সব দায় কি আওয়ামী লীগের একার?

সুপ্রিম কোর্ট

বন্দুকের নলের জোরে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাচ্যুত করে যিনি ক্ষমতা দখল করেছিলেন; সংবিধানকে স্থগিত করে বাক্সবন্দি করেছিলেন; পটুয়া কামরুল হাসান যাকে ‘বিশ্ব বেহায়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন; রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে যিনি জাতীয় পার্টি নামের একটি রাজনৈতিক দলের মালিক হয়েছেন; যার স্বৈরশাসনের কবল থেকে দেশ ও গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠনকে নানা নিপীড়ন সহ্য করে দীর্ঘ দিন ধরে রাজপথে আন্দোলন করতে হয়েছিল; সেই জেনারেল এরশাদ বলেছেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় পড়ে ‘লজ্জায় তার মাথা হেট হয়ে গেছে’।

আরেক রাজনৈতিক দল যারও প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সামরিক শাসকের আশীর্বাদ এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে; যে দলটি প্রতিষ্ঠার কারিগর জেনারেল জিয়া সামরিক ফরমান দিয়ে ইচ্ছামত সংবিধান সংশোধন করেছেন; প্রহসনের গণভোটের নামে নিজেকে বৈধ শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন, সেই বিএনপির নেতৃবৃন্দও সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের দেয়া রায়ে আনন্দিত। তারা স্বাগত জানাচ্ছেন আদালতের রায়কে। রায়ে উল্লেখ থাকা কড়া সমালোচনাগুলোকে তারা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের কথা হিসেবে অভিহিত করছেন। যেমন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘আমরা খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই, দেশের ১৬ কোটি মানুষ এই রায়ের অবজারভেশনের সঙ্গে আছে এবং তারা একমত।’

রায়ে সমালোচনামূলক পর্যবেক্ষণ মানতে পারছে না আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন তারা ‘আহত এবং ক্ষুব্ধ’। মন্ত্রিসভার বৈঠকের আলোচনায় মন্ত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আদালতের কড়া সমালোচনাকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ এবং ‘অযৌক্তিক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, রায়ের ‘অপ্রাসঙ্গিক’ এবং ‘অযৌক্তিক’ সমালোচনাগুলো সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে, জনমত গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মন্ত্রীদের নির্দেশ দিয়েছেন। মন্ত্রীরা নানা অনুষ্ঠানে রায় নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন।

চলুন সংক্ষেপে দেখা যাক, আদালতের পর্যবেক্ষণে কী বলা হয়েছে। পর্যবেক্ষণে গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয়ে কড়া সমালোচনা করা হয়েছে।

রায়ে বলা হয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দাম্ভিকতা বাধা দেওয়ার মতো কোনো নজরদারি বা তদারককারী প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও গড়ে ওঠেনি, তাই ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষারও ব্যবস্থা নেই। ফলে মানবাধিকার ঝুঁকিতে, দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত, সংসদ অকার্যকর, কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত।...এমন পরিস্থিতিতে নির্বাহী বিভাগ আরও অসহিষ্ণু ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং আমলাতন্ত্র দক্ষতা অর্জনে চেষ্টাহীন।

এই সব কিছুর দায় কি আওয়ামী লীগের একার? যেভাবে আলোচনা চলছে এবং আওয়ামী লীগ সমালোচনার জবাব দিচ্ছে তাতে তেমনটা মনে হতেই পারে। তবে সম্পূর্ণ রায় পড়লে এ ধারণা পাল্টে যেতে পারে।

রায়ে বিগত দুটি সামরিক শাসনামলের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। “ক্ষমতালোভীরা দুবার আমাদের রাষ্ট্রকে ‘ব্যানানা রিপাবলিকে’ পরিণত করেছিল, যেখানে ক্ষমতালোভীরা তাদের অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য জনগণকে পণ্য রূপে দেখেছে, ধোঁকা দিয়েছে। তারা জনগণের ক্ষমতায়ন করেনি, অপব্যবহার করেছে। তারা নানা রকম ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিয়েছে। কখনো গণভোটের নামে, কখনো জোরপূর্বক এবং কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে, কখনো নির্বাচন না করে। এর সবটাই করা হয়েছে তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে। আর এর মধ্য দিয়েই সুস্থ ধারার রাজনীতি পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এসব অগণতান্ত্রিক শাসনামলের নোংরা রাজনীতির চর্চা আমাদের সার্বিক জনরাজনীতির মারাত্মক ক্ষতি করেছে।”

দুটি সামরিক শাসনের নেতা কারা ছিলেন? বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠার কারিগর দুই সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ কি রাজনীতির বর্তমান রুগ্ন অবস্থার জন্য কম দায়ী? আদালতের রায়ে ফুটে উঠেছে কিভাবে সুস্থ ধারার রাজনীতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। কিভাবে অগণতান্ত্রিক শাসনামলের নোংরা রাজনীতির চর্চা আমাদের সার্বিক জনরাজনীতির মারাত্মক ক্ষতি করেছে। উভয় সামরিক শাসক রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন। তারা সংবিধান সংশোধন করে নিজেদের সকল অবৈধ কর্মকাণ্ড জায়েজ করতে চেয়েছেন। কিন্তু আদালত তাদের সে প্রচেষ্টাকে অসাংবিধানিক এবং বাতিল ঘোষণা করেছেন। রায়ে বিগত বিএনপি সরকার আমলে (২০০১-০৬) কিভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর আক্রমণ করা হয়েছে তাও উঠে এসেছে।

স্বাধীনতার ৪৬ বছরে জেনারেল জিয়া এবং তার দল বিএনপি ১৫ বছর, জেনারেল এরশাদ এবং তার দল জাতীয় পার্টি ৯ বছর দেশ শাসন করেছে। আওয়ামী লীগ সব মিলে এখন পর্যন্ত ১৭ বছরের কিছু বেশি সময় সরকারে রয়েছে। বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি তথা গণতন্ত্র, রাজনীতি, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপসহ সব দৈন্য দুরবস্থার জন্য তবে কি আওয়ামী লীগ একক ভাবে দায়ী?

দেশ স্বাধীন হবার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। ১৯৭৫ সালের পর টানা ২১ বছর দেশ শাসিত হয়েছে হয় সরাসরি নয়ত সামরিক শাসনের ছদ্মবেশে। রাজনীতিকে কলুষিত করে বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির জন্ম। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা শুরু হয় বটে কিন্তু তার আগের ২১ বছরে পুঞ্জিভূত জঞ্জাল পরিষ্কারের আগেই দলগুলো ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মরিয়া হয়ে উঠে। শুরু হয় নীতি নৈতিকতা বর্জিত নতুন রাজনৈতিক ধারা। ১৯৭৫ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরতে পারলেও অপরাজনৈতিক ধারা থেকে দলটি নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে দলটির ভেতরেও অপরাজনীতি ঢুকে পড়েছে। এখন নীতি নৈতিকতা আদর্শের রাজনীতির মাপকাঠিতে বিচার করে আওয়ামী লীগকে অনেক ক্ষেত্রে অন্য বড় দলটি থেকে খুব বেশি আলাদা করা যায় না।

আদালতের রায়ের কড়া সমালোচনায় আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ এবং আহত বোধ করেছে। মন্ত্রী, নেতারা রায়ের বিপক্ষে জনমত গঠনে মাঠে নেমেছেন মনে হচ্ছে। তারা গঠনমূলক সমালোচনা করছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। তারাও রায়কে খণ্ডিতভাবে ব্যাখ্যা করছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে উচ্চ আদালত এবং প্রধান বিচারপতিকে দল এবং সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন, যা কোনোভাবেই আওয়ামী লীগ, সরকার এবং দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না।

২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক এবং শাসন ব্যবস্থার দৈন্য দশার জন্য আওয়ামী লীগের নিশ্চই দায় আছে। কিন্তু দলের নেতা এবং মন্ত্রীরা যেভাবে খণ্ডিত আকারে রায়কে জনসম্মুখে তুলে ধরে আদালতের সমালোচনা করছেন তাতে প্রতীয়মান হয় তদের অনেকে হয়ত রায়টি ভাল ভাবে পড়েননি। রায়ে শুধু আওয়ামী লীগের সমালোচনা করা হয়েছে-- তাদের এই ধারনা সম্পূর্ণ ভুল। গত ৪৬ বছরে কিভাবে দেশের রাজনীতি ধ্বংস হয়েছে, শাসন ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে, সামরিক শাসনের সুদূরপ্রসারী কুফলসহ নানা বিষয় আলোচিত হয়েছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘আমরা খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই, দেশের ১৬ কোটি মানুষ এই রায়ের অবজারভেশনের সঙ্গে আছে এবং তারা একমত।’ তার মানে তারা স্বীকার করে নিচ্ছেন যে তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াও দেশের রাজনীতি ধ্বংসের জন্য দায়ী? জেনারেল এরশাদের লজ্জায় মাথা হেট হচ্ছে। দেশের রাজনীতিকে কলুষিত করতে তিনি কি কম দায়ী? ক্ষমতার লোভে জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ কিভাবে রাষ্ট্রকে “ব্যানানা রিপাবলিকে” পরিণত করেছিলেন সে কথা আদালতের রায়ে বলা হয়েছে। এ জন্য কি তাদের মাথা এখন হেট হয়?

আদালতের রায়ের সমালোচনাগুলোকে সবার উচিত গ্রহণ করা। কিভাবে পরিস্থিতির উন্নতি করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করা। দেশের বর্তমান অবস্থার জন্য কোনো একটি দল এককভাবে দায়ী নয়। সব দলের কম বেশি দায় রয়েছে। গত ৪৬ বছর কোন শাসক, কোন দল কিভাবে দেশ পরিচালনা করেছে তা কম বেশি সকলের জানা আছে। তাই যে যার অবস্থান থেকে নিজেদের সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু করাই উত্তম। রায়ের পর্যবেক্ষণকে 'অপ্রাসঙ্গিক' এবং  'অযৌক্তিক' হিসেবে আখ্যায়িত করলেই দেশের বিদ্যমান বাস্তবতা বদলে যাবে না।

আর প্রধান বিচারপতিকে আক্রমণের লক্ষবস্তুতে পরিণত করাটা রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করে না। মনে রাখা দরকার, তিনি শুধু সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নন, তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। এই দেশ, দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ শাসন ব্যবস্থায় অন্যায় অনিয়ম দেখলে তার কি কিছুই বলার নেই? দেশ ও জনগণের প্রতি তার কোনো দায়বোধ থাকতে পারে না?

জনস্বার্থের মামলাগুলোতে আদালতের দেওয়া রায়গুলোর কথা আমরা যেন ভুলে না যাই। জনগণের অধিকার নিশ্চিত করতে, তাদের জানমালের নিরাপত্তা যাতে নিশ্চিত করতে আদালত সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নদী বাঁচানো, পরিবেশ দূষণরোধ এবং মহাসড়কে চলাচলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নেওয়া সহ নানা বিষয়ের আদেশগুলো তার প্রমাণ। শুধু বিচারিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে না থেকে আদালতকে কেন এসব কাজও করতে হয়? ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি ভাগবতি সহজ করে যে জবাবটা  দিয়েছেন তা আমাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তিনি বলেছিলেন, “সুপ্রিম কোর্টকে কিছু করতে হতো না। সকাল বেলা আমরা অফিসে যেতাম, দস্তখত করতাম, বিকেল বেলা বাড়ি চলে আসতাম। আমাদের কোনো কাজই ছিল না। কিন্তু আমাদের হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে এই জন্য যে, আমাদের সিভিল সার্ভিস সক্রিয় নয়। দুই নম্বর হচ্ছে- আমাদের প্রশাসন ব্যবস্থা নানা রকম সমস্যায় জর্জরিত। অদক্ষতা, অকার্যকারিতা প্রশাসনের সর্বত্র। আমরা দৃষ্টি সেই দিকে না ফেললে তারা সেই দিকে দৃষ্টি দিতে চায় না।”

Comments

The Daily Star  | English

Child rape cases rise nearly 75% in 7 months

Child rape cases in Bangladesh have surged by nearly 75 percent in the first seven months of 2025 compared to the same period last year, according to data from Ain o Salish Kendra (ASK).

1h ago