হেফাজত ইস্যুতে সরকারের সমালোচনাকারী তিন মন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত?

হেফাজতের সাথে সরকারের সাম্প্রতিক “সুসম্পর্ক” নিয়ে তিন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু এবং আসাদুজ্জামান নূর কিছু দিন আগে প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী রবিবার এক ইফতার পার্টিতে মন্ত্রীদের সমালোচনার জবাব দিলেন। তিনি বললেন, বাস্তবতা বিবেচনা না করে অনেক মন্ত্রী তার বিরুদ্ধে বক্তব্য বিবৃতি দিয়েছেন। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মেনন, ইনু ও নূরের নাম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমার বিরুদ্ধে কথা বলার আগে তারা পদত্যাগ করতে পারতেন।”

হেফাজতের সাথে সরকারের সাম্প্রতিক “সুসম্পর্ক” নিয়ে তিন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু এবং আসাদুজ্জামান নূর কিছু দিন আগে প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী রবিবার এক ইফতার পার্টিতে মন্ত্রীদের সমালোচনার জবাব দিলেন। তিনি বললেন, বাস্তবতা বিবেচনা না করে অনেক মন্ত্রী তার বিরুদ্ধে বক্তব্য বিবৃতি দিয়েছেন। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মেনন, ইনু ও নূরের নাম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমার বিরুদ্ধে কথা বলার আগে তারা পদত্যাগ করতে পারতেন।”

প্রধান্মন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী সরকারের বা সরকার প্রধানের কোনো পদক্ষেপের সমালোচনা করার আগে তিন মন্ত্রীর কি পদত্যাগ করা উচিত ছিল? কিন্তু তাদের কেউই তা করেননি। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, সেটা না করায় তারা কি নিয়মের বরখেলাপ করেছেন? তারা কি মন্ত্রীসভায় থাকার নৈতিকতা হারিয়েছেন? এখন কি তাদের পদত্যাগ করা উচিত?

দুনিয়া জুড়ে সংসদীয় গণতন্ত্র কীভাবে কাজ করে সেটা সংক্ষেপে আলোচনা করলে প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যাবে। 

সংসদীয় গণতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সমষ্টিগত দায়বদ্ধতা। মানে, মন্ত্রিসভার বৈঠকে কোনো ইস্যুতে একজন মন্ত্রী বিরোধিতা করতেই পারেন; তুমুল বিতর্কও করতে পারেন। কিন্তু ওই বিষয়ে একবার সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে কোনো মন্ত্রী প্রকাশ্যে সেটার সমালোচনা করতে পারেন না। মন্ত্রিসভার বৈঠকে উক্ত ইস্যুতে সমালোচনায় মুখর মন্ত্রীকেও প্রকাশ্যে ওই সিদ্ধান্তের পক্ষেই দাঁড়াতে হয়। তাই বলা হয়, মন্ত্রিসভার সদস্যরা এক সাথে ভাসে; এক সাথে ডোবে। এটাই বিধান।

এমন বিধানের পেছনে যুক্তি বেশ শক্ত। বিধানটির ফলে জনগণের কাছে সব সময় এই বার্তা যায় যে মন্ত্রিসভা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে। শক্তিশালী সরকারের জন্য মন্ত্রিসভার ঐক্যবদ্ধতা অপরিহার্য। মন্ত্রিসভার সদস্যদের ভেতর যদি ঐকমত্য না থাকে, এবং সেই অনৈক্যের কথা মন্ত্রীরাই যদি প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন তাহলে সরকার জনগণের চোখে দুর্বল হয়ে পড়ে। একটি দুর্বল সরকার সুশাসন উপহার দিতে পারে না, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না।

অনেকের মনে হতে পারে যে, এমন বিধানের কারণে তাহলে মন্ত্রীরা কি শৃঙ্খলিত? মন্ত্রিসভার অন্যায় অযৌক্তিক সব সিদ্ধান্তকেও মুখ বুজে মেনে নিতে হবে? না, একজন মন্ত্রীর মুক্তির পথ অবশ্যই আছে। কোনো সিদ্ধান্ত সমর্থন করতে না পারলে তিনি পদত্যাগ করবেন। পদত্যাগ করলেই তিনি ওই বিধানের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত। পদত্যাগ করেই তিনি ওই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রকাশ্য প্রশ্ন তুলতে পারেন; সংসদের ভেতরে বাইরে ওই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে পারবেন। এমন ঘটনার অনেক নজির পাওয়া যায় যুক্তরাজ্যে; ওয়েস্টমিনিস্টার মডেল অব পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির জন্মভূমিতে। আরও অনেক গণতান্ত্রিক দেশে এমন ঘটনার নজির আছে।

আমরাও ওয়েস্টমিনিস্টার মডেল অব পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি অনুসরণ করি। আমাদের সংবিধানেও মন্ত্রিসভার সমষ্টিগত দায়বদ্ধতার বিধান আছে। তাহলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভার তিন জন মন্ত্রী সম্পর্কে যা বলেছেন তা কি যথার্থ?

সমষ্টিগত দায়বদ্ধতার বিধান আলোচনায় দেখা যাচ্ছে তিন মন্ত্রী ওই বিধানের বরখেলাপ করেননি। কেননা, হেফাজতের সাথে সম্প্রতি সরকারের কথিত “সুসম্পর্ক’ তথা প্রধানমন্ত্রীর সাথে হেফাজত নেতাদের বৈঠক, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে সরকারের স্বীকৃতি দান, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্য অপসারণে হেফাজতের দাবির প্রতি সরকার প্রধানের সায়- এসব নিয়ে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত তো দুরের কথা আগে কোনো আলোচনা হয়েছে বলে জানা যায় না।

যদি মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা হতো; আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হতো এবং তিন মন্ত্রী যদি উক্ত সিদ্ধান্তকে সমর্থন না করে প্রকাশ্যে সমালোচনা করতেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে সমষ্টিগত দায়বদ্ধতার বিধান ভঙ্গের অভিযোগ তোলা যেত। মন্ত্রিসভার কোনো সিদ্ধান্তের প্রকাশ্য সমালোচনার আগে তাদের উচিত হতো পদত্যাগ করা। এমনকি সমালোচনা করার পর পদত্যাগ না করলে তাদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেত। কিন্তু হেফাজত নেতাদের সাথে বৈঠক বা কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার স্বীকৃতি দান বিষয়ে মন্ত্রিসভায় যেহেতু কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি-তাই তিন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সমষ্টিগত দায়বদ্ধতার বিধান ভঙ্গের কোনো অভিযোগ তোলা যায় না এবং তাদেরকে পদত্যাগ করার কথা বলাও যুক্তিযুক্ত মনে হয় না।

অধিকন্তু, সমালোচনাকারী তিন মন্ত্রীর দুজন পৃথক দলের এবং একজন প্রধানমন্ত্রীর দলের। যে দুই জন পৃথক দলের তাদের দলীয় স্বকীয়তা ও রাজনীতির স্বার্থে তারা হেফাজতের সাথে সরকারের সাম্প্রতিক “সুসম্পর্কের” সমালোচনা করেছেন বলে ধারণা করা যায়। প্রধানমন্ত্রীর দলের দলীয় শৃঙ্খলা ওই দুজন মন্ত্রীর জন্য প্রযোজ্য নয়।

অবশ্য প্রধানমন্ত্রী চাইলে যে কাউকে যখন-তখন তার মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন; কেননা একজন মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব ততক্ষণ যতক্ষণ তিনি তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে সন্তুষ্ট রাখতে পারবেন। তেমনি মন্ত্রী হবার যোগ্য এমন কাউকে তিনি যখন-তখন তার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। তাই তিনি চাইলে যেকোনো সময় যে তিন জন মন্ত্রী তার সরকারের সমালোচনা করেছেন তাদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে নতুন কাউকে নিতে পারেন। তিনি এখন পর্যন্ত সেটা করেননি; বরং তাদের সমালোচনা সয়ে গেছেন; তারাও মন্ত্রিসভায় টিকে আছেন।

তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ। ভবিষ্যতে মন্ত্রিসভার কোনো সদস্য সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করার আগে দশবার ভেবে নিবেন। মুক্ত মনে আলোচনা-সমালোচনা ছাড়া গণতন্ত্র বিকশিত হয়?

Comments

The Daily Star  | English

Former planning minister MA Mannan arrested in Sunamganj

Police arrested former Planning Minister MA Mannan from his home in Sunamganj's Shatiganj upazila yesterday evening

1h ago