সু চি মিয়ানমারের জনগণেরও শত্রু

ছবি: রয়টার্স

বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, জাতিসংঘের মহাসচিব, বেশ কয়েকজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ব্যক্তিত্ব এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রত্যাশা করেছিলেন অং সান সু চি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনের আইকন হিসেবে মানবতার পক্ষে কথা বলবেন; রোহিঙ্গা জাতির উপর চলমান সহিংসতার নিন্দা জানাবেন এবং জাতিগত নিধন বন্ধে পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটল ঠিক উল্টো। বিশ্বব্যাপী নিন্দা-সমালোচনার ঝড়ের মুখে নীরবতা ভেঙে গত মঙ্গলবার সু চি কথা বললেন একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে। ন্যায়নীতি বিবর্জিত একজন রাজনীতিবিদের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠলেন; যার কাছে ক্ষমতায় টিকে থাকাই মুখ্য; মানবতা এবং মানবাধিকার গৌণ। সামরিক বাহিনীকে না চটিয়ে ক্ষমতায় থেকে যেতে চান তিনি। তাই ভাষণে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ চালানোর দায়ে অভিযুক্ত সামরিক বাহিনীর সমালোচনা করেননি। বরং সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানকে অন্ধভাবে সমর্থন করতে গিয়ে বিশ্বের সামনে রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে মিথ্যাচার করতেও পিছপা হননি।

মানবতার পক্ষে তার বক্তব্য প্রত্যাশা করাটাই ছিল অরণ্যে রোদন। সামরিক বাহিনী কর্তৃক গৃহবন্দি ছিলেন যে সু চি, তিনি ছিলেন মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের পক্ষে। কিন্তু ২০১০ সালে মুক্ত হবার পরপরই গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, মানবাধিকার আইকন হিসেবে নয়, তিনি নিজেকে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রকাশ করতেই পছন্দ করেন। এখন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি ক্ষমতা চান। ক্ষমতার স্বার্থে তিনি নিজ দেশের বর্বর সামরিক বাহিনীর সাথে যেকোনো আপোষ করতে পারেন। তিনি ভালো করেই জানেন সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা। ১৯৯০ সালে তার দল নির্বাচনে জয়লাভ করলেও ক্ষমতায় বসতে পারেনি। সামরিক বাহিনী সে নির্বাচনকে বানচাল করে দিয়ে তাকে গৃহবন্দি করে রেখেছিল। ২০১৫ সালে আবার তার দল জয়লাভ করলেও সামরিক বাহিনী তাকে রাষ্ট্রপতি হতে দেয়নি। অনেক আগেই সংবিধান সংশোধন করে তার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নতুন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে কারো সন্তান বিদেশি নাগরিক হলে তিনি রাষ্ট্রপতি হবার অযোগ্য হবেন। সু চি’র সন্তানেরা ব্রিটিশ নাগরিক। তাই তিনি অযোগ্য। তার দল ক্ষমতায় থাকলেও ঐ বিধান বাতিল করতে সংবিধান বদলানরও ক্ষমতা নেই। কারণ সংসদে সামরিক বাহিনীর ভেটো ক্ষমতা আছে; পার্লামেন্টের মোট সদস্যর ২৫ ভাগ সামরিক বাহিনীর সদস্য।

তবে সু চি যতোই সামরিক বাহিনীকে খুশি করে চলুন না কেন তার পক্ষে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আবির্ভূত হওয়া কখনও সম্ভব হবে না। সামরিক বাহিনী সু চিকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। তারা ২০১৫ সালের নির্বাচন বাতিল করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নতুন করে একঘরে হতে চাননি। তাই সু চি’র দলকে ক্ষমতায় আসতে দিলেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সকল মন্ত্রণালয় নিজদের কাছে রেখে ক্ষমতার প্রকৃত আসনে সামরিক বাহিনীই রয়ে গেছে। গৃহবন্দি থাকার সময় বিশ্বে সু চি’র যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল গত দেড় বছরে সব ভূলুণ্ঠিত হয়ে গেছে। সু চি এখন গোটা দুনিয়া জুড়ে নিন্দিত এবং সমালোচিত। মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন থেকে তিনি সামরিক বাহিনীকে বিরত রাখতে পারবেন বলে মনে হয় না। তাই আগামী দিনে তিনি আরও বেশি নিন্দিত হবেন। এটা সামরিক বাহিনীর অনেক বড় সাফল্য।

যে সামরিক বাহিনী ১৯৬২ সাল থেকে মিয়ানমারকে দখল করে পরিচালনা করছে, তারা খুব সহজে দৃশ্যপট থেকে আড়ালে চলে যাবে সেটা ভাবার কোন কারণ নেই। তারা এগুচ্ছে তাদের পরিকল্পনা মাফিক। সামরিক জান্তা ২০১১ সালে মিয়ানমারে জনগণকে সীমিত আকারে বাক স্বাধীনতার অধিকার দেয়। কিন্তু সেই বাক স্বাধীনতার প্রয়োগ এমন ভাবে সামরিক বাহিনী ব্যাবহার করেছে যে সেটা তাদের জন্য মঙ্গল বয়ে এনেছে। বাক স্বাধীনতা দিয়ে তারা জনগণের ভেতর, বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের মধ্য উগ্র জাতিগত বিদ্বেষ উস্কে দিয়েছে। সু চি’র দলেও সেই ঢেউ লেগেছে। জাতিগত বিদ্বেষের সহিংস বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে রাখাইন রাজ্যে ২০১২ সাল থেকে। এখন সেটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্য ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। অন্য আরও কয়েকটা রাজ্যে জাতিগত বিদ্বেষ চরম আকার ধারণ করেছে।

সু চি চাইলেও কি সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন? এটা করতে চাইলে দলের ভেতর থেকেই তাকে বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সামরিক বাহিনীর সহিংস হস্তক্ষেপকেও যে কারণে মিয়ানমারের চরমপন্থি বৌদ্ধরা স্বাগত জানাচ্ছে। সামরিক বাহিনী নিজেদের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য করে তুলেছে।

জাতিগত দ্বন্দ্ব জিইয়ে রেখে সামরিক বাহিনী লাভবান হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হবে মিয়ানমার এবং জনগণ। মিয়ানমারের সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা শুরু হবার পর থেকে সে দেশে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। সহিংসতা অব্যাহত থাকলে আগামীতে আরও নেতিবাচক প্রভাব পরবে দেশের অর্থনীতির উপর। অর্থনীতির চাকা দুর্বল হয়ে পরলে তার প্রভাব জনগণের উপরেও পরবে, কেননা তাদের আয় উপার্জন কমে যাবে, অর্থনৈতিক টানাপড়েন শুরু হবে।

সু চি’র উপর আস্থা রেখে জনগণ তার দলকে ১৯৯০ সালে এবং ২০১৫ সালের নির্বাচনে জয়যুক্ত করে। তাদের প্রত্যাশা ছিল দেশের শাসন ব্যবস্থার উপর থেকে সামরিক বাহিনীর প্রভাব কমবে; দেশে ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হবে। কিন্তু ঘটছে উল্টো। সামরিক বাহিনীর ইন্ধনে ধর্মীয় এবং জাতিগত বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। পর্যবেক্ষকদের মতে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন মিয়ানমারে ধর্মীয় এবং জাতিগত বিদ্বেষ প্রকট। বলা হয় যে ধর্মীয় উন্মাদনা এবং জাতিগত বিদ্বেষ সামরিক বাহিনী, সু চি’র সরকার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে। এটাও সামরিক বাহিনীর সাফল্য। এই উন্মাদনা তাদের প্রয়োজনীয়তাকে অপরিহার্য করে রাখবে। আর সু চি তাদের সাথে হাত মেলানোতে সামরিক বাহিনীর এখন পোয়া বারো।

রাজনীতিবিদ হিসেবে সু চি সামরিক বাহিনীর কাছে যেন আত্মসমর্পণ করেছেন, তিনি তার নৈতিক ক্ষমতা হারিয়েছেন। এ সব কিছু করছেন ক্ষমতার লোভে। ক্ষমতালোভী সামরিক জান্তা থেকে তাকে আলাদা করে চেনার উপায় কি বাকি আছে? ধর্মীয় উন্মাদনা এবং জাতিগত বিদ্বেষে আত্মহারা হয়ে আছে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী তারাও একদিন তাদের ভুল বুঝতে পারবে। তখন সু চি’র নতুন করে মূল্যায়ন হবে। একজন নেতা হিসেবে তিনি তার জনগণকে ভুল পথে পরিচালিত করার দায়ে অভিযুক্ত হবেন। ন্যায় নীতি বিসর্জন দিয়ে গণহত্যা চালানো সামরিক বাহিনীর সাথে আঁতাত করার দায়ে নিন্দিত হবেন। একটা সময় মিয়ানমারের জনগণ তাকে শত্রু হিসাবে আখ্যায়িত করলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। জনগণের শত্রু হবার পথেই চলেছেন সু চি।

Comments

The Daily Star  | English
Kudos for consensus in some vital areas

Kudos for consensus in some vital areas

If our political culture is to change, the functioning of our political parties must change dramatically.

5h ago