সবুজ পাহাড়ে আগুন কান্না

​পাহাড়ে আগুন লেগেছে! আগুন লাগানো হয়েছে। রাঙামাটির লংগদুতে তিনটা গ্রামের ২০০ আদিবাসী পরিবারের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আকস্মিক আক্রমণে দিশেহারা অসহায় পাহাড়িরা বসত ভিটা ছেড়ে সবুজের বুক চিরে যেভাবে “পালিয়ে যাচ্ছিল” সেই দৃশ্যকে কেউ কেউ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আক্রমণে দেশ ত্যাগ করা শরণার্থীদের সাথে তুলনা করেছেন।

পাহাড়ে আগুন লেগেছে! আগুন লাগানো হয়েছে। রাঙামাটির লংগদুতে তিনটা গ্রামের ২০০ আদিবাসী পরিবারের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আকস্মিক আক্রমণে দিশেহারা অসহায় পাহাড়িরা বসত ভিটা ছেড়ে সবুজের বুক চিরে যেভাবে “পালিয়ে যাচ্ছিল” সেই দৃশ্যকে কেউ কেউ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আক্রমণে দেশ ত্যাগ করা শরণার্থীদের সাথে তুলনা করেছেন।

অমন তুলনা বাড়াবাড়ি; তবে অসহায় মানুষগুলোর নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বসতভিটা ছেড়ে ছুটে চলার যে দৃশ্য দেখা গেছে তা হৃদয় বিদারক। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ করেছিল। আর পাহাড়িদের উপর আক্রমণ করেছে আমাদের নিজেদের লোক, অতিচেনা মুখ। সেই হিসেবে এই আক্রমণ অনেক বেশি ভয়ঙ্কর, নির্দয় এবং নিষ্ঠুর। এমন দৃশ্যে নিজেকে কল্পনা করে দেখুন; আক্রমণের শিকার হয়ে আপনি আপনার বৃদ্ধ মা-বাবা, কোলের শিশুকে নিয়ে “পালিয়ে” যাচ্ছেন-- নিজেকে কতটা অসহায় ও নিরাপত্তাহীন লাগে। বৃদ্ধ মা-বাবার সকরুণ চাহনি আর নিষ্পাপ শিশুর অসহায় মুখ মনে করলে বুকের ভেতরটা একটুখানি মোচড় দেয় কি?

আশ্রয়হীন মানুষগুলোর কেউ কেউ জঙ্গলে রাত কাটিয়েছে। কেউ কেউ ২০/২৫ কিলোমিটার দূরে, আরও গভীর জঙ্গলে পরিচিত বা আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে ছুটে গেছে আশ্রয়ের সন্ধানে। সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রকেও তারা নিরাপদ মনে করেনি; তাদের আশঙ্কা সেখানে গেলে আবার তাদের উপর আক্রমণ হতে পারে। আতঙ্কগ্রস্ত মানুষগুলো সরকারি ত্রাণ নিতে রাজি হয়নি। তারা ত্রাণ চায় না। তারা বিচার চায়-- হামলার বিচার; জুলুম নির্যাতনের বিচার; ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে দেওয়ার বিচার; অপমানিত করার বিচার। ত্রাণ নিতে রাজী না হয়ে অসহায় মানুষগুলো যে প্রতিবাদ করেছে রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন কি সেই প্রতিবাদের ভাষা বুঝতে পেরেছে?

পাহাড়ে আগুন লাগার ঘটনা এবারই প্রথম ঘটেছে, তা নয়। দীর্ঘ দিন ধরেই পাহাড় অশান্ত। সবুজের বুকে আগুন জ্বলেছে মাঝে মধ্যেই। পাহাড়িদের কান্নায় নিভেছে সে আগুন! শান্তি চুক্তি হয়েছে সেও প্রায় দুই দশক আগে। তবু পাহাড়ে শান্তি এসেছে বলা যায় না। সবুজের পাহাড় জুড়ে শান্তির পায়রা কবে উড়বে কেউ জানে না। কবে আদিবাসীদের কান্না থামবে সেটাও কেউ জানে না। কয়েক দশক ধরে চাওয়া ন্যায়বিচার তারা আদৌ পাবে কি না কে জানে!

লংগদুতে আগুনে ঘরবাড়ি হারিয়ে অসহায় মানুষগুলো যে বিচার দাবি করছে সেটাও কিন্তু ওই দীর্ঘ দিনের চাওয়া থেকে আলাদা কিছু নয়। ওই চাওয়া যদি পূরণ হত, যদি আইনের শাসনের ঘাটতি না থাকতো তবে আদিবাসীদের জীবন এতোটা নিরাপত্তাহীন হত না। পাহাড়ে শান্তি আসতো। তাহলে আজ লুংগদুর অসহায় মানুষগুলোকে এমন করে নিজ দেশে উদ্বাস্তু হতে হত না।

যেকোনো আক্রমণের শিকার অসহায় মানুষ সরকারি ত্রাণ বা রিলিফের পরিবর্তে বেশি চায় তাদের সাথে করা অন্যায়ের বিচার। চায় নিরাপত্তা। নিজ দেশে আবার যেন তাদেরকে উদ্বাস্তু হতে না হয় চায় সেই নিশ্চয়তা।

গত বছর নভেম্বরে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল পল্লীতে হামলা, তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের পর উদ্বাস্তু সাঁওতালরা সরকারি ত্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিল। কয়েকশো অসহায় সাঁওতাল। বিচার চেয়েছিল; যারা তাদের উপর আক্রমণ করেছে, যারা তাদের ঘরে আগুন দিয়েছে, যারা তাদেরকে অপমানিত করেছে তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি করেছিল।

বিচার বিভাগীয় হাকিমের তদন্তে বের হয়ে আসে নির্মম সত্য। “সাঁওতালদের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগানোর ঘটনার জন্য স্থানীয় কতিপয় ব্যক্তি এবং ওই ঘটনার সময়ে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্য দায়ী। এই আগুন লাগানোর ঘটনার সাথে দুইজন পুলিশ সদস্য ও একজন ডিবি সদস্য সক্রিয়ভাবে জড়িত।” এই মামলা এখনো বিচারাধীন। সাঁওতালরা কবে বিচার পাবে তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।

লংগদুর ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার। কিন্তু সেই আশ্বাসে আস্থা রাখা মুশকিল। কেননা স্থানীয় এক যুবলীগ কর্মীর মৃত্যুর জন্য পাহাড়িদেরকে অভিযুক্ত করে স্থানীয় উশৃঙ্খল বাঙালিরা যখন তাদের উপর আক্রমণ করেছে, ঘর বাড়ি ভাঙচুর করেছে, আগুন দিয়েছে তখন নাকি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সেখানে উপস্থিত ছিল, তবে তারা ছিল নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকায়। এমন গুরুতর অভিযোগ ইঙ্গিত দেয়, স্থানীয় প্রশাসনের কাছে পাহাড়িরা কতটা নিরাপত্তা পায়! প্রশাসন কতটা পক্ষপাতহীনভাবে দায়িত্ব পালন করে।

ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন যে তালিকা করছে সেটা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে পাহাড়িরা। তাদের মতে, তাদের সাথে কথা না বলেই তালিকা করা হয়েছে; যাতে তাদের প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করা হচ্ছে না। যতই আশ্বাস দেওয়া হোক না কেন পাহাড়িরা কতোটা ন্যায় বিচার পাবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

লংগদুতে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে সরকার বা রাষ্ট্র তাদের প্রতি দয়া বা করুণা করছে না; সহানুভূতিও প্রকাশ করছে না। রাষ্ট্র তথা সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এটাই সভ্য সমাজের রীতি।

গাইবান্ধায় সাঁওতাল, রাঙমাটির লংগদুতে চাকমাদের উপর হামলা কিংবা গত বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলাসহ আরো অনেক এমন ঘটনায় নাগরিকদের যান-মালের নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা প্রকাশ পায়। রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তাদের ভুলে গেলে চলবে না যে অসহায় এবং দুর্বল যারা তাদের সুরক্ষার জন্যই রাষ্ট্রকে বেশি করে ভাবতে হবে। ক্ষমতাশালী, সম্পদশালী যারা তাদের জন্য অত না ভাবলেও চলবে। তবে ক্ষমতাশালী এবং সম্পদশালীরা যাতে দুর্বলের উপর জুলুম নির্যাতন না চালায় সেটা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে, সে জন্যই রয়েছে পুলিশ বাহিনী। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি অসহায় দুর্বলের পাশে না দাঁড়ায়, সবলের জুলুম নির্যাতন থেকে দুর্বল অসহায়দের রক্ষা না করতে না পারে তাহলে তাদের ব্যর্থতা তো রাষ্ট্রেরই ব্যর্থতা; যা রাষ্ট্রের জন্য গ্লানিকর। যেমনটা ঘটেছে গাইবান্ধার সাঁওতাল এবং লংগদুতে চাকমাদের উপর আক্রমণের সময়।

Comments

The Daily Star  | English

Mob justice is just murder

Sadly, when one lynching can be said to be more barbaric than another, it can only indicate the level of depravity of some our university students

1h ago