জোড়াসাঁকোয় আজও স্থাপিত হয়নি বাংলাদেশ গ্যালারি

বিশ্বকবির জন্মভিটে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে আজও পূর্ণাঙ্গভাবে স্থাপিত হয়নি বাংলাদেশ গ্যালারি ‘বীথিকা’। ২০১২ সালে ১৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্যালারি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন। বীথিকা গ্যালারির জন্য রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে তৎকালীন মন্ত্রী কুষ্টিয়ার শিলাইদহে পদ্মা নদীতে কবির বেড়ানোর স্মৃতি বিজড়িত নৌকার রেপ্লিকাও তুলে দিয়েছিলেন। ওই রেপ্লিকা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। জোড়াসাঁকোয় যুক্তরাষ্ট্রের গ্যালারির পাশেই পড়ে রয়েছে নৌকাটির রেপ্লিকা।
ভারতের সাথে বাংলাদেশেও কবির জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে। সেটাও প্রায় ২২ বছর। কী নেই বাংলাদেশে কবির স্মৃতির অংশে। শিলাইদহ কুঠিবাড়ি থেকে পদ্মা নদী...বহু কালজয়ী রচনার সাক্ষী পদ্মা-মেঘনা-যমুনার বাংলা। কবির জীবনের সেসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, চিত্র এবং কর্ম সংরক্ষণ করতেই উদ্যোগী হয়েছিল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র। তাঁরাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রথম জোড়াসাঁকোয় বাংলাদেশ গ্যালারির প্রস্তাব করেছিল ২০০৯ সালে। সেই প্রস্তাব দ্রুততার সাথে অনুমোদন করার পর ২০১০ সালেই বিশ্ববিদ্যালয় ঠাকুরবাড়িতে বাংলাদেশ গ্যালারির জন্য জায়গা বরাদ্দ করে। জায়গা বরাদ্দ দেওয়ার পরই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তখন কলকাতায় উপ-রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন মাসুদ খন্দকার। এরপর আরো তিন জন উপ-রাষ্ট্রদূত যথাক্রমে মোস্তাফিজুর রহমান, আবিদা ইসলাম এবং সর্বশেষ জকি আহাদের কাছেও চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও সাড়া দেওয়া হয়নি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে।
দ্য ডেইলি স্টারকে এই বিষয়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী খানিকটা আক্ষেপ করেই বলেছেন, বহু চেষ্টা করা সত্ত্বেও এখনও বাংলাদেশ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়া যায়নি। উপাচার্য বললেন, আমি ঠিক জানি না কোন মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি গিয়ে আটকে রয়েছে। আমার সঙ্গে বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী ছাড়াও বহু শিল্প-বোদ্ধা এবং সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের কথা হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও সাড়া পাইনি। অথচ বাংলাদেশ গ্যালারির জন্য বহু বছর ধরেই জায়গা চূড়ান্ত করা রয়েছে।
আরও পড়ুন: নাগর কূলে রবি ঠাকুরের স্মৃতিগাঁথা
সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশে কবিগুরুর বাসস্থানগুলো আছে সেগুলো ঢাকার বাংলা একাডেমির আমন্ত্রণে গিয়ে আমি ঘুরে দেখেছি। এর কারণ হচ্ছে জোড়াসাকোঁয় যে বাংলাদেশ গ্যালারি করা হবে, সেটা তৈরির ধারণা নেওয়া।”
তবে তিনি আশাবাদী যে বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
প্রসঙ্গত, ইতোমধ্যে জোড়াসাঁকোয় জাপান, চীন, আমেরিকা এবং হাঙ্গেরি গ্যালারি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এই দেশগুলোর সঙ্গে নানাভাবে কবির সৃষ্টিকর্ম জড়িয়ে রয়েছে। আর সেসব স্মৃতি সংরক্ষিত রয়েছে প্রত্যেক দেশের গ্যালারিতে।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মনে করেন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির চেয়ে বাংলাদেশে বাঙালিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আবেগ প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি এর ব্যাখ্যা করে বলেন, “যেহেতু বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির লড়াইকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অনুপ্রাণিত হয়েছিল এবং বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছিল; এই বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের যে আবেগ রয়েছে, তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যেভাবে ভাবেন সেটা হয়তো পশ্চিমবঙ্গের মানুষরা ভাবেন না। যেহেতু ভারতবর্ষের মধ্যে এটা একটা অঙ্গরাজ্য এখানে মানুষকে তাঁর মাতৃভাষার বাইরেও ইংরেজি বা হিন্দি অন্য কোনো ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করতে হয় তাঁর দৈনন্দিন জীবন কিংবা জীবিকার জন্য সে কারণেই মনে হয় আবেগের প্রকাশটা ভিন্ন। কিন্তু বাংলাদেশের আবেগটা সত্যিই প্রশংসনীয়।”
বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে এশিয়ার প্রথিতযশা গবেষক ড. সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী। তিনি বলেন, “রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গত বছর প্রাচ্যের সেরা শিক্ষাতীর্থ বলে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মূলত দুই দেশের মেধাদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর মধ্য দিয়ে আরো জানা-বোঝা। এরই লক্ষ্যে প্রতি বছর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উৎসব উদযাপন করা হবে। একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় উৎসব আয়োজন করবে সেখানকার কর্তৃপক্ষ।”
তবে কলকাতার বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে রবীন্দ্রভারতীর উপাচার্যের অভিযোগের বিপরীতে তাদের ক্ষুব্ধ-অভিমানের কথাই জানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তার কথায়, জাপান, চীন, যুক্তরাষ্ট্রকে যে পরিমান জায়গা ছাড়া হয়েছে এর চেয়েও অনেক কম জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয় বাংলাদেশ গ্যালারি বিথীকাকে। সে কারণে বাংলাদেশ সরকার মনে করে, বাংলাদেশে কবির জীবনের যে গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে, তাঁর যে সৃষ্টি সেখানে রয়েছে; সেটা পরিপূর্ণ না হলেও কিছুমাত্র তুলে ধরার জন্যও আরও অনেক বেশি জায়গা প্রয়োজন। আর যা কিনা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেননি।
জানা গেছে, উপ-দূতাবাস কর্তৃপক্ষও বিষয়টি নিয়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অনুরোধ করেছেন কিন্তু তারাও জায়গা বাড়ানোর কোনও উদ্যোগ নেয়নি।
Comments