দুঃখিত স্যার আরেফিন সিদ্দিক, খবরটা ভুয়া মনে হয়েছিল

অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে সংবাদটা। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি গত সাত বছরে তার প্রাপ্য সোয়া এক কোটি টাকা না নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে দিয়ে দিয়েছেন, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক চাহিদা একটু হলেও পূরণ হয়।

কিছুদিন আগে দুইজন ভিসির বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ বেশ আলোচিত হচ্ছিল। আরেক জন ভিসি তার নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সন্তান-সম ছাত্রদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন। সাদা দল, নীল দল নামে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের দলবাজির খবরতো এখন আর কোন সংবাদেরই আওতায় পরে না। তবু দলবাজি চলছে এবং চলবে। ছাত্র রাজনীতিতে পচন ধরেছে অনেক আগেই। ছাত্র রাজনীতির নামে গুণ্ডামি মাস্তানি, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল, খুন-খারাবিও চলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। শিক্ষকদেরকে অপমান করার খবরও আসে হরহামেশা। সব মিলিয়ে একটা দমবন্ধ হবার মত গুমোট, অসুস্থ এবং হতাশাজনক পরিবেশ বিরাজ করছে চারদিক।

ঠিক এমন পরিবেশে সংবাদটা যে কারো কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতেই পারে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক গত সাত বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ টাকা সাশ্রয় করেছেন। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনে কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দীনের বাজেট বক্তৃতায় বিষয়টি প্রকাশ পায়। তিনি জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে আরেফিন সিদ্দিক সর্বোচ্চ সময় দেন এসব পরিকল্পনার কাজে। অতিরিক্ত এসব কাজে সময় দেওয়ার জন্য নির্ধারিত থাকে ভাতা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়েও এ ধরনের ভাতা আছে। আর ভর্তি পরীক্ষায়ও প্রধান পরীক্ষকদের অনেক টাকা নির্ধারিত থাকে ভাতা হিসেবে। কিন্তু উপাচার্য কোনো ভাতা গ্রহণ করেননি।

কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দীন নিশ্চয় ভুল তথ্য দেননি। তাকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করা হলে তিনি সংশোধনী পাঠাতেন। সেটা করেননি। বরং খবরটা প্রথমে একটা বা দুইটা নিউজ পোর্টালে প্রকাশের পর অন্যরাও খোঁজ নিয়ে সত্যতা পেয়েছে।

আরেফিন সিদ্দিক একটা দলের রাজনীতি অনুসারী। শিক্ষক রাজনীতিতে তিনি আওয়ামী লীগপন্থি নীল দলের নেতা ছিলেন দীর্ঘ দিন। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে দলের রাজনীতির প্রতি তিনি চোখ কান বুঝে আনুগত্য প্রকাশ করছেন, যেমনটা অনেকেই করেন কোন সুবিধা আদায়ের জন্য, কোথাও কোনো পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য। বিনা নির্বাচনে তিনি যখন ভিসির দায়িত্ব নিলেন সাত বছর আগে তখন অনেক সমালোচনা হয়েছিল। যারা তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তার সম্পর্কে জানতেন তাদের কাছেও খটকা লেগেছিল। শেষ পর্যন্ত আরেফিন সিদ্দিকিও স্বার্থের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলেন! তিনি কোনো সমালোচনার জবাব দেননি। তিনি নীরবে কাজ করে যাওয়াকে ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছেন। গত কয়েক বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজট কমাতে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে।

কোন প্রকার ভাতা না নিয়েই যে তিনি কাজ করে গেছেন সে খবরটাও কিন্তু এত দিন কোথাও প্রকাশ পায়নি। তিনি নিজেও কাউকে জানাননি। প্রচার বিমুখ থেকেছেন। এমনটা ভাবা যায় এই যুগে! অনেক বড় একটা পদে থেকে ভালো কিছু করে নিজের প্রচার প্রচারণা চালাবেন না, তা কি ভাবা যায়? কিভাবে এমন একটা খবর এত দিন আড়ালে থাকল! সবগুলো জাতীয় সংবাদপত্রের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিধি আছে। তাছাড়া আরেফিন সিদ্দিকি যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একজন শিক্ষক, দীর্ঘদিন ধরে তিনি পড়িয়েছেন সেখানে। তার অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী এখন দেশের সবগুলো জাতীয় সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে সেগুলো পরিচালনা করছেন। বড় বড় সাংবাদিক হয়ে যাওয়া তার ছাত্র-ছাত্রীরাও কেউ জানতেন না তাদের স্যার এমন একটা বিরল নজীর স্থাপন করে চলেছেন।

একজন ব্যবসায়ী বা ধনী রাজনীতিবিদের কাছে হয়ত সোয়া এক কোটি টাকা অনেক বেশি কিছু নয়। এক কোটি টাকা না নিয়ে তারা নিজের মাহাত্ম্য প্রচার করতে পারেন, যেটা তাদের কাছে নতুন বিনিয়োগ। যে বিনিয়োগের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বড় কিছু পাবেন বলে আশা করে থাকেন। কিন্তু একজন শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এক কোটি টাকা না নিয়ে ভবিষ্যতে কী বড় কিছু পাবেন বলে আশা করতে পারেন?

বর্তমান বাস্তবতায় আমরা অনেক সংশয়, সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত। এখনও আমাদের অনেকে বিশ্বাস করতে পারছেন না যে আরেফিন সিদ্দিক নিঃস্বার্থভাবে এমন নজীর স্থাপন করেছেন। কেউ কেউ বলবেন, এক কোটির মায়া ছেড়েছেন, তাহলে কয় কোটি কামিয়েছেন? বা বড় কোনো প্রতিদান পাওয়ার প্রত্যাশা করেন?

তবে আরেফিন সিদ্দিকির স্থাপন করা নজীর অন্য একটা দিক প্রকাশ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদটা যে কী লোভনীয় তার কিছু আলামত পাওয়া যায়। কী পরিমাণ আর্থিক সুবিধা সেখানে আছে তারও কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়! সে জন্যই বোধ হয় ভিসি হবার জন্য দলবাজি করতেও শিক্ষকরা দ্বিধা করেন না।

যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কোটি টাকার বেশি ভাতা না নেওয়ার খবর বের হয়েছে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর আগে ভিসির চেয়ার দখলের নজিরও আছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই একজন ভিসির কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশের নামকরা সাহিত্যিকরা রম্য রচনাও লিখছেন।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত প্রায় একশ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক জন ভিসি এসেছেন; তাদের মধ্য দুই চারজন পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। পাণ্ডিত্য না থাকা দোষের কিছু নয়, কারণ ভিসি হতে পণ্ডিত হতে হয় না। হতে হয় ভাল একজন প্রশাসক। থাকতে হয় প্রশাসন চালানোর দক্ষতা। আরেফিন সিদ্দিকি পণ্ডিত ব্যক্তি নন। তিনি কতটা দক্ষ প্রশাসক সেটা নিয়ে আলাদা আলোচনা হতেই পারে। কিন্তু তার প্রাপ্য সোয়া এক কোটি টাকা ভাতা না নিয়ে তিনি যে নজীর স্থাপন করেছেন সেটা বিরল। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের জন্য অনুকরণীয়।

আরেফিন সিদ্দিকির ভাতা না নেওয়ার বিষয়টা প্রকাশ করে কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড.কামাল উদ্দীনের আশাবাদ যথার্থ “দেশের জনগণের করের টাকায় পরিচালিত বিভিন্ন সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাথাভারী প্রশাসন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের এই দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নেবে।”

Comments

The Daily Star  | English

New polls timing: BNP upbeat, process irks Jamaat, NCP

The interim government’s revised election timeline with certain conditions has stirred cautious optimism as well as raised questions among  political parties.

9h ago