বন্যা আক্রান্ত স্বদেশ: উৎসব আয়োজনের একটি বিকল্প ভাবনা
“সর্বগ্রাসী বন্যারে তোর নেইকো কোনো মায়া, করাল গ্রাসে গ্রাসে গেল বাংলা মায়ের কায়া” -- সময়টা ঠিক মনে নেই কিন্তু মনে আছে আমরা তখন স্কুলে পড়ি, দেশে খুব বড় ধরনের একটা বন্যা হয়েছিল। আমি আর আমার বান্ধবী সুমি সেসময় খেলাঘর করতাম। আসাদগেট নিউকলোনির কলকণ্ঠ আসরের পক্ষ থেকে আমরা সবাই বেশ কয়েকদিন কলোনিতে, লালমাটিয়া এলাকাতে ঘুরে ঘুরে, এই গানটি গেয়ে বন্যার্ত মানুষের জন্য টাকা, কাপড়, শুকনো খাবার, ওষুধ সংগ্রহ করেছিলাম। আমরা শিশু-তরুণরা গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে হেঁটে যেতাম, পাশে ছিল একটা ঠেলাগাড়ি, যেখানে সংগৃহীত জনিসগুলো রাখা হতো। সেইসময়ে দেশজুড়ে খেলাঘরের ছেলেমেয়েরা এভাবেই ত্রাণ সংগ্রহ করেছিল। পরে কেন্দ্রীয় খেলাঘরের উদ্যোগে তা বিতরণ করা হয়েছিল।
এরপর পেলাম ১৯৮৮ এর বন্যা। আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। দেশে বন্যা, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও বসে ছিল না। টিএসসিতে বড় টেবিল পেতে রাতদিন রুটি বানিয়েছে, স্যালাইন তৈরি করেছে, কেউ কেউ দলবদ্ধভাবে টাকা, ত্রাণ সংগ্রহ করেছে বিতরণের জন্য। ছেলেমেয়েরা কাজ করেছে নিজেদের মত করে। রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোও বসে ছিল না। আমার চাচাতো ভাই তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নিজেরাই নৌকা নিয়ে দিনের পর দিন বানভাসি মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছে। এই ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও আছে।
আজকে পাবলিক, প্রাইভেট মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক বেশি। স্কুল-কলেজেরও অভাব নেই। শুধু অভাব দেশাত্মবোধের, মানুষের প্রতি ভালবাসার। ভার্চুয়াল দেশাত্মবোধ আমাদের সবাইকে বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে এনেছে। আমরা সবকিছুকেই অনলাইনে দেখি, দেখতে ভালোবাসি। সে কেনাকাটা থেকে ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ সবকিছুই চলে অনলাইনে।
একটি করে দিন যাচ্ছে আমাদের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। দেশের চারপাশ পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। এমনকি খোদ ঢাকা শহরও তলিয়ে যাবে এমন আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০টি জেলার ছয় লাখ মানুষ বন্যা আক্রান্ত। তাদের ঘরবাড়ি, জিনিষপত্র, পশুপাখি, স্কুল-কলেজ সব ভেসে যাচ্ছে বানের জলে। ইতোমধ্যে বহু মানুষ মারা গেছে। গত তিনদিনে শুধু দিনাজপুরেই বন্যায় মারা গেছে ২০ জন। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ ভাঙ্গার খবর আসছে। পানি নেমে যাওয়ার পর অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে। মারাত্মক পানিবাহিত রোগ, খাদ্যাভাব দেখা দেবে। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংস্কারের প্রশ্ন আসবে। তখন প্রয়োজন পড়বে আরও বেশি সাহায্য-সহযোগিতা।
বাংলাদেশের উপরে যেদেশগুলোর অবস্থান -- ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন সবখানে বন্যা হচ্ছে। নদনদীর পানি উপচে পড়ছে। ভারত তিস্তা বাঁধের সব মুখ খুলে দিয়েছে, ফলে হুহু করে পানি বাড়ছে আমাদের তিস্তা, গোমতী, মহানন্দা, যমুনায়। পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যাচ্ছে সুনামগঞ্জ, সিলেটসহ আরও অনেক জেলা।
বাংলাদেশের জনগণের বিপদের কোনো শেষ নেই। আজ জঙ্গি হামলা, কাল রাজনৈতিক বিরোধ, আরেকদিন হেফাজতিদের উত্থান, অথবা ৫৭ ধারা, সেতুতে ফাটল, ফ্লাইওভার ভেঙে পড়া, হানাহানি, নারী নির্যাতন, শিশু ধর্ষণ -- এসব চলছেই। এর উপর যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক চরম আকারে এসে হানা দেয়, তখন অবস্থা খুবই কঠিন হয়ে ওঠে। চারিদিকে বানভাসি মানুষের কান্না, হাহাকার, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অগ্নিমূল্য।
এরমধ্যে আমাদের সামনে আসছে ঈদ। এতগুলো মানুষকে হাহাকারের মধ্যে রেখে আমরা কীভাবে ঈদের আনন্দ উপভোগ করবো? কীভাবে পোলাও কোরমা রান্না করে খাবো? কীভাবে লাখ লাখ টাকা দিয়ে কোরবানি দিবো? আমরা কি আমাদের আনন্দটা দুস্থদের সাথে ভাগ করে নিতে পারি না? পারি না কোরবানি খাতের কিছু টাকা ওদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে?
নিজের বোধ থেকে আমি বারবার ভাবি -- আমরা কি কোরবানি দেয়ার ব্যাপারটা একটু অন্যভাবে ভাবতে পারিনা? পারিনা লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতার পরিবর্তে নিজের মনের লোভ-লালসা, অধর্মকে ঝেড়ে ফেলে মানুষের পাশে দাঁড়াতে? একজন ক্ষমতাসম্পন্ন মুসলমানকে কোরবানি দিতেই হবে, তিনি দেবেন। কিন্তু আমরা প্রায়ই দেখি কোনো কোনো মানুষ ১০ থেকে ৫০ লাখ টাকা খরচ করে গরু-ছাগল কেনেন। প্রতিযোগিতা করে নিজেদের বড়লোকি জাহির করেন, নগ্নভাবে গরু-ছাগলের দাম বলে বেড়ান, কেউ কেউতো আরবীয় কায়দায় উট কোরবানি দিতেও পিছপা হন না।
এইরকম একটা আপৎকালীন অবস্থায় এই বাড়াবাড়ি খরচটা কি কমানো যায়না? নিয়ম পালন করে কোরবানি দেয়ার পর, বাকি টাকাটা বন্যা আক্রান্ত মানুষের মধ্যে দিলে মানুষগুলোর উপকার হবে। এমনকি অন্যান্য বছরেও কোরবানির জন্য বরাদ্দ টাকা থেকে কিছু টাকা হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, মানুষের আয়-উপার্জনের জন্য খরচ করলে মানবতা উপকৃত হবে?
অনেকে হয়তো বলতে পারেন আমার টাকা আছে, আমি সেই টাকা যেভাবে খুশি ব্যবহার করতে পারি। তা অবশ্যই পারেন। শুধু একটাই আর্জি এরকম বিপদের দিনে কোরবানির নিয়মটা মেনে বাকি টাকাটা কি জনকল্যাণে ব্যয় করা যায়না? মানুষ একটু সুখ পেলে, মানুষের মুখে হাসি ফুটলে, মানুষের উপকার হলে সৃষ্টিকর্তা খুশি হবেন -- এই বিষয়টা নিশ্চিত। আমরা সবাই ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা পালন করি কিন্তু একবারও ভেবে দেখিনা আনুষ্ঠানিকতার আসল মর্মবাণীটা কী।
পূজাও আসছে সামনে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও চাইলে তাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক খরচ কমিয়ে কিছু টাকা দুর্যোগ কবলিত মানুষের মধ্যে বিতরণ করতে পারেন। প্রতিবছর মণ্ডপ তৈরিতে যে ব্যয় হয়, তা কিছুটা কমালে দেবী অপ্রসন্ন হবেন না, বরং মানুষের সেবায় ভক্তের টাকা ব্যয় হচ্ছে দেখে খুশিই হবেন।
জাতীয় শোক দিবসে পাড়ায় পাড়ায় যে পরিমাণ খিচুরি, মাংস, বিরিয়ানি রান্না হয়েছে -- সেই টাকাটা আমরা চাইলে বন্যার্তদের মাঝে দিতে পারতাম। কিন্তু ব্যাপারটা আমরা এভাবে ভাবতেই পারি না। গৎবাঁধা ছকে আটকে থাকি। কোনো পরিকল্পনাও থাকে না। একটু উদ্যোগ নিলেই কিন্তু অনেককিছু করা যায়।
চারিদিকে বিপদের অশনি সংকেত। ১৯৮৮ তে আমাদের যে প্রলয়ঙ্করী বন্যা হয়েছিল, সেসময় যমুনার পানি বিপদসীমার যতটুকু উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল, এখনই সেই সীমাকে পার করে গেছে পানি। পদ্মার গোয়ালন্দ অংশেও পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। দেশে গত চার দশকে বড় ধরনের চারটি বন্যা হয়েছে। এরমধ্যে ১৯৯৮ সালেরটা সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল, যখন দেশের দুই তৃতীয়াংশ এলাকা তিন মাস পানির নীচে ছিল।
এবারের বন্যা সেই পরিস্থিতিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করছেন। বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে স্কুল-কলেজ ডুবে যাচ্ছে, রেল চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কোনো কোনো জায়গায় শহররক্ষা বাঁধে ফাটল ধরেছে , রাস্তাঘাট পানির নীচে তলিয়ে যাচ্ছে, কৃষি জমি পানির নীচে, মানুষজন খালি হাতে আশ্রয়কেন্দ্রে আসছে। এই দৃশ্য দেখার পর আমরা কেন বা কিভাবে লাখ লাখ টাকা খরচ করবো? চাইলে এসময় আমরা বিয়ে-শাদি, জন্মদিন, খাৎনা অনুষ্ঠানের খরচেও রাশ টানতে পারি।
কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে এই ব্যয় সংকোচন আমরা করবো কি? মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই সুযোগটা আমরা কি হাতছাড়া করবো? আমরা যারা ভালো থাকি বা আছি তারা ভাবতেও পারি না আমাদের এক বিন্দু দান, অসহায় মানুষগুলোর জন্য কত বড় পাওয়া। আমার বাবা বলতেন, যে উৎসবে অভুক্ত মানুষের অংশগ্রহণ থাকে না, তাকে ঠিক উৎসব বলা যায় না, তা শুধু আয়োজনেই সীমাবদ্ধ থাকে।
Comments