কবিতায় বহুমাত্রিক হুমায়ুন আজাদ

বাংলা সাহিত্যের কাব্যজগতে হুমায়ুন আজাদ এক অনন্য আলোকিত নাম। তিনি বাংলা কবিতাকে তাঁর বহুমাত্রিক লেখনীর মাধ্যমে দিয়ে গেছেন একটি সৃজনশীল ধারা। জীবনের কাছে দায়বদ্ধতা থেকে তিনি লিখেছেন অজস্র কবিতা। তাঁর প্রবন্ধ ও কথাসাহিত্য সব প্রজন্মের প্রেরণার অন্যতম উৎস। ব্যতিক্রমী উপস্থাপন ভঙ্গিমায় তিনি সাজিয়েছেন বাংলা কবিতাকে। প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে তিনি পাঠকের হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই পেয়েছেন। ভাস্বর হয়ে আছেন বাংলা সাহিত্য জগতে। আমৃত্যু তিনি প্রথাবদ্ধ কুসংষ্কারচ্ছন্ন পশ্চাদমুখী সমাজ-রাষ্ট্রের বদ্ধ শিকল থেকে মানুষকে মুক্তবুদ্ধির জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন করতে চেয়েছিলেন।
হুমায়ুন আজাদ ছিলেন একাধারে ভাষাবিজ্ঞানী, কবি, ঔপন্যাসিক, কিশোর সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। অর্থাৎ সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে তাঁর সুদীপ্ত পদচারণা। এজন্যেই তিনি বহুমাত্রিক লেখক হিসাবে পরিচিত। সব ধরণের লেখাই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফলে তিনি সব ধরনের লেখাতেই পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। তিনি একাধারে সৃষ্টিশীল ও মননশীল লেখক। তাঁর সৃষ্টিশীল লেখার মধ্যে মননশীলতা রয়েছে আবার মননশীল লেখার মধ্যে সৃষ্টিশীলতা রয়েছে। তাঁর সাহিত্য, ভাষা, সমাজ, রাষ্ট্র বিশ্লেষণ যেমন পাঠক দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে আবার কবিতা এবং উপন্যাস লিখেও তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে যখন এ উপমহাদেশের মানুষ মুক্তির অপেক্ষায় ঠিক এর আগ মুহূর্তে ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি জন্মগ্রহণ করেন বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার রাড়িখাল গ্রামে। তিনি বড় হয়েছেন রাড়িখালের প্রকৃতির মধ্যে। জীবনে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে যখন সত্যকে বাস্তবতার আয়নায় উপলব্ধি করতে শিখলেন ঠিক তখন থেকেই তিনি বর্জন করতে থাকেন এই তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থার হাজার বছর ধরে ব্যাপকভাবে মহামারী আকারে প্রচলিত চিরাচরিত সব প্রথা ও বিশ্বাসের ভিত্তিকে। জীবন, জগত ও মানুষকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন স্বাধীনচেতা মানবতাবাদী হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক হয়ে নিজের মধ্যে জন্ম দিয়েছিলেন প্রগতিমুখী মুক্ত চিন্তাধারার দর্শনের। তিনি জীবনের সম্পূর্ণ রূপ, সৌন্দর্য, কদর্য-অসৌন্দর্যের রূপ চিত্রায়ণ করেছেন তাঁর লেখায়। সেটা তাঁর কবিতায়, উপন্যাসে ও প্রবন্ধে রয়েছে। ভাষাবিজ্ঞান সম্পর্কিত গবেষণামূলক চর্চা দিয়ে বাংলা সাহিত্যের বোদ্ধামহলে তিনি ব্যাপক পরিচিতি পেলেও কবিতা দিয়ে লেখালিখির জগতে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে।
নিজের কবিতা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “অন্যদের সাথে আমার কবিতার পার্থক্য এর তীব্রতা, এর সৌন্দর্যতা, এর কবিত্ব। তাদের সাথে আমার ভিন্নতা বিষয়ে, ভাষায়, সৌন্দর্যের তীব্রতায় ও শিল্পকলাবোধে। আমার কবিতার স্টাইলে দেখতে হবে এর ভাষা ব্যবহার, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন এর ছন্দ মানা ও না-মানা; এর কল্প-রূপক প্রতীক ও স্টাইলের অন্তর্ভুক্তি। আমি অনেক ক্ষেত্রে ছন্দ মানার জন্য ছন্দ মানিনি, যদি দেখেছি যে ছন্দের কবিতার মধ্যেও মাত্রা মিলিয়ে ছন্দটি কৃত্রিম মনে হচ্ছে, তখন আমি তা মানিনি। স্তাবকবিন্যাস, চিত্রকল্প রচনা পদ্ধতি, রূপক তৈরির পদ্ধতি, ভেতরে তো চেতনা রয়েছেই। আমি কবিতায় বানানো পাগলামো বাতিকগ্রস্থতা, আবোলতাবোল বকা পছন্দ করি না। হেয়ালি পছন্দ করি না, আমি কবিতাকে নিটোল কবিতা করতে চেয়েছি, আর আমার কবিতায় রয়েছে আধুনিক চেতনা। আমার দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনও কবিতার অংশ। ভাবালুতা আমাদের দেশে খুব প্রিয়, আমি তা করিনি। ওগুলো গাল ফুলিয়ে পড়ার জন্য”।
হুমায়ুন আজাদের কাব্যগ্রন্থ সাতটি । তাঁর কাব্যগ্রন্থ অলৌকিক ইস্টিমার (১৯৭৩), জ্বলো চিতা বাঘ (১৯৮৫), সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৫), আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০), কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু (১৯৯৮) ও পেরোনোর কিছু নেই (২০০৪)-তে সামাজিক দায়বদ্ধতা, রোমান্টিক ভাবনা, জৈবিক চেতনা ও মানবিক সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা প্রতিবিম্বিত ও প্রতিসারিত।
তিনি কবিতার গঠনরূপ সম্পর্কে লিখেছেন, “যা পুরোপুরি বুঝে উঠবো না, বুকে ওষ্ঠে হৃদপিণ্ডে রক্তে মেধায় সম্পুর্ণ পাবো না; আমি অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার পরও রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে, তাঁর নাম কবিতা; -যদিও আমি কবিতা লিখেছি, লিখেছি তাঁর ভাষ্য, এবং আজো গদ্যের এ-পরাক্রান্ত কালে, কবিতা লিখতে চাই”।
প্রথাবিরোধী বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ। তাঁর কবিতা, উপন্যাস ও গবেষণা সাহিত্য স্বতন্ত্র ধারা ও বিপুল প্রজ্ঞানির্ভর। বাংলা সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের বিপুল পাঠ থেকে তাঁর রচনায় গভীর জীবন অন্বেষণ ও বিচিত্র অনুভবের প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করা যায়। হুমায়ুন আজাদের কবিতা বিষয়বৈভব, নির্মিত ও বক্তব্যের যে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছে তা নিয়ে সামান্য আলোকপাত করা যেতে পারে। ষাটের দশকে হুমায়ুন আজাদ কবিতাচর্চা শুরু করেন। সত্তর দশকে তাঁর কবিতায় রোমান্টিক বক্তব্যের পাশাপাশি অ্যান্টিরোমান্টিক বক্তব্য, বিষয়-প্রকরণ, সমাজ-পরিপার্শ্বের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ, শিল্পকুশলতায় সংবেদী প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
স্বদেশ, প্রকৃতি ও সমকাল তাঁর আগ্রহের বিষয়। মানুষের জীবনের বিভিন্ন সময় কৈশোর, যৌবন ও পৌঢ়ত্বে যেসব অনুভব ক্রিয়াশীল থাকে তা তাঁর চিন্তাজগৎ ও কর্মের মধ্যে পরিব্যপ্ত হয়। হুমায়ুন আজাদ কবিতায় তীক্ষ্ণ জীবনানুভূতি সঞ্চয় করেছেন। তিনি যখন যে সময়ের কথা বলতে চেয়েছেন সে সময়ের সমাজবাস্তবতা তাঁর কাছে মুখ্য প্রতিপাদ্য হয়েছে। সাবলীলতা, শনাক্তকরণের বোধ ও প্রকাশের নিবিড় আকৃতি তাঁর কবিতাকে নান্দনিকতার মর্যাদায় সিক্ত করেছে। শোষণমুক্ত, স্বনির্ভর সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে সমাজের মানুষের ভেতরে লুকায়িত মিথ্যাকে দূরে সরিয়ে ফেলার জন্যে নিজের মেধা ও মনন গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষধর্মী গবেষণায়। তিনি সমগ্র পৃথিবীর নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের মুক্তির নিমিত্তে তিনি দ্ব্যর্থ কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন-
‘আপনারা কি জানেন আপনারা শোষণ উৎপাদন করছেন?
আপনাদের বলা হয় আপনারা উৎপাদন করছেন সম্পদ।
কিন্তু আপনারা কি জানেন কী ভয়াবহ, নিষ্ঠুর,
দানবিক সম্পদ আপনারা উৎপাদন ক’রে চলেছেন শরীরের রক্ত
ঘামে পরিণত করে? বন্ধুরা, প্রিয় শ্রমিক বন্ধুরা,
আপনার দিনের পর উৎপাদন ক’রে চলেছেন শোষণ।
আপনারা যখন সুইচ টিপে একটি কারখানা চালু করেন
তখন আপনারা চালু করেন একটা শোষণের কারখানা’।
(কবিতাঃ বন্ধুরা, আপনারা কি জানেন আপনারা শোষণ উৎপাদন করছেন)
গতানুগতিক ধারা ভেঙে তিনি কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর কবিতায় বক্তব্য ও ভাষাবিন্যাসে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়ে। তিনি মানুষকে সচেতন করার প্রয়াসী ছিলেন। ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের মানুষ তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে। মানুষের মনোভঙ্গি, স্মৃতি, দুঃখ-কষ্ট, যাপিত জীবন ঘিরে কবির আগ্রহ। তিনি মানুষের মধ্যে খুঁজে পেতে চেয়েছেন শুভ্রতা। বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামগ্রিক অবস্থা কবিচিত্তে আলোড়ন তোলে। তিনি লিখেছেন-
‘শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের ঠোঁট
গদ্যপদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্ক্স-লেনিন,
আর বাঙলার বনের মতো আমার শ্যামল কন্যা-
রাহুগ্রস্ত সভ্যতার অবশিষ্ঠ সামান্য আলোক-
আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে’।
(কবিতাঃ সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে)
হুমায়ুন আজাদের কাব্যিক ভাষা, উপস্থাপনা ও চিত্রকল্প ব্যবহার কবিতাকে দ্যুতিময় করেছে। জীবনযাপনে বাধা-বিপত্তির মতো কবিকে যেতে হয় শাসকের রোষানলে; তাঁর ওপর ঝুলে ছিল ধর্মব্যবসায়ীর ক্রোধের খড়গ। একরাশ ক্ষোভ নিয়ে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন-
‘তোমাকে মিনতি করি কখনো তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।
জানতে চেয়ো না তুমি নষ্টভ্রষ্ট ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের কথা; তাঁর রাজনীতি,
অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমণ্ডলি, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ,
মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন ক’রে আমাকে পীড়ন কোরো না;
আমি তা মুহূর্তও সহ্য করতে পারি না, -তাঁর অনেক কারণ রয়েছে’।
(কবিতাঃ বাঙলাদেশের কথা)।
হুমায়ুন আজাদ বাংলা কবিতার ইতিহাসে তাঁর নির্মাণশৈলী, অনুভূতি বিবৃতি ও রূপক ব্যঞ্জনা প্রয়োগে নতুন সীমা চিহ্নিত করেছেন। কবিতা সব শিল্পের মধ্যে আধুনিক এ উচ্চারণে আস্থা স্থাপন করে কবিতা পাঠককে দিয়েছেন নতুন পথের সন্ধান। শব্দের সঙ্গে শব্দের মিলন রচনা করে যে কবিতা সৃষ্টি করেছেন তিনি; তা আমাদের যাপিত জীবন, জগৎ-সংসারের মহৎ সম্ভাবনা, অবসাদ ও সংগ্রাম থেকে তাড়িত। কবিতা চিন্তার মুক্তি, চিত্তের প্রসারতা ও আবেগ-অনুভূতির দ্যোতক। তিনি এ সত্যের কাছে নতজানু কবিতাকে শিল্পনন্দন করেছিলেন। হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন, ‘একটি মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন থাকে এবং শিল্প সৃষ্টি করার জন্য, কোনো অন্ধ মৌলবাদীর হাতে নিহত হওয়ার জন্য নয়’। অথচ এই নৈসর্গিক কবিকে ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে মৌলবাদীদের হাতেই। তিনি শারীরিকভাবে অনুপস্থিত হলেও চিরকাল রয়ে যাবেন মুক্তবুদ্ধির চেতনায় আলোকরশ্মি হয়ে। হুমায়ুন আজাদের ক্ষুরধার অজেয় শক্তিসম্পন্ন লেখনী মানবিক চেতনা ও মূল্যবোধ দিয়ে উপলব্ধি করে জ্ঞানপিপাসু তরুণ প্রজন্মের চিন্তা-চেতনায় সত্যানুসন্ধানী ও মানবতার কল্যাণকর পথের সন্ধান দিবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
Comments