“আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা আমিতো পথ চিনিনা”

নীলফামারী জেলার ডোমার স্টেশনে যখন আমাদের ট্রেনটা ধীরে ধীরে প্রবেশ করছিল, তখন স্টেশনের বড় বটগাছটার দিকে আঙ্গুল তুলে আব্বা বলল, ঐ যে দেখ বটগাছটার নীচে চায়ের দোকানে আমার ছলে মাসী (সেসময় আব্বারা খালাকে মাসী বলতো) বসে আছে। তাকিয়ে দেখি সাদা শাড়ি পরা একজন মাঝবয়সী নারী গাছের নীচে একটি টং দোকানে বসে চা খাচ্ছেন, আর হাত-মুখ নেড়ে গল্প করছেন। পাশে জনা দশেক মানুষ ঘিরে বসে তার কথা শুনছে। আব্বা ট্রেন থেকে নেমেই ঐ দোকানের দিকে এগিয়ে গেল তার মাসীর সাথে কথা বলতে। আমিও গেলাম আব্বার সাথে। দাদি আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। আশেপাশের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
সময়টা ছিল সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। আমি সম্ভবত তখন ক্লাস টু অথবা থ্রিতে পড়ি। সেইসময় দেশের একটি প্রত্যন্ত এলাকার একটি সম্ভ্রান্ত ঘরের কর্ত্রী কোনরকম সামাজিক বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে এইভাবে বাইরে বসে ‘আড্ডা’ দিচ্ছেন, এটা কিন্তু ছিল অভাবনীয় একটি বিষয়। বড় হয়েছি, কিন্তু ঐ দিনটির কথা আমি ভুলিনি। একদিন দাদির কাছে আব্বা জানতে চেয়েছিল তাঁর এই অবাধ স্বাধীনতা ও চলাফেরা নিয়ে। ছলে দাদির উত্তর ছিল, “কায় ফির কী ভাবিবে, তাতে হামার কী আসি যায়। মোর যা মনত চায়, মুই তাই করি। মাইনষি হিসাবে মুই ইচ্ছা স্বাধীন। বেইটছাওয়া বলি কি হামাক ঘরত সেন্দে থাইকতে হবে? শখ-আল্লাদ, পছন্দ-অপছন্দ থাইকবে না?” দাদি আরও বলেছিল, “পাকিস্তানি মেলেটারিক পুছি নাই। আর আবার ভয় কাক পাই?”
স্বাধীন নারীর কথা ভাবলেই আমার সামনে ভেসে ওঠে ছলে দাদির মুখখানি। প্রায় ৪৩/৪৪ বছর আগে আমাদের এই গ্রামীণ সমাজে একজন নারী এভাবে চিন্তা করতে পারতো, এভাবে জীবন চালাতে পারতো, এভাবে বাধাহীনভাবে এখানে-ওখানে বসে গল্প করতে পারতো - এতবছর পর এসে আমরা কিন্তু সেই অবস্থার কথা ভাবতেই পারিনা অথচ দেশে নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, বিভিন্ন সেক্টরে নারীর চাকরির হার বেড়েছে, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর প্রাধান্য লক্ষণীয়, রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব চোখে পড়ার মত, দেশের সার্বিক এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে নারীর ভূমিকা খুব বেশি।
গ্রাম বা শহর সবখানেই কাগজে-কলমে নারীর এগিয়ে যাওয়া চোখে পড়ার মত। বাংলাদেশে গত ২০ বছরে নারীর যা অগ্রগতি হয়েছে, তা সবারই জানা। আজকের দিনে অনেক নারীই ট্র্যাডিশনাল কাজের বাইরে নানা ধরনের কাজের সাথে জড়িত যেমন তারা পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করছে, উড়োজাহাজ চালাচ্ছে, সাংবাদিকতা করছে, বিজ্ঞানী হচ্ছে, ফুটবল-ক্রিকেট খেলছে। কিন্তু এরপরও কি আমরা বলতে পারবো নারী স্বাধীন, নারী কি পারছে তার জীবন ও সংসার নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে, নারী কি পারছে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে স্বাধীনভাবে তার মতামত দিতে? পারছেনা।
বিভিন্ন সামাজিক বিধিনিষেধ, নিয়ম-কানুনের বেড়াজালে পড়ে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হয়। যার কারণে অসংখ্য নারী প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায়িত হতেই পারেনা। নারী যতই যুদ্ধ করে এগিয়ে যাক না কেন, সমাজ নারীকে যতোই উপরে ওঠার সুযোগ করে দিক না কেন কিন্তু ঠিকই তাকে পেছন থেকে টেনে রাখে। নারীর চোখে আঙুল দিয়ে বারবার বলতে থাকে “তুমি নারী, মানুষ নও।” কবি লিখেছিলেন, “রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি।” আমি যদি একটু ঘুরিয়ে বলি, “রেখেছো নারী করে, মানুষ ভাবোনি” তাহলে কি খুব একটা ভুল বলা হবে?
যত সময় যাচ্ছে, নারী এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু পাশাপাশি এটাও দেখছি নারী নিজেই নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলছে একটা গণ্ডির মধ্যে। তার নারীত্বের এই গণ্ডি আসলে একটা শিকল। সমাজ তাকে এই শিকল পরিয়ে দেয় নানান মোড়কে। বলা হয় নারী তুমি এটা পারবেনা, ওটা করবেনা, এটা করা উচিত, ওটা করা উচিত নয়। নিরাপত্তা, পর্দা, ধর্ম, সম্ভ্রম, নারীর নরম হৃদয়, ভার বহনে নারীর অপারগতা, নারীর সৌন্দর্য, কমনীয়তা বা লাবণ্য, নারীর উপর বাড়াবাড়ি রকমের নজরদারি, যত্ন এবং ভালোবাসার নামে নারীকে এই মোড়কে পেঁচিয়ে রাখা হয় বা রাখার চেষ্টা করা হয়। এভাবে নারীর আত্মমর্যাদাবোধকে এমনভাবে নষ্ট করে দেয়া হয় যে, একটা পর্যায়ে নারী নিজেই বলতে থাকে, “হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা আমিতো পথ চিনিনা।”
এত অর্জনের পরও কিন্তু নারী তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে অব্যাহতভাবে বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। দেশে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার শতকরা ৮০ জন নারী। খুব সম্প্রতি প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে সরকারের সর্বশেষ জরিপ বলছে স্বামীর নির্যাতনের কথা গোপন রাখেন ৭২ শতাংশ নারী। শহর ও গ্রামের চিত্র প্রায় একই। নির্যাতনের পর আইনি সহায়তা নিয়েছেন মাত্র ২.৬ শতাংশ নারী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৫ সালে করা দ্বিতীয় জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে।
বারবার প্রমাণিত হচ্ছে নারী যতই এগিয়ে যাক বা যত বড় কিছুই অর্জন করুক, তাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু পাল্টায় না। সমাজে নারীর মর্যাদা ও অবদানের স্বীকৃতি নেই বলেই তারা ক্রমাগত সহিংসতা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। অপ্রিয় হলেও একথা সত্য যে বাংলাদেশের পরিবারে ও সমাজে নারীর অবস্থান অধস্তন। সমাজ নারীর মর্যাদাবোধটাকে জাগ্রত হতে দেয়না। বড় হতে দেয়না তার অহংবোধকে। আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি না হলে একজন নারীর পক্ষে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা আরও কঠিন।
লেখাটা শেষ করতে চাই এমন একজন নারীর গল্প দিয়ে, যিনি কোন শিক্ষাদীক্ষা ছাড়াই শুধু আত্মমর্যাদাবোধ দিয়েই জয় করেছেন তার সকল প্রতিকূলতা। এটাও আমার গ্রামেরই গল্প। দেশের বাড়ি খাটুরিয়া গিয়ে দেখা হল হ্যাদলাদার সাথে। ওর প্রকৃত নাম যে কী আমরা তা জানিনা। বাপ চাচারা ডাকতো হ্যাদলা ব্যাটা বলে, আর আমরা ডাকি হ্যাদলাদা। হ্যাদলা দা এসে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসলো। চেহারাতে বেশ দুঃখ দুঃখ ভাব। জিজ্ঞাসা করলাম, “কী বাহে তোমারলার মনটা খারাপ ক্যানে?” বলল, “আর কইন্যা, মোর পরিবার চেপটি মোক আর মাইনবার চাছেনা।” আমি জানতে চাইলাম চেপটিটা আবার কায়?” বলল, “মোর পরিবার। মোর বউয়ের নাম চেপটি।” উল্লেখ্য, কারও নাম যে চেপটি হতে পারে, তা আমি ভাবতেই পারিনি !!
সুযোগ পেয়ে হ্যাদলাদা চেপটি সম্পর্কে তার অভিযোগ বলেই চলল, “ওমরালা মোক আর সোয়ামি হিসাবে গ্রাহ্যি কারেনা, মান্যিগন্যিও কারেনা। সারাক্ষণ বিড়ি ফুকেছে। নামাজ, ওজা নাই। মায়াছইল বেটাছেলে মাইনসির নাকান কাম কাইজ করে। বেটা ছেলের নাকান চলাফিরাও করে।” জানতে চাইলাম ও ব্যাটাছেলের মতো কী কাজ করে? বলল, “এনজিও কারে। ঐ এনজিও’র হয়া আস্তাত গাছ লাগায়, ট্যাকা পায়। ট্যাকা কামাই কারে বলে ওমরালার কাছোত বড় ছোট কোন দিগজ্ঞান নাই। মাইয়া ছাওয়াল হইছে কিন্তুক কোন পর্দা পুসিদা নাই।”
অনেকক্ষণ কথা বলে বুঝলাম স্ত্রীর এই বাইরে কাজ করাটা এবং আয় করে নিজের পায়ে দাড়াঁনোটা হ্যাদলাদার পছন্দ হয়নি। স্বামীর কথা অনুযায়ী ধর্ম কর্ম না করা এবং হ্যাদলাদাকে গুরুত্ব না দেয়াই চেপ্টি বেটির অপরাধ। অবশ্য হ্যাদলাদাকেইবা দায়ী করি কিভাবে? বহু শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত প্রগতিশীল পুরুষও হ্যাদলাদার মত এমনটাই ভাবে। চেপ্টির কাছে যখন জানতে চাইলাম সে কেন হ্যাদলাদার কথা শোনেনা? চেপ্টি পরিষ্কার জানিয়ে দিল, “মোর কাছোত কাম আগত। খায়া দায়া, ছেলে ছোট নিয়া নিজে বাঁচিম, নাকি ওমারলার কথা শুনি ঘরত সেন্দে থাকিম?” মুই একটা মাইনসি, মুই ক্যানে কাম কারিমনা? মোর বাঁচার জন্যই কাম আগত।”
অথচ অনেক বছর আগে আমি দেখেছি আমার ডাক্তার বোন কীভাবে ডাক্তারি বিদ্যা ভুলে পুরোপুরি স্বামীর উপর নির্ভরশীল হয়ে গেল? দেখেছি আজ থেকে ২৫ বছর আগে বেক্সিমকো গ্রুপের একটি উচুঁ পদে চাকরিরত আমার আরেক বোনকে, যে ‘স্বামী চায়না’ বলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে গৃহবন্দী হয়েছে এবং পরে স্বামীর হাতেই দিনের পর দিন নিপীড়িত হয়েছে। চলমান ব্যবসা বন্ধ করে দিল আমার ভাবি। কারণ সেই একই, আমার ভাই চায়না যে ভাবি কাজ করুক। অফিস থেকে ঢাকার বাইরে মাঝেমাঝে যেতে হয় বলে আমার বন্ধুকে এনজিও’র ভাল চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছে। বিদেশে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করতে হল আমার এক ভাগ্নিকে, কারণ শ্বশুরবাড়ি রাজী নয়।
আত্মমর্যাদাবোধ ধ্বংস করে দেয়ার এরকম উদাহরণ আছে আমাদের সামনে। শহরের শিক্ষিত নারীকেই যদি এই বাধার মুখে পড়তে হয়, তাহলে গ্রামের পড়াশোনা না জানা, হতদরিদ্র নারীর কী অবস্থা হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
Comments