ধর্ষকের সাথে রাষ্ট্রকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত?

প্রতিটি ধর্ষণ ঘটনায় ধর্ষকের সাথে রাষ্ট্রকেও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেতে পারে।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয় বলেই তো ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। নিজেকে রক্ষা করতে না পারায় ধর্ষিতা যেমন নিজের ব্যর্থতার গ্লানি বয়ে বেড়ায়, তেমনি রাষ্ট্রেরও উচিত নিজের ব্যর্থতার গ্লানি অনুভব করা। প্রতিটা ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষিতার চেয়ে রাষ্ট্রের গ্লানি বেশি হওয়া উচিত।

নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মানে নিশ্চয় যত্রতত্র শুধু পুলিশ মোতায়েন করার কথা কেউ বলবে না। একটা ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে তার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীকে যথাযথ শাস্তি দেওয়ার সাথে ধর্ষণের শিকার যারা তাদের পাশে রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে। এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেন সবাই—নারী ও শিশু—ঘরে বাইরে সর্বত্র নিরাপদ বোধ করেন। আইনের চোখে যাতে সবাইকে সমানভাবে দেখা হয়, সবাই যেন আইনের সমান আশ্রয় লাভ করেন, সে দিকটাও নিশ্চিত করতে হবে। একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর ছেলে যেন ধর্ষণ করে টাকার জোরে পার না পেয়ে যায়; আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষিতা বা যৌন হয়রানির শিকার হবার পর মামলা করতে থানায় গিয়ে যেন হয়রান না হয়। একজন দিন মজুরের মেয়ের যে অধিকার তার চেয়ে বেশি সুবিধা যেন কোনো ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর সন্তান না পায়, সে দিকটাও রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হবে।

আইনের আশ্রয় লাভের সময় যেন ধনী গরিব বিবেচনা করে পক্ষপাতিত্ব না করা হয়। নিজের শিশু কন্যার উপর যৌন হয়রানির বিচার না পেয়ে কোনো পিতাকে যেন শিশু সন্তানসহ ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে না হয়। আইন যেন ধনীর কাছে খোলা আকাশ, আর গরিবের কাছে মাকড়সার জালের মতো উপস্থিত না হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। আর এই সব কিছু করতে হবে আইনের শাসনের জন্য, কোনো ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নয়।

রাষ্ট্র এই সব দায়িত্ব পালন করতে আমরা যারা জনগণ তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ। আমাদের প্রতি কোনো করুণা নয়, আমাদের সব ঝুঁকি থেকে, বিপদ থেকে নিরাপদ রাখা রাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব, এটা চ্যারিটি নয় আমাদের প্রতি। রাষ্ট্রের সাথে এটাই আমাদের চুক্তি, সামাজিক চুক্তি।

জন্মগতভাবে আমরা স্বাধীন। আমরা যা কিছু করার স্বাধীনতা ও ক্ষমতা রাখি। কিন্তু আমরা আমাদের অসীম স্বাধীনতাকে সমর্পণ করেছি রাষ্ট্রের কাছে। আমাদের ক্ষমতায় বলীয়ান রাষ্ট্র। বিনিময়ে রাষ্ট্র দিবে আমাদের নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচার, যেন কখনো আইন নিজ হাতে তুলে নিতে না হয়। এটাই হলো সামাজিক চুক্তি।

আবার রাষ্ট্র যাতে সামাজিক চুক্তি ভালোভাবে পালন করতে পারে সে জন্য অর্থের যোগান আমরাই দিয়ে থাকি। সরকারি মন্ত্রী, আমলা, এমপি, পুলিশ, প্রশাসন যাই বলুন না কেন সবার বেতন-ভাতা আমরা জনগণ বহন করি। তারা সবাই আমাদের ভালোর জন্য কাজ করবেন বলেই আমরা তাদের জন্য অর্থ ব্যয় করি। রাষ্ট্রের সাথে আমাদের যে চুক্তি সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করবে তারা। তাদের দায়িত্ব পালনে গাফিলতির কারণে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়ে পড়তে পারে। ব্যর্থতার জন্য রাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করা গেলে, রাষ্ট্রকেও ধর্ষণকারীর সাথে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেতেই পারে। ধর্ষকের শাস্তি যদি হয় জেল জরিমানা, তাহলে রাষ্ট্রকেও শাস্তি পেতে হবে চুক্তি পালনে ব্যর্থতার জন্য। এক পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করলে বা চুক্তি মোতাবেক কাজ না করলে অন্য পক্ষের ক্ষতি হতে পারে। রাষ্ট্রের কি শাস্তি হতে পারে? জরিমানা—যা রাষ্ট্র দিবে একজন ধর্ষিতাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে।

অনেক দূরে যেতে হবে না উদাহরণ খুঁজতে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকালেই রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্ষিতাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার অসংখ্য নজির খুঁজে পাওয়া যাবে। আদালত অনেক রায়ে বলেছেন যে রাষ্ট্র ধর্ষিত নারীর সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে আদালত এ কথাও বলেছেন যে ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে কখনো একজন নারীর হারানো সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, তার গ্লানি দূর করা সম্ভব নয়।

তাই রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রকে যারা পরিচালনা করেন, যারা আমাদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য তাদেরকে যদি আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়, যদি তাদেরকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা যায় তাহলে নিশ্চয় তাদের ভেতর দায়িত্বশীলতা জন্মাবে। আমাদের শুধু বিচারহীনতার সংস্কৃতি নয়, সাথে চলছে জবাবদিহিতাহীনতার সংস্কৃতি। সবাই কাজ করতে চায়, কেউ জবাবদিহি করতে চায় না।

যখন একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়, ধর্ষক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ করে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া, দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, যেন অন্য কেউ সাহস না পায় ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধমূলক কাজ করতে। এই জন্য রাষ্ট্রের পুলিশ প্রশাসনকে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে। পুলিশকে যাতে আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে কে স্বর্ণ ব্যবসায়ীর সন্তান আর কে দিন মজুর এমন বাছবিচার করতে না হয় তেমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ পুলিশ প্রশাসনের প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে। অথচ এখনো মনে হয় যে পুলিশ পারে না এমন কোনো কাজ নাই। গত বৃহস্পতিবার রাতে বনানীর ধর্ষণের অভিযোগে দুই যুবককে গ্রেফতার সেটাই প্রমাণ করে। পুলিশ যাতে সকল প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে মামলার তদন্ত করতে পারে তেমন পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব সরকারের।

সব শেষে বলতে চাই, প্রতিটা ধর্ষণের ঘটনায় রাষ্ট্রেরও লজ্জিত হওয়া উচিত। যেদিন রাষ্ট্র লজ্জা পাবে, সেই লজ্জা দূর করার আন্তরিক পদক্ষেপ নিবে সেদিন থেকে ধর্ষণের ঘটনাও কমে যাবে। নারীরা নিরাপদ থাকবেন ঘরে-বাইরে সর্বত্র। রাষ্ট্রকে আর চুক্তি ভঙ্গকারী হতে হবে না।

Comments

The Daily Star  | English

Pilots faked flying records

CAAB inquiry finds, regulator yet to take action

8h ago