জীবিকার তাড়নায় ডুবুরি

পুকুরে গোসল করতে নেমে গয়না হারিয়ে ফেলা অসম্ভব কোন ঘটনা না। কানের দুল বা নাকের নথ যেটাই হোক না কেন গয়না না খুলে পুকুরে নামলে এমনটা হতে পারে। কিন্তু হারিয়ে ফেলা গয়না উদ্ধার করাও যে কারও পেশা হতে পারে এটা বিশ্বাস করা অনেকের জন্যই কঠিন।

অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এই পেশার মানুষ খুঁজে পেতে খুব বেশি দূরে যেতে হবে না। নারায়ণগঞ্জের বেদে সমাজে কয়েকজন আছেন যারা ঠিক এই কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এরা বছরের পর বছর ধরে পুকুরে হারিয়ে যাওয়া মূল্যবান জিনিসপত্র উদ্ধারের কাজ করছেন। স্থানীয়ভাবে এই ডুবুরিরা ‘পুকুরঝাড়ানি’ নামে পরিচিত।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সোহেল সরদার নামের এমন একজন ডুবুরির সাথে কথা হয় দ্য ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, “প্রচলিত কাজ বলতে যা বুঝায় বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন কখনই সেসবে অভ্যস্ত ছিল না। পাখি শিকার ও সাপ ধরার মত কাজ করতাম আমরা। কিন্তু অনেক আগেই বন বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় এ ধরনের কাজ করে আর পেট চালানো সম্ভব হয় না। তাই আমাদের পূর্বপুরুষরা আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে ডুব দিয়ে গয়না খুঁজে বের করতে হয়।”

নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড ও রূপগঞ্জের দুটি বেদে পল্লীতে সোহেলের মত ডুবুরিদের দেখা মেলে।

যখন বেশিরভাগ মানুষ পুকুরে গোসল করত তখন ডুবুরিদের খুব চাহিদা ছিল। এখন পুকুরের সংখ্যা কমে যাওয়ায় লোকেও আর তাদের ডাকে না। কিন্তু এটাই তাদের একমাত্র সমস্যা না। মেয়েরাও এখন আর আগের মত সোনার হয়না পরে না। ডুবুরিদের চাহিদা কমে যাওয়ার পেছনে একেও বড় কারণ বলে মনে করেন সোহেল।

তিনি জানান, একটা সময় ছিল যখন ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে ডুবুরিদের ডাক আসত। কিন্তু সেসব পুরনো অতীত। কাজ পেতে এখন তাদের দূর-দূরান্ত পর্যন্ত যেতে হয়।

ডুবুরি মোল্লা নাসির উদ্দিন তার অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বলেন, “কাজের খোঁজে দূরে কোথাও গেলে প্রায় মাস খানেক পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। আমরা সাধারণত বরিশাল, খুলনা ও সাতক্ষীরার দিকে যাই। সেসব এলাকায় এখনও কাজ পাওয়া যায়।”

তিনি জানান, হারিয়ে যাওয়া সোনার হার খুঁজে দিতে পারলে এক থেকে দুহাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। তবে হীরার হার হলে তারা ছয় থেকে সাত গুণ পর্যন্ত বেশি দাবি করেন। মাসে এরকম আট থেকে নয়টি কাজ আসে তাদের।

আরেকজন ডুবুরি মেহেদী হাসান বলেন, কাজের সন্ধানে আমরা বাড়ি বাড়ি যাই। কারও গয়না হারিয়ে গেলে আমাদের খুঁজে দিতে বলে। দূরের কোন গ্রাম হলে মসজিদে বা স্কুল বারান্দায় রাতে থাকার বন্দোবস্ত হয়। এ নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না বলেও জানান মেহেদী।

ছবি: খালিদ হোসেন অয়ন

পুকুরের তলা থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র তুলে আনতে তারা ত্রিকোণাকার বেলচা ও নিড়ানির মত একটি যন্ত্র ব্যবহার করেন। পানিতে ১০ থেকে ১৫ ফুট গভীরে ডুব দিয়ে কাদামাটি তুলে এনে তাতে গয়না খোঁজার কাজ চলে।

তবে মজার বিষয় হল হারিয়ে যাওয়া গয়না খুঁজতে গিয়ে তারা অনেক সময়ই এমন কিছু পান যার খোঁজে তারা নামেনি। এরকম ক্ষেত্রে তারা এর মালিকের সাথে সেসব ভাগাভাগি করে নেন।

ডুবুরিদের মধ্যে নানা রকম কুসংস্কার চালু রয়েছে। তারা বিশ্বাস করেন অনেক পুকুরের তলাতে দৈত্য বসবাস করে। এই দৈত্যদের দ্বারা যেন কোনো ক্ষতি না হয় তাই তারা ডুব দেওয়ার আগে কলা ও মিষ্টি দেয়। মোল্লা নাসির উদ্দিন বলেন, দৈত্যদের পূজা করা না হলে ডুবুরি মারা যেতে পারে।

পেশাদার ডুবুরির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। মাত্র ১০ বছর আগেও নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় ৩০ জন ডুবুরির কাজ করলেও এই সংখ্যাটি এখন কমে পাঁচ জনে দাঁড়িয়েছে। তারা নিজেরাও চায় না তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই কাজ করুক। পড়ালেখা শিখে তাদের ছেলেমেয়েরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক এটাই তাদের ইচ্ছা।

Click here to read the English version of this news

Comments