ঘোড়া, গাধা, খচ্চরের মাংসও আমাদের মৌলিক খাদ্য হচ্ছে!

ঘোড়া, গাধা, শূকর এবং খচ্চরের মাংসও নাকি এখন আমাদের মৌলিক খাদ্য! এতদিন ধরে জানি, বাঙালির প্রধান তথা মৌলিক খাবার ভাত-মাছ। সেই মাছে ভাতে বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে চাইছেন অর্থমন্ত্রী মহোদয়? তিনি প্রস্তাবিত বাজেটে ঘোড়া, গাধা, শূকর এবং খচ্চরের মাংসকে আমাদের মৌলিক খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেই তিনি থেমে যাননি। এগুলোকে মৌলিক খাবার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি এগুলোর উপর থেকে বহুল আলোচিত-সমালোচিত এবং তাঁর রাজস্ব বোর্ডের প্রাণের ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। ফলে, এখন থেকে জীবন্ত ঘোড়া, গাধা, খচ্চর ও ঘোটক আমদানি করতে গেলে ভ্যাট দিতে হবে না। আমদানির পর অন্যদেরকে সরবরাহ করতে গেলেও ভ্যাট দিতে হবে না।
প্রস্তাব অনুযায়ী ঘোড়া, গাধা, খচ্চর, ঘোটক বা শূকরের মাংস বা এদের ভোজ্য নাড়ি-ভুরি আমদানি এবং তা সরবরাহ করলে ভ্যাট দিতে হবে না। তাজা, ঠাণ্ডা, হিমায়িত যেভাবেই আমদানি করুন না কেন ভ্যাট লাগবে না। অর্থাৎ, জীবন্ত ঘোড়া, গাধা, খচ্চর, ঘোটক অথবা এদের মাংস আমদানি করলে কোনো ভ্যাট দিতে হবে না।
এতো বড় ছাড়ের পরও এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। প্রস্তাবের প্রশংসা হচ্ছে না। সবাই ব্যস্ত ওই এক আবগারি শুল্ক নিয়ে। ব্যাংকে গচ্ছিত আমানত থেকে কিছু টাকা বেশি কেটে নিবেন বলে তাই নিয়ে এতো লঙ্কাকাণ্ড হচ্ছে। সংসদ সদস্যরা সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের উপর ম্যারাথন আলোচনা করছেন। তাঁদের নজরেও আসেনি শূকর, ঘোড়া এবং গাধার মাংসকেও এখন আমাদের মৌলিক খাদ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি। সবাই চাইছেন ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের উপর থেকে প্রস্তাবিত আবগারি শুল্কের প্রত্যাহার। তাঁদের অধিকাংশই বলেছেন, সামনে নির্বাচন, এই সময়ে ব্যাংক আমানতের উপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি জনমনে বিরক্তি ও ভীতি ছড়িয়েছে, এই পদক্ষেপ সরকারের ক্ষতি করছে।
এই আবগারি শুল্ক আলোচনায় ধামাচাপা পরে গেছে ভ্যাট; যে ভ্যাটের আসন্ন চাপে চাপা পড়ার আতঙ্কে আছেন স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষ। কেননা, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে যে হারে সে হারে জনগণের আয় বাড়বে না। ফলে সীমিত আয়ের জনগণকে সংসারের ঘাটতি বাজেট সামাল দিতে হবে। তবে এমপিদের আলোচনায় সেসব তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। তারা ব্যস্ত আবগারি শুল্কের প্রতিবাদ জানাতে।
আবগারি শুল্কের সমালোচনায় এমপিদের সঙ্গে তাল মিলিয়েছেন দুইজন মন্ত্রীও। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যাংকে আমানতের উপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করেছেন। মতিয়া বলেছেন, “ব্যাংকের সুদ নিম্ন পর্যায়ে, ব্যাংক সার্ভিস চার্জ কাটে। এর মধ্যে এই আবগারি শুল্ক হবে মরার উপর খাঁড়ার ঘা।”
সংসদে তাঁদের সমালোচনা যুক্তিসংগত নয়, উদ্ভটও বটে। তাঁদের এখন উচিত সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে কথা বলা। এটাই সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়ম এবং রীতিনীতি। আমাদের সাংবিধানিক বিধানও তাই। তাঁরা যদি বাজেটে আবগারি শুল্ক বাড়ানোর বিপক্ষে হোন তাহলে তাঁদের উচিত ছিল অনেক আগেই বাজেট প্রণয়নের সময় এবং মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের সময় এই প্রস্তাবের প্রতিবাদ করা। তা তাঁরা করেছিলেন বলে জানা যায়নি।
এখন সংসদে দাঁড়িয়ে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করা মন্ত্রিসভার সমষ্টিগত দায়বদ্ধতা নীতির পরিপন্থি। অবশ্য, সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য আমাদের অনেক রাজনীতিবিদদের কাছে সংসদীয় রীতিনীতি তেমন গুরুত্ব বহন করে না।
তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী মোজাম্মেল হক তাঁর সমালোচনার যৌক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি কেবিনেট সদস্য, সেই হিসেবে এই বাজেট অনুমোদনের সময় মন্ত্রিসভার বৈঠকে আমিও ছিলাম, তারপরেও যেহেতু জনগণের প্রতিনিধিত্ব করি সেজন্য বর্ধিত এই শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।”
যা হোক, একটা বিষয় ইতোমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ব্যাংক আমানতের উপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব সরকারের জন্য শাপে বর হয়ে দেখা দিয়েছে। কেননা, সবাই যেভাবে এই প্রস্তাবের কড়া সমালোচনা করছেন তাতে মনে হতেই পারে যে বাজেটে এটাই একমাত্র জনস্বার্থের পরিপন্থি প্রস্তাব। তাই এই প্রস্তাবটা যদি বাতিল হয়ে যায় তাহলে বাজেট নিয়ে আর কারও কোন আপত্তি থাকবে না। অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এই প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত বাতিল করতে পারেন। তাহলে কি সবাই সন্তুষ্ট হবেন?
তবে এই আলোচনার ঝড়ে শূকর, ঘোড়া, গাধা, খচ্চর ও ঘোটকের মাংসও আমাদের মৌলিক খাদ্য করার প্রস্তাব আলোচিত হলো না। জাতীয় সংসদে উত্থাপিত অর্থ আইনে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সেটা এমপিদের ভোটে অনায়াসে পাশ হয়ে যেতে পারে। প্রস্তাবটি পাশ হওয়ার পর শূকর, ঘোড়া, গাধা, খচ্চর ও ঘোটক জীবন্ত অথবা এদের মাংস আমদানি কমপক্ষে আগামী এক বছরের জন্য ভ্যাট অব্যাহতি পাবে। কেউ চাইলে যত খুশি আমদানি করতে পারবেন। এতে করে কে বা কারা বেশি লাভবান হবেন তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে অনেকের বিকল্প খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য এই উদ্যোগ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে!
অর্থ বিলটি পাশ হওয়ার পর শূকর, ঘোড়া, গাধা, খচ্চর ও ঘোটকের মাংসও আমাদের মৌলিক খাদ্য হিসাবে আইনগত মর্যাদা লাভ করবে। তাই বলে কি সেগুলো আসলেই আমাদের প্রধান খাদ্যে পরিণত হবে? সংসদে কোন প্রস্তাব বা বিল পাশ হলেই কি সকলের কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা পায়?
Comments