‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে চিত্ত’
এখন যে গানটি মনেমনে সবসময় অনুরণিত হচ্ছে, সেটি হল—
ওরে গৃহবাসী খোল্, দ্বার খোল্, লাগল যে দোল।
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্॥
রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে,
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে,
নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্॥
সত্যি এ সময়টা যেন ঢাকাবাসীর জন্য দ্বার খুলে দেখার সময়, প্রকৃতি তাদের ডাকছে। শত ঝামেলা ও কষ্টের মধ্যে থাকা ঢাকাবাসীকে প্রকৃতি তার অপার সৌন্দর্য দেখার আবাহন জানাচ্ছে। এ সময়টায় চারিদিকে যেন আলোর নাচন। আকাশ-বাতাস আলো করে ফুটে রয়েছে আগুন রঙা কৃষ্ণচূড়া, বসন্ত রঙা অশোক, সোনালু, ভালবাসার রঙের বেগুনি জারুল আর পিঙ্কেশিয়া। চোখ জুড়ানো রঙে মেতে আছে ঢাকার প্রকৃতি। ঠিক এ সময়টার জন্যই হয়তো কবিগুরু বলেছেন “হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে চিত্ত।”
আরও পড়ুন: ‘রডোডেনড্রন’ মানেই শেষের কবিতা
ঢাকার দম আটকানো পরিবেশের মধ্যে থাকতে থাকতে আমরা যখন হাঁপিয়ে উঠি, ঠিক তখনই প্রাণে খুশির পরশ ছুঁইয়ে দিয়ে আসে মধু মাস। শুধু ফলের মৌতাত নয়, ফুল, পাখি, কোকিলের কলতান, প্রজাপতির ছোটাছুটি, রঙের ছড়াছড়ি চারিদিকে। ঋতুরাজ বসন্তের অনেক সৌন্দর্যই সাথে করে বয়ে নিয়ে আসে গ্রীষ্ম। আর তাই ঘর থেকে পথে বেরিয়েই নগরবাসীর চোখ ধাঁধিয়ে যেতে বাধ্য। বড় বড় সড়কের দু’পাশে, অলি-গলিতে ফুল আর ফুল, যা ঢাকার নিত্যদিনের ইট-ময়লা-ধুলাবালি, ধোঁয়া থেকে একেবারে অন্যরকম।
মানিক মিয়া এভিনিউ, ক্রিসেন্ট রোড, রমনা, মিন্টো রোড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, শাপলা চত্বর, সুপ্রিম কোর্টের সামনে, ধানমন্ডি, গুলশান, পুরনো বিমানবন্দরের আশপাশ, ক্যান্টনমেন্ট, বারিধারা, ওয়ারী, উত্তরা, পুরনো ঢাকার কিছু এলাকাজুড়ে সারিবদ্ধভাবে ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া, অশোক, সোনালু ও জারুল ফুল। কি যে অপূর্ব দৃশ্য, তা ভাবা যায়না! মনের সব দুঃখ, কষ্ট, পথের ক্লান্তি সব ভুলিয়ে দেয় এই সৌন্দর্য। মানুষ হয়তোবা এমন সুন্দর দৃশ্য দেখবে বলে পথে নামে না, নামে জীবনের প্রয়োজনে। কিন্তু ফুলগুলো এমনভাবে তাদের উজ্জ্বল আভা ছড়াচ্ছে যে, চোখে পড়তে বাধ্য, মন ভাল হতে বাধ্য। যেন মনে হয় আমার পাশে প্রকৃতি রং ছড়িয়ে হাসছে। আমি অনেককেই চিনি যারা এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করেন, কখন ফুটবে কৃষ্ণচূড়া।
কৃষ্ণচূড়া (Delonix regia) গ্রীষ্মপ্রধান এলাকার ফুল। আগুন রঙা বলে কোন কোন এলাকায় এটি “আগুন ফুল” বলেও পরিচিত। বিশ্বের অনেক দেশে এর দেখা পাওয়া গেলেও বিভিন্ন দেশে এর নাম ভিন্ন। কিছু কিছু এলাকার বিশ্বাস ও নামের সাথেও জড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া, যেমন—যুক্তরাষ্ট্রের পোর্টারিকার একটি শহরের নামই ‘The valley of the Poinciana Trees’ বা ‘Valle de los Flamboyanes’। ভিয়েতনামে একে বলে ‘ফিনিক্স টেইল’। হাই পং নগরীকে বলা হয় ‘City of Red Poinciana’। ভারতের কেরালাতে খ্রিস্টানদের একটি অংশ মনে করেন যীশুকে যখন ক্রুশবিদ্ধ করা হয়, তখন সেখানে একটি ছোট কৃষ্ণচূড়ার গাছ ছিলো। যীশুর রক্তে সেই গাছ লাল হয়ে উঠেছিল বলেই আজ কৃষ্ণচূড়ার রং এত লাল।
কনকচূড়া বা স্বর্ণচূড়া (Peltophorum pterocarpum) গাছটিও কৃষ্ণচূড়ার মত বড় কিন্তু কৃষ্ণচূড়ার মত এই ফুল চারিদিকে এত দেখা যায় না। ঢাকায় সংসদ ভবনের পাশে, মিন্টো ও হেয়ার রোডে ছোট ছোট সবুজ পাতার সাথে মিলে ফুটে আছে গাঢ় উজ্জ্বল রঙয়ের কনকচূড়া। বাতাসে দোল খেতে খেতে কৃষ্ণচূড়া ও কনকচূড়ার ঝরে পড়া পাপড়ি ওইসব এলাকার গাছের তলার পথও করে তুলেছে রঙিন আর ফুলে ফুলে ঢাকা—যা দেখে গুনগুনিয়ে গাইতে ইচ্ছা করতেই পারে “কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন দিয়ে যাও।” ফুলটির উজ্জ্বল রঙের কারণে অনেক অঞ্চলে একে বলে “Yellow Flame Tree” বা “হলদে শিখা বৃক্ষ”। বাংলাদেশে কনকচূড়া নামটি দিয়েছেন অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা।
কনকচূড়া আমাদের দেশের গাছ নয়, এটি এসেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে। এর ফলগুলোও খুব সুন্দর। হঠাৎ একসময় দেখা যায় গাছটি ভরে আছে কপার রঙের ফলে। ফুলের হালকা গন্ধ ও উজ্জ্বল রঙয়ের কারণে মৌমাছি, প্রজাপতি এসে ভিড় করে।
কনকচূড়ার চাইতেও আরো উজ্জ্বল যে হলুদ ফুল ঢাকা শহরকে আলোয় আলোয় ভরিয়ে তুলেছে বছরের ঠিক এই সময়টায়, তার নাম স্বর্ণালু, সোনালু বা বাঁদরলাঠি (Golden rain tree / Golden shower tree or Cassia fistula)। সোনা ঝরানো রঙ বলেই হয়তো এর নাম সোনালু। হলুদ ফুলগুলো ঘন হয়ে আঙুরের থোকার মত এমন করে ঝুলে রয়েছে যে গাছের পাতাও দেখা যায়না। এই সুন্দর থেকে চোখ ফেরানো কঠিন। পথ চলতে গিয়ে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকি। আমি নিশ্চিত, নগরের ইট-কাঠের মধ্যে বন্দি আমরা সবাই কিছু সময়ের জন্য হলেও আনন্দ খুঁজে পাই এই ফুলের রঙ দেখে।
এত সুন্দর বলেই হয়তো ফুলের দেশ থাইল্যান্ডের জাতীয় ফুল সোনালু। আর কেরালারও “স্টেট ফ্লাওয়ার”। শুধু কি তাই, আয়ুর্বেদিক ওষুধও বটে এই ফুল। কারণ অনেক দেশেই রোগের দাওয়াই হিসেবে পরিচিত এই ফুল। এর জন্ম ভারতীয় উপমহাদেশে হলেও এশিয়ার প্রায় সব দেশেই সোনালু দেখতে পাওয়া যায়।
ঝলমলে এতো ফুলের পাশাপাশি এ সময়টাতে নগরবাসীর মনে শান্তির পরশ বুলিয়ে যায় হালকা বেগুনি রঙয়ের এর জারুল ফুল বা Jacaranda mimosifolia। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এই ফুল কীভাবে ভাসতে ভাসতে এই তল্লাটে চলে এসেছে, তা বলতে পারবেন ফুল বিশেষজ্ঞরা। তবে যেভাবেই আসুক—নয়নভোলানো রূপে যে এসেছে, সেকথা স্বীকার করতেই হবে। বাংলা একাডেমির পাশের রাস্তাটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরজুড়ে জারুল ফুলের উজ্জ্বল উপস্থিতি চোখে পড়ে। এছাড়াও নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় জারুল গাছ আছে। গ্রীষ্মের খরতাপে মানুষের মনে ও চোখে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেওয়ার জন্যই জারুলকে উষ্ণ এলাকার ফুল হিসেবে ফুটিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি। পৃথিবী জুড়েই উষ্ণ এলাকায় এই ফুলের বাস।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া “জারুল ফুলের নগরী” হিসেবেই পরিচিত। কারণ এই ফুল ফোটার সময় প্রিটোরিয়ার সড়ক, জনপথ, পাহাড়, ঘরবাড়ির অলিন্দ—সবকিছুর রঙ পাল্টে হয়ে যায় বেগুনি। চীনে এর রয়েছে আরো ব্যাপক ব্যবহার। স্বাভাবিকভাবেই চীনারা শুধু সৌন্দর্য দেখেই ক্ষান্ত হয় না, তাই তারা এই ফুলের রং কাপড় রং করার কাজেও ব্যবহার করে। অস্ট্রেলিয়াতে যেহেতু বড়দিনে গ্রীষ্মকাল থাকে, তাই সেখানে ক্রিসমাস সংগীতেও ঢুকে গেছে জারুল ফুল –“যখন দেখবে এখানে জারুল ফুটেছে, তখন বুঝতে পারবে বড়দিন চলে এসেছে” (When the bloom of the Jacaranda tree is here, Christmas time is near)। অস্ট্রেলিয়ার অনেক এলাকাতেই ছাত্রছাত্রীদের কাছে পরীক্ষার অন্য নাম “জারুল ফুল” বা “পরীক্ষা গাছ”। কারণ ঠিক এ সময়টাতেই, মানে বসন্তের শেষে ও গ্রীষ্মের শুরুতে তাদের ফাইনাল পরীক্ষার ঘণ্টা বাজে। সে যাক, তাই বলেতো জারুলের সৌন্দর্য একটুও কমেনি।
আমরা যদি আমাদের এই প্রিয় “জঞ্জাল ও ইটময়” ঢাকা শহরে আরো বেশি করে এই ধরনের গাছগুলো লাগাতে পারি, তাহলে নগরবাসী শত-সহস্র কষ্টের মাঝেও একদিকে যেমন চোখ ও মনের শান্তি পাবে, অন্যদিকে গরমের খরতাপে পথচারীর ছায়ার অভাব হবে না। আর পাখি, প্রজাপতি, মৌমাছিরাও ভালো থাকবে। আমরা ভুলেই যাই মানুষ আর প্রকৃতির জীবন কিন্তু একতারে বাঁধা।
ছবি: শাহরিয়ার কবির হীমেল
Comments