যাক, লেডি জাস্টিসও শেষমেশ ন্যায়বিচার পেলো!

সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে নতুন ঠিকানায় লেডি জাস্টিস। ছবি: প্রবীর দাশ

একেই বলে ভাগ্যর নির্মম পরিহাস! ন্যায়বিচারের কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়ে কয়েক মাস আগে থেমিস জায়গা করে নিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের আঙ্গিনায়; দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রবেশ মুখে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে অবৈধ স্থাপনার মতো তাকে উচ্ছেদ হতে হয়েছে। দুনিয়াজুড়ে প্রসিদ্ধ ন্যায়বিচারের প্রতীক থেমিসের ভাস্কর্যকে এমন উচ্ছেদের মুখে আর কখনও কোথাও হতে হয়নি। শক্তিশালী সার্চ ইঞ্জিন গুগলে অনুসন্ধানের ফলাফল অন্তত এমন সাক্ষ্য দেয়।

তাকে নিয়ে দু-এক জন কর্তা ব্যক্তির কথা শুনে মনে হয়, বলা নাই, কওয়া নাই, থেমিস সেই গ্রিস থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল; অবৈধ বসতি গড়ে তুলেছিল। তাদের কথার মর্ম হল-আমাদের দেশে কি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ভিন দেশি “মূর্তি” লাগবে? আমাদের দেশে কি ন্যায়বিচারের ঘাটতি আছে?

অপসারণের পর দুই দিন ধরে ত্রিপলে ঢাকা অবস্থায় তাকে ফেলা রাখা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের আঙিনার ভিতরে, অনেকটা লোক চক্ষুর অন্তরালে। থেমিসের কপাল ভালো বলতেই হবে। তাকে শুধু সুপ্রিম কোর্টের সম্মুখ থেকে অপসারণ নয়, এই দেশ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দেওয়ার দাবি যখন এখনো এতটা প্রকট তখন সুপ্রিম কোর্টের আঙ্গিনাতেই সে পুনঃস্থাপিত হয়েছে। হোক সেটা সুপ্রিম কোর্টের আঙিনার অনেক ভিতরে, লোক চোক্ষুর আড়ালে।

থেমিসের জন্য নতুন জায়গাটা নানা কারণে ভালো বলা যেতে পারে। প্রথমত, তার আগের জায়গাটা অনেক খোলামেলা ছিল; মাথার উপর ছায়া বলে কিছু ছিল না। কাঠ ফাটা রোদে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। তার উপর তার পরনের শাড়ি নিয়ে মেলা টানা হেঁচড়া হয়েছে। ছি! ছি! একজন নারীর শাড়ি নিয়ে এত টানাটানি মোটেও ভাল কথা নয়। শিল্প মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার নাম করে এখন হয়তো কেউ শাড়ি নিয়ে টানা টানি করবে না। থেমিস অনায়াসে শাড়িখানা পরে অনেক দিন কাটিয়ে দিতে পারবে। আর নতুন জায়গায় নাকি গাছের ছায়াও আছে। থেমিস, তুমি ওখানেই থাক, যত দিন তোমার থাকা হয় এই বাংলায়। তুমি ন্যায়বিচারের প্রতীক বলেই তোমার সাথে তেমন কোনো অনাচার হল না। তুমিও ন্যায়বিচার পেয়েছ নিশ্চয়!

আরো একটা তথ্য জানলে থেমিস খুশি হবে নিশ্চয়। থেমিসকে নিয়ে এত আলোচনা, এত পক্ষ-বিপক্ষ সমসাময়িক ইতিহাসে কোথাও হয়েছে বলে জানা যায় না। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক খবরে পরিণত হয়েছে থেমিসের জায়গা বদলের ঘটনা। দেখা যাক, থেমিস কিছুটা অন্তরাল থেকে এবার কলকাঠি নাড়তে পারে কি না? নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত করে নিতে পারে কি না? নাকি আবার উচ্ছেদের শিকার হবে যেকোনো সময়?

কথার ফুলঝুরি দেখা যাচ্ছে। থেমিসকে লোক চক্ষুর আড়ালে পাঠাতে যারা দাবি জানিয়ে কিছু দিন ধরে রাজনীতি গরম করেছেন, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল একজন কর্তা ব্যক্তি বলেছেন যে, থেমিসের ওই ভাস্কর্যের সাথে নাকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো মিল নাই। এমন কথা শুনে কার না বলতে ইচ্ছা হয়, ধরণী দ্বিধা হও। ন্যায়বিচার কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়? তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী?

আরেকজন কর্তা ব্যক্তি বলেছেন, ওটা থেমিসের ভাস্কর্য হয়নি। খুব দামি কথা। ভাস্কর্যে যদি শিল্প মানের ঘাটতি থাকে তাহলে সেটা দূর করা হোক। সাহস করে সেই কথা বলুন। পৃথিবীর অনেক দেশে থেমিস বা লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্য পুনর্নির্মাণ হয়েছে, মেরামত হয়েছে। তেমন কিছু করার কথা বলছেন?  নাকি খুঁত বের করে থেমিসকে ঝেটিয়ে বিদায় করার পক্ষকে আরো শক্তিশালী করতে চান, ওই পক্ষের মন জয় করতে চান?

থেমিসকে অপসারণের ঘটনায় সুলতানা কামাল, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, শাহদীন মালিক, কামাল লোহানীসহ অসংখ্য মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষাবিদ, আইনবিদ, সংস্কৃতিকর্মী এবং ছাত্র-জনতা হতাশা, ক্ষোভ, দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এই ঘটনাকে ইসলামী মৌলবাদীদের কাছে সরকারের অসহায় ও নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ হিসাবেও কেউ কেউ অভিহিত করেছেন। সরকার আসলে কি করে? সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন; থেমিসকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নাকি প্রধান বিচারপতি নিয়েছেন। কিন্তু সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যায় যারা খুশি হয়েছেন তাদের কথা শুনে। থেমিসকে অপসারণের জন্য তারা প্রধান বিচারপতিকে ধন্যবাদ না দিয়ে সরকার প্রধানকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন। তারা কি ভুল করছেন, নাকি ধন্যবাদ যার প্রাপ্য তাকেই দিচ্ছেন?

সমালোচনাকারীদের কেউ কেউ আবার অভিযোগ করে বলছেন সরকার নাকি ভোটের রাজনীতি করছে! কি আশ্চর্য! একটা রাজনৈতিক দলের সরকার কি জনগণকে সন্তুষ্ট করবে না? জনগণ সন্তুষ্ট না হলে ভোট পাবে কি করে?

ভোটের আগে জনগণের মন জয় করতেই হবে। থেমিসকে অপসারিত করায় যাদের খুশি হবার কথা তারাতো অনেক খুশি, পুলকিত। আনন্দে তারা আরও চাইছেন। তাদের আনন্দ প্রকাশের খবরও পত্র পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। সে সব খবর ছাপিয়ে গেছে তাদেরকে যারা ক্ষোভ, দুঃখ, কষ্ট, বেদনা প্রকাশ করেছেন। এখন যারা খুশি হয়েছেন, ভোটের রাজনীতিতে তারাই নিশ্চয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে একটা প্রশ্ন তাদের মাথা পিছু ভোট কয়টা- একটা নাকি অসংখ্য? যদি একটা হয় তাহলে আম জনতার চেয়ে বেশি ভোট কারো কাছে নাই। সেই আম জনতার জন্য ন্যায়বিচারের কথা বলে থেমিস, লেডি অব জাস্টিস।

থেমিস পাথরে তৈরি একটা নিছক “মূর্তি” নয়; থেমিস ন্যায়বিচারের মূর্তপ্রতীক। তবে দেশে ন্যায়বিচার থাকলে প্রতীক থাকলো কি থাকলো না সে সব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। আসল হল ন্যায়বিচার। সেটার ঘাটতি দেখা দিলেই বাধে যত গণ্ডগোল; লেডি জাস্টিসের স্ট্যাচু গড়া হয়, ভাঙা হয়, স্থানচ্যুত হয়, পুনঃস্থাপিত হয়।

Comments

The Daily Star  | English

Large-scale Chinese investment can be game changer for Bangladesh: Yunus

The daylong conference is jointly organised by Bangladesh Economic Zones Authority and Bangladesh Investment Development Authority

1h ago