রাষ্ট্র বনাম ধর্ষিতা!

লুক্রেসিয়ার কথা হয়ত আমরা ভুলে গেছি। আড়াই হাজার বছর আগের কথা, কে মনে রাখবে লুক্রেসিয়াকে! তবে আমরা নিশ্চয় ভুলিনি যে অতি শক্তিশালী রোমান সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটেছিল। আর সেই পতনের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে লুক্রেসিয়ার নাম। বলা হয়, রোমান সাম্রাজ্যের শেষ রাজার গুণধর পুত্র লুক্রেসিয়াকে ধর্ষণ করেছিল। লুক্রেসিয়া মনে করে এই জঘন্য অপরাধ তার এবং তার পরিবারের সম্মান ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছে। সে বিচার চায়। তার প্রার্থনা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় যা তার সম্মানকে আরও কলুষিত করে। তবে লুক্রেসিয়া তাদের সেই সুযোগ বেশি সময় দেননি। বিতর্ক চলাকালে সে একটা ছুরি নিজের বুকে বসিয়ে দেয়; লুক্রেসিয়া আত্মহত্যা করে। এই ঘটনায় জনগণের ভিতর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তারা ক্ষুব্ধ হয়। এমনটাও বলা হয় যে ব্রুটাস তখন লুক্রেসিয়ার বুকে বিদ্ধ ছুরি বের করে প্রতিজ্ঞা করেন লুক্রেসিয়ার অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার। নানা অন্যায় অবিচার এবং শোষণ নির্যাতনে ক্ষুব্ধ জনগণ ব্রুটাসকে সমর্থন জানায়। শুরু হয় রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, রাজনৈতিক বিপ্লব। রোমান সেনাবাহিনীও জনগণের বিদ্রোহকে সমর্থন জানায়। পতন ঘটে রোমান সাম্রাজ্যের।

কয়েক দিন আগে গাজীপুরে এক বাবা তার ৮ বছরের কন্যা শিশুর উপর যৌন নির্যাতনের বিচার চেয়ে না পেয়ে শিশুকে নিয়ে ট্রেনের নিচে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনাটি আমাদের বিবেককে নাড়া দিলো। রাষ্ট্র ব্যবস্থার দৈন্য দশা নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানসহ আরও অনেকেই বললেন যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি কারণেই গাজীপুরে হযরত আলী বিচার পাননি এবং অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। প্রিয় সন্তানের সাথে নিজের জীবন দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি একটা তীব্র ধিক্কার জানালেন। আয়েশা ও তার বাবার আত্মহত্যাকেও আমরা ভুলে যেতে বসেছি মাত্র এক সপ্তাহের ভিতর। লুক্রেসিয়ার মৃত্যু যা পেরেছে এমন হাজার আয়েশা আর তার বাবাদের মৃত্যু তা কি কখনো পারবে? পারবে কি বিচারহীনতার সংস্কৃতির উপর আঘাত হানতে?

আয়েশা আর তার বাবার আত্মহননের ঝড় থামতে না থামতেই সামনে এলো আরেক ধর্ষণের ঘটনা। এবার খোদ রাজধানী শহরে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই  ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। শুরুতে পুলিশ মামলা নিতে চায়নি; কারণ বিত্তশালী পরিবারের সন্তানদের বিরুদ্ধে এই জঘন্য অপরাধের অভিযোগ এসেছে। অনেক সমালোচনার পর পুলিশ মামলা নিয়েছে। তবে প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান হবার কারণে যাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েক দিন হলো প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। নতুন ঝড়ের কবলে পড়ে গাজীপুরের হযরত আলী আর তার মেয়ের আত্মহননের ঘটনা আড়ালে চলে গেছে। রাজধানীর আলোচিত ধর্ষণের ঘটনার তদন্ত ও বিচার কোন দিকে মোড় নিবে সেটা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থার উপর আমাদের ক্ষয়িষ্ণু আস্থার কারণেই এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ জন্ম নিয়েছে।

কুমিল্লার সোহাগী জাহান তনুর কথা কি আমাদের মনে আছে? গত বছর ৩০ মার্চ তার লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রতিবাদের ঝড় উঠে। অভিযোগ উঠে যে ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করা হয়েছে। লাশ উদ্ধার হয়েছে, কিন্তু তনু হত্যা রহস্য আজ পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি। রাষ্ট্রযন্ত্র গত এক বছরেও তনু হত্যাকারীদের খুঁজে পায়নি। আস্তে আস্তে তনুও আমাদের স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। তার মা বাবা বিচার পাবেন কি না কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। নতুন কোনো তনুর কথা আমরা জানতে পারি। আগের তনু আমাদের কাছে স্মৃতি হয়ে যায়।

আমাদের রাষ্ট্র ও পুলিশ কেমন করে কোন ধর্ষণ ঘটনা ধামা চাপা দিতে চায় সেটার একটা উদাহরণ হলো ইয়াসমিন আক্তার ধর্ষণ ও হত্যা মামলা। পুলিশ ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরে ১৪ বছর বয়সী ইয়াসমিনকে ধর্ষণ এবং পরে হত্যা করে। এলাকাবাসী ক্ষোভে ফেটে পড়েন। থানা ঘেরাও করে রাখেন দুই দিন ধরে। পুলিশ জনতার উপর গুলি চলায়; সাত জন নিহত হন। তারপর সরকারের টনক নড়ে। মামলা দায়ের হয়। দুই বছর পর ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে তিন জন পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতার হন। পুলিশ নানাভাবে তদন্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। অবশেষে ২০০৪ সালে তাদের তিন জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, যৌন হয়রানির ঘটনা আমাদের দেশে হরহামেশায় ঘটছে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনার সংখ্যা অতি নগণ্য। যে কারণে এমন ঘটনা বাড়ছে বৈ কমছে না! নির্যাতনের শিকার হয়ে অপমানে কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। প্রতিটি ঘটনা সাড়া জাগিয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্তই। মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি আমাদের রাষ্ট্রর ক্ষমতা ও আইনি কাঠামোতে। আমাদের আইনি কাঠামো এখনো জগাখিচুড়ি অবস্থায় আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন এবং দণ্ডবিধিতে যেমন ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির কথা বলা হচ্ছে তেমনি রাষ্ট্র এখনো ধর্ষণকারীর প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন এখনো ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্তকে সুযোগ দিচ্ছে অভিযোগকারী নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে। এই আইনে অভিযোগকারীর অতীত যৌন ইতিহাস টেনে আনা হচ্ছে; তাকে আরো সামাজিকভাবে হেয় করার সুযোগ রাষ্ট্র বহাল রেখেছে।

অনেক দেশে আইনে বিধান করা হয়েছে যে ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়ন মামলায় অভিযোগকারীর অতীত যৌন ইতিহাস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। কেননা অতীত নিয়ে প্রশ্ন তুলে অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রমাণ করতে চাইতো যে অভিযোগকারী চরিত্রহীনা। অথচ আমাদের আইনে এখনো এই কালাকানুন বহাল রয়েছে। এই বিধানের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দুই জন ছাত্রী ধর্ষিত হবার অভিযোগ এনেছে, তাদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে অভিযুক্তরা। সমাজের অনেকেই এখনো যেমন চোখ বন্ধ করে ধর্ষিতার দোষ খুঁজে বেড়ায়, তেমনি আমাদের রাষ্ট্র নিজেও ধর্ষিতার অতীত যৌন ইতিহাস সামনে টেনে আনার ব্যবস্থা বহাল রেখে ধর্ষিতাকেই দায়ী করার চেষ্টা করছে না? ব্রিটিশরা চলে গেছে সাত দশক হলো। পাকিস্তানিদের শোষণ যাঁতাকল থেকেও মুক্ত হয়েছি আমরা সেও সাড়ে চার দশক আগে। স্বাধীন বাংলাদেশে কার স্বার্থে সাক্ষ্য আইনে অমন বিধান আমরা বহাল রেখেছি?

ধর্ষক ও যৌন হয়রানিকারীরা কোনো ধর্ম মানে না, কোনো আইন মানে না। তারা যেমন অসুস্থ; তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজ যে দৃষ্টিতে ধর্ষণ ঘটনাকে দেখে সেটাও সুস্থ কোনো কিছু ইঙ্গিত করে না। রাষ্ট্র দুই একটা আইনি বিধান করেই তার দায়িত্ব শেষ করতে চাইছে। আবার যাদের উপর সেই আইন প্রয়োগের ভার দেয়া হয়েছে তাদের আন্তরিকতা ও সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সামগ্রিক পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার, যা অতি জরুরি।

লুক্রেসিয়ার আত্মহনন রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা করেছিল। কোনো একটি ঘটনাকে ধরে আমাদেরকেও বিচারহীনতার সংস্কৃতির সমাপ্তি ঘটানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এখানে রাজনৈতিক ভেদাভেদ নেই। রাষ্ট্রকে অবশ্যই নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়াতে হবে। রাষ্ট্রযন্ত্র কোনোভাবেই একজন ধর্ষণকারীকে রক্ষা করার চেষ্টা করে নিজেকে কলুষিত করতে পারে না।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago