সংসদের বাইরে এমপিরা স্বাধীন!
৩৬ বছর পর এমপিরা দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সংসদে অনুপস্থিত থাকার অধিকার ফিরে পেয়েছেন। ২০১১ সালের সংবিধান সংশোধনের সময় ৭০ অনুচ্ছেদের বিধিনিষেধ একটু শিথিল করায় এমপি মহোদয়রা এই স্বাধীনতাটুকু পেয়েছেন। এখন তারা চাইলে সংসদে কোনো ইস্যুতে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুসারে ভোট দিতে না চাইলে ওই দিন ভোটের সময় সংসদে অনুপস্থিত থাকতে পারেন। নিজস্ব নীতি-নৈতিকতা রক্ষার জন্য এটা সামান্য হলেও সুযোগ বটে। তবে সংসদে উপস্থিত থাকলে তাদেরকে দলের লাইন অনুসারে ভোট দিতেই হবে; দলের সিদ্ধান্ত পছন্দ হোক বা না হোক। দলের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলারও সুযোগ নেই।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এমপিদেরকে তাদের দলের আরো অনেক ন্যায্য-অন্যায্য সিদ্ধান্তকে সংসদে অন্ধভাবে, বিমূঢ়ভাবে মেনে চলার জন্য বাধ্য করে রেখেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সংসদ বর্জনের কথা। কোনো দল যদি কারণে বা অকারণে লাগাতার সংসদ বর্জন শুরু করে তবে ওই দলের কোন এমপি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবে না; তাকেও দিনের পর দিন সংসদ বর্জন করে যেতে হবে। জনগণ ভোট দিয়েছেন সংসদে গিয়ে তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলা, তাদের সমস্যার সমাধানে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া, সরকার ঠিকমতো জনগণের পক্ষে কাজ করছে কিনা এসব দেখার জন্য। কিন্তু এমন যুক্তি দেখিয়ে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে জনগণের পক্ষে কথা বলার জন্য সংসদে যোগ দিলে কোনো রক্ষা নেই।
গত সপ্তম সংসদে [১৯৯৬-২০০১] সে সময়কার প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সংসদ বর্জন করছিলো। কিন্তু তাদের সংসদ সদস্য মেজর (অব) আখতারুজ্জামান দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সংসদে যোগ দেন; তিনি যুক্তি দেখান যে, জনগণ তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন সংসদে তাদের পক্ষে কথা বলার জন্য। তার যুক্তি অসার প্রমাণিত হয় ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে। তিনি সংসদ সদস্য পদ হারান। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনর্প্রবর্তনের পর সংসদ বর্জনের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে সেটার পেছনে ৭০ অনুচ্ছেদের অবদান কোনো অংশেই কম নয়।
এমপিদের দলীয়ভাবে শৃঙ্খলিত করার ইতিহাস স্বাধীন বাংলাদেশের সমান বয়সী। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, যে দল থেকে একজন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন সেই দল থেকে পদত্যাগ করলে, বা সংসদে সেই দলের বিপক্ষে ভোট দিলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে।
কিন্তু ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তাদের উপর আরোপিত বিধিনিষেধ আরো কঠোর করে বলা হয়েছিল যে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সংসদে অনুপস্থিত থাকলে সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট প্রদান বলে গণ্য হবে এবং এই জন্য সংসদে তার আসন শূন্য হবে। চতুর্থ সংশোধনী নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়, কিন্তু ১৯৯১ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে যখন পুনরায় সংসদীয় গণতত্রের যাত্রা শুরু হলো তখন চতুর্থ সংশোধীনর মাধ্যমে এমপিদের উপর আরোপিত বিধিনিষেধ অবিকল বহাল রাখা হলো। ১৯৭২ সালের সংবিধানে যা ছিলো তা পুনর্বহাল পর্যন্ত হলো না। সর্বশেষ ২০১১ সালে ১৯৭২ সালের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করে এমপিরা সংসদে অনুপস্থিত থাকার একটু স্বাধীনতা পেয়েছেন।
তবে ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত সংসদীয় কমিটি এমপিদেরকে আরো স্বাধীনতা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। কমিটির সদস্যরা ৭০ অনুচ্ছেদে ঢালাওভাবে নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে তিনটা যৌক্তিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চেয়েছিলেন। তাদের মতে, সংসদে সরকারের বিপক্ষে উত্থাপিত অনাস্থা প্রস্তাব, জাতীয় বাজেট এবং জাতীয় নিরাপত্তা- এই তিন ইস্যুতে এমপিরা দলীয় সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন না, বাকি অন্য ইস্যুতে তারা ভোটদনে স্বাধীন থাকবেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার রাজি না হওয়ায় কমিটির উদ্যোগ সফল হয়নি।
তবে এমপিরা আর ওই সব বিধিনিষেধ নিয়ে এখন তেমন উচ্চবাচ্য করেন না। তবে ১৯৭২ সালে যখন এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় তখন কয়েকজন সরকার দলীয় গণপরিষদ সদস্য যারা সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন।
আওয়ামী লীগের এমপি আসাদুজ্জামান খান, যিনি দ্বিতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন, বলেছিলেন, সংসদ সদস্যদের উপর এমন বিধি-নিষেধ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থি এবং এমন বিধিনিষেধ এমপিদেরকে দলের বশংবদে পরিণত করবে।
তৎকালীন বিরোধী দলীয় সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংবিধান প্রণয়ন বিলের উপর গণপরিষদের সাধারণ আলোচনাতেও ৭০ অনুচ্ছেদে বিধিনিষেধের প্রতিবাদ জানান।
তিনি বলেন, “৭০ অনুচ্ছেদের মধ্যে এমন একটা অগণতান্ত্রিক বিধান রাখা হয়েছে, যা পৃথিবীর আর কোনো সংবিধানে নেই। এই বিধান নিয়ে সেদিন সাধারণ আলোচনার সময়েও বলেছিলাম, এই বিধান পাকিস্তানী ডিক্টেটর আইয়ুব খানের শাসনতন্ত্রেই শুধু আছে। এছাড়া আর কোথাও এর নজির নেই।”
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, যিনি পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে যোগ দেন বলেন, “এভাবে যদি গণতন্ত্রের টুটি টিপে হত্যা করা হয়, তাহলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দূরের কথা— গণতন্ত্রের লেশমাত্র থাকবে না; আর সমাজতন্ত্রের তো প্রশ্নই আসেই না।”
আসাদুজ্জামান খান ১৯৭২ সালে যে আশঙ্কা করেছিলেন তা কতটা বাস্তব যখন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খাইরুল হক, যিনি এখন বাংলাদেশ আইন কমিশনের চেয়ারম্যান, ২০০৬ সালে এক মামলার রায়ে মন্তব্য করেন যে, ৭০ অনুচ্ছেদের বিধিনিষেধ একজন এমপিকে দলীয় বন্দীতে পরিণত করেছে।
অনেকের কাছে দলীয় এমপিদের উপর এমন বিধিনিষেধ আরোপ তাদের উপর দলের আস্থাহীনতারাও বহিঃপ্রকাশ।
সর্বশেষ, বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, যে সংসদ সদস্যদের উপর তার দলই আস্থা রাখতে পারছে না, তাদের উপর বিচারকদের অপসারণের ভার দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
অতীতে দেখা গেছে, বিধিনিষেধের কারণে অনেকেই সংসদে যা বলা উচিত তা বলা থেকে বিরত থাকেন; এমনকি যা সমর্থন করা অনুচিত সেটাও সমর্থন করেন। তারা বিধিনিষেধ ভাঙতে ভয় পান; দলীয় শীর্ষ নেতাদের বিরাগভাজন হবার ভয়, সংসদে সদস্য পদ হারানোর ভয়, আগামীতে নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার ভয়। এত ভয় নিয়ে সংসদের ভিতরে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করা যায়?
তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো সংসদের বাইরে অন্যান্য কর্মকাণ্ডে আমাদের এমপিদের স্বাধীনতার কমতি নেই। সংসদ সদস্য পদের অপব্যবহার করে তারা নানা ব্যবসা-বাণিজ্য করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন এমন অভিযোগ অনেক দিনের। আইন অমান্য করতেও অনেকে দ্বিধা করেন না। আইন বহির্ভূতভাবে সংসদের বাইরে অনেক এমপি নানা অনিয়ম, দুর্নীতি এবং উশৃঙ্খল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হবার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। খুব বেশি অতীতে না গিয়ে গত ১০ বছরের রেকর্ড পর্যালোচনা করলেই এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। কয়েক জন এমপি খুন ও মাদকদ্রব্য চোরাচালানের দায়েও অভিযুক্ত হয়েছেন।
অনেক গণতান্ত্রিক দেশের সংসদেই এমপিরা তাদের সংসদীয় দায়িত্ব পালনে যাতে আরো স্বাধীনতা ভোগ করেন সেদিকে নজর দেওয়া হয়। সংসদের বাইরে কোনো কর্মকাণ্ড যথা ব্যবসা বা নিজ সংসদীয় এলাকায় সামাজিক কল্যাণমূলক কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রেও এমপিদেরকে অনেক বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়। আমাদের বেলায় পরিস্থিতি ভিন্ন; আমাদের উল্টা পথ যাত্রা। এমপিদেরকে ‘দলীয় বন্দী’তে পরিণত করে আমরা সংসদীয় গণতন্ত্র শক্তিশালী করার স্লোগানে মুখর থাকছি বছরের পর বছর। ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। পরিস্থিতি এত বেশি নাজুক আকার ধারণ করেছে যে, এখন যদি অনুচ্ছেদ ৭০ সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হয় তবু এমপিরা দলীয় বন্দিদশা থেকে সহজে বের হতে পারবেন বলে আশা করা কঠিন। কেননা রাজনৈতিক দলের ভিতর গণতন্ত্রের উপযুক্ত চর্চা না থাকায় সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশের কমতি রয়েছে দলগুলর আভ্যন্তরে; যা একটা দেশকে গণতান্ত্রিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সহায়ক নয়।
Comments