটনায় কি সরকারের জবাবদিহি করা উচিত?

দৈনিক সংবাদ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায় অনুযায়ী, দুর্ঘটনায় প্রতিটা মৃত্যুর জন্য সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে। কেননা প্রত্যেক নাগরিককে রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব।

রংপুরের পীরগঞ্জে ট্রাক উল্টে যাওয়ার ঘটনায় সরকার কি তবে তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে? সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে কি এ দুর্ঘটনা এড়ানো যেত?

ঘটনার বিবরণে জানায় যায়, সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকটি গাজীপুর থেকে রংপুরের দিকে যাচ্ছিল। ট্রাকের ছাদে সিমেন্টের বস্তার ওপর বসে ঈদে ঘরে ফিরছিলেন স্বল্প আয়ের লোকগুলো। শনিবার ভোর পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার দিকে পীরগঞ্জের কলাবাগান এলাকায় চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে ট্রাকটি রাস্তার পাশের একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায়। এতে ট্রাকে থাকা লোকজন পড়ে গিয়ে সিমেন্টের বস্তার নিচে চাপা পড়েন। ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন ১১ জন। মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে আরও পাঁচজন মারা যান।

কী আশ্চর্য ব্যাপার, ট্রাকের ছাদের উপর ওই স্বল্প আয়ের অসহায় মানুষগুলোকে যাত্রী বানিয়ে ট্রাকটি গাজীপুর থেকে রংপুর পর্যন্ত কয়েকশো কিলোমিটার চলে গেলো অথচ রাস্তায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারো নজরে পড়লো না। কারো কি মনে হল না যে ট্রাকটি ঝুঁকিপূর্ণভাবে মানুষগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে?

সড়ক নিরাপত্তা আইন এমন ঝুঁকিপূর্ণ চলাচলের অনুমোদন দেয় না। কোনো পরিবহন সক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী বহন করলে পুলিশ বাধা দিবে। আর বাস বা ট্রাকের ছাদে যাত্রী বহন করার তো কোনো সুযোগই নেই। অথচ গাজীপুর থেকে রংপুর পর্যন্ত ট্রাকটি চলে গেলো কেউ খেয়াল করল না। পুলিশের সদস্যরা মহাসড়কে তাহলে কী দায়িত্ব পালন করছে? তাহলে যে অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে শোনা যায় সেসব সত্যি? কিছু টাকার বিনিময়ে তারা ‘ম্যানেজ’ হয়ে যায়? নজরদারি করার দায়িত্ব যাদের উপর তারা কিছু টাকায় ম্যানেজ হয়ে যায়। বাস, ট্রেন, লঞ্চ, স্টিমার—সবকিছুর ভাড়া কয়েক গুণ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত যাত্রী বহন চলে দেদারসে। সড়কপথ, নৌপথ—সবখানেই অরাজকতা বাড়ে; সাথে বাড়ে দুর্ঘটনা, আর প্রাণহানি। প্রত্যেক ঈদের সময় এমনটা ঘটে। সড়ক পথে যেন লাশের মিছিল দেখা যায়। এসব ঘটনায় আইন প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট বাহিনী ও কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠে। প্রত্যেকটা দুর্ঘটনা প্রমাণ করে, দুর্বল শাসন ব্যবস্থায় মানুষের যান মাল কতটা নিরাপত্তাহীন।

এখন কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, যে মানুষগুলো ট্রাক উল্টে মারা গেলো তাদের জ্ঞান বুদ্ধি নিয়ে। কেন তারা এত ঝুঁকি নিয়ে ট্রাকে চেপে বাড়ি ফিরতে গেলেন?

হতাহত ব্যক্তিদের বেশিরভাগই পোশাক শ্রমিক, স্বল্প আয়ের। তাদের অধিকাংশই লালমনিরহাট জেলার। গাজীপুর থেকে প্রত্যেকে চারশো টাকা করে ভাড়া দিবে বলে সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকের উপর উঠে বসেছিল। ঈদের সময় ওই রুটের বাস ভাড়া বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় এক হাজার টাকা। তাও টিকিট পাওয়া মুশকিল। গাজীপুর থেকে তাদের গন্তব্যের দূরত্ব চারশো কিলোমিটারের বেশি। ট্রাকে অতটা পথ পাড়ি দেওয়ার কষ্ট তাদের কাছে ছিল মামুলি ব্যাপার। তাদের জীবন অনেক মানুষের জীবনের মতো অমন আরাম আয়েশের নয়। তবু যেন তাদের খেদ নেই, কষ্টগুলোকে তারা মেনে নিয়েছে নিজেদের ভাগ্য হিসেবে। তাইতো ট্রাকে চেপে কয়েকশ কিলোমিটারে যাত্রার ঝুঁকিও তাদের কাছে ছিল গৌণ। তারা বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল স্বজনদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে, অথচ স্বজনদের জন্য তারা কান্না হয়ে ফিরলেন।

উত্তরের কয়েকটা জেলায় যেসব মানুষের বুদ্ধি একটু কম এবং সহজ সরল প্রকৃতির তাদেরকে নাকি ‘মফিজ’ বলে ডাকা হয়। এ এলাকার লোকেরা অনেক ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে। যারা বাস বা ট্রাকের ছাদে চড়ে তাদেরকেও নাকি ‘মফিজ’ বলে ডাকা হয়। এই উপাধি নিশ্চয় তাদের প্রতি সম্মানের নয়। তাদের অসহায়ত্ব এবং সরলতার প্রতি কটাক্ষ করা। এসব স্বল্প আয়ের মানুষগুলো যাতে একটু আরামে, নিরাপদে ঈদে বাড়ি ফিরতে পারে সে জন্য আমাদের রাষ্ট্র তথা সরকার কি কিছু করতে পারে না?

ট্রাক উল্টে মরে যাওয়া মানুষগুলোকে আর কোনো দিন কেউ ‘মফিজ’ বলে ডাকতে পারবে না। ওই অপবাদ থেকে তারা মুক্ত। তবে তাদের এমন মৃত্যুর দায়ভার রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। তারা এমন করে মরে গিয়ে একটা জোরালো বার্তা দিলো যে, রাষ্ট্র তাদের জান মালের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ, তাই নয় কি?

রাষ্ট্র যদি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারতো তবে নিশ্চয় এত বেশি সংখ্যক দুর্ঘটনা ঘটতো না। তাই দুর্ঘটনায় আহতদের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে রাষ্ট্রকে নানা পদক্ষেপ নিতে হবে। নিহতদের পরিবার পরিজনকে দিতে হবে আর্থিক সহায়তা। তাদের প্রতি রাষ্ট্রের করুণা নয়। রাষ্ট্র যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় অন্যের যে ক্ষতি হয়েছে তার জন্য দিতে হবে ক্ষতিপূরণ।

Comments

The Daily Star  | English

Mob justice is just murder

Sadly, when one lynching can be said to be more barbaric than another, it can only indicate the level of depravity of some our university students

1h ago